রোববার ৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২
সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশুর উপস্থিতি এবং আমাদের করণীয়
ফাতেমা তুজ জোহরা
প্রকাশ: শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১২:৫৭ এএম |


নতুন প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার পাশাপাশি নতুন অনেক সমস্যাও সৃষ্টি করে। যে কোনও শিক্ষিত সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সমস্যাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা এবং সমস্যা সমাধানে সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে কোনও সমস্যায় যদি শিশুদের ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা থাকে তবে কালক্ষেপণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যেমন, শিশুদের ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। কেননা, অর্থ উপার্জনের এই সুযোগ ইদানীং সৃষ্টি হয়েছে এবং তা তার পিতামাতা এমনকি শিক্ষকদেরও প্রভাবিত করছে। তাই তারা শিশুদের ব্যবহার করে নানারকম ভিডিও কনটেন্ট তৈরিতে যেন উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু এই কনটেন্ট বানাতে গিয়ে মান এবং বিষয়বস্তু অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে ভীতিকর। শিশুর ব্যক্তিগত বিষয়, স্পর্শকাতর সমস্যা কোনও কিছুকেই জনসমক্ষে আনতে দ্বিধা করছেন না ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী অভিভাবক বা শিক্ষকরা।
বোমা বা আগ্নেয়াস্ত্র আমরা সবার হাতে দিই না। কিন্তু ইন্টারনেট দুনিয়ার শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পড়েছে সর্বসাধারণের হাতে। যার যা খুশি করতে পারার বিষয়টা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বদলে হয়ে উঠছে সামাজিক ও মানসিক ব্যাধি ছড়ানোর স্থান।
উদাহরণ হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়াকর্মী ও অ্যাকটিভিস্ট ক্যাম বেরেটের কথা বলতে পারি। বেড়ে ওঠার সময় তার মা বেরেট অনেক ব্যক্তিগত সময়ের ছবি ইন্টারনেটে শেয়ার করেন। ফলে তার ছেলেবেলা রীতিমতো বিভীষিকায় পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা এবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ক্যাম বেরেট বলেছেন– তার ছবিগুলো খুবই বাজেভাবে ব্যবহার হতে পারে এই আশঙ্কা তার মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে।
আবার ক্যালিফোর্নিয়ার একজন সিঙ্গেল মাদার কোডি এলিস করোনাকালে তার তিন সন্তানকে আনন্দ দেওয়ার জন্য ভিডিও শেয়ার শুরু করেন। তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে নাচের ভিডিও শেয়ার করতেন, কিন্তু হঠাৎ এই নির্দোষ বিনোদনের বিষয়টি অন্ধকার দিকে মোড় নেয়। তার একটি ভিডিওতে নেতিবাচক মন্তব্য আসতে শুরু করে এবং তিনি বলেন– ‘আমি মন্তব্যগুলো খুলে দেখি তা ভয়ঙ্কর নেতিবাচক। সঙ্গে সঙ্গে ভিডিওগুলো ডিলিট করে দিতে বাধ্য হই। তা আর কোনোদিন শেয়ার করিনি।’ কিন্তু তারপরও বাচ্চাগুলোর স্কুলের ঠিকানা ফাঁস হয়ে যায় এবং তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
আর আমাদের দেশে দায়িত্বশীলতার পাঠ না জেনেই আজকাল অনেকে ইচ্ছেমতো ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন, তাতে এমন সব বিষয় শেয়ার করছেন, যা দেখলে যেকোনও সচেতন মানুষের গায়ে কাঁটা দেবে। যা ইচ্ছা তা-ই প্রচার করে একটি শিশুকে ভয়ংকর মানসিক চাপে ফেলে দিচ্ছে। তারপর দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তির ভিডিও বানিয়ে যেকোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়াÍএসবই শিশুদের জন্য এক বড় সর্বনাশা খেলা।
একটু ভেবে দেখুন, আপনার প্রতিবেশীর শিশুটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আপনি তার মুখের ওপর মোবাইল ফোনটি ধরে রাখছেন। কোন অধিকারে? মৃত শিশুটিকে দেখিয়ে দোয়া চাচ্ছেন, কোন নৈতিক মানদ-ে? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে শিশুটির পরিবারের অনুমতি আছে, তবু সেই যন্ত্রণায় কাতর শিশুটি কি চাইছে তার অন্তিম মুহূর্ত বিক্রি করে কেউ টাকা উপার্জন করুক?
অর্থের প্রয়োজন বা লোভের কাছে মনুষ্যত্বের পরাজয় নতুন কিছু নয়, কিন্তু তার এত কদর্য রূপ আমরা চর্চা করছি যে রাষ্ট্র এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করি।
মানুষ চিরকালই তার চরিত্রের অন্ধকার দিকটি চর্চা করে এসেছে, কিন্তু বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশী, এমনকি শিক্ষকরাও যে শিশুকে দিয়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কনটেন্ট বানাচ্ছেন এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তা প্রচার করছেন, তার লাগাম টেনে ধরা যায় কীভাবে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে?
সম্প্রতি একজন মাদ্রাসা শিক্ষক তার সহজ সরল এক খুদে শিক্ষার্থীকে দিয়ে জাতীয় মাছের নাম ভুল বলার এক ভিডিও শেয়ার করেছেন। সেটি তাকে লাখ লাখ ভিউ এবং টাকা উপার্জনের পথ করে দিয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ করলে দেখবেন, ওই শিক্ষক নিছক আনন্দের জন্য হঠাৎ কাজটি করেছেন তা নয়, তিনি নিয়মিত ওই শিশুকে নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন? কী করে আমাদের সব পর্যায়ে এই ধারণা সৃষ্টি হলো যে বিদ্যা অর্জনের জন্য আসা একজন শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করতে শুরু করা একটি অতি স্বাভাবিক বিষয়?
শিশুটির মনোজগৎ চারদিকের পরিবেশের ওপর এই তথাকথিত খ্যাতির প্রভাবকে মোকাবিলা করবে কীভাবে? পাশ্চাত্যে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে শিশু শিল্পীরা খ্যাতির বিড়ম্বনা সইতে না পেরে মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়েছে।
এরকম ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে চলেছে। কেননা, সুযোগ পেয়ে যেই সমাজ শিশুদের পর্নোগ্রাফির বিরাট ব্যবসা গড়ে তুলতে দ্বিধা করেনি, তারা নিজেদের প্রতিবন্ধী, অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে মানহীন ভয়ংকর রকম কনটেন্ট বানাবেন, শিশুকে ভয়ংকর নেতিবাচক পরিবেশে ছেড়ে দিকে দ্বিধা করবেন না,  তাতে আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই।
ফুল ছিঁড়ে তো আমরা নষ্ট করি না, আর আমাদের শিশুদের, আমাদের সবচেয়ে দুর্বলতম ভালোবাসার জায়গাটি বুঝে না বুঝে যারা ধ্বংস করতে চাইছেন তাদের থামাতে রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিশুদের দিয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলে, তাদের নানাবিধ বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে চাওয়ার এই মানসিকতা বদলাতে শিক্ষাব্যবস্থাসহ পুরো সমাজকে এগিয়ে আসা জরুরি।
একটি শিশু সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্পদ, তাই বাবা-মা বা সমাজের কেউই তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা করার অধিকার রাখেন না। শিশুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা হওয়া উচিত আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। সে লক্ষ্যে সব পক্ষকে তার দায়িত্ব এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এবং সব প্রতিকূলতা প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আমাদের দেশেও তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
তাই শিশুর মাতা-পিতা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে আমরা সমাজের যে অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করি না কেন, আমাদের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। রাষ্ট্র তার প্রচলিত আইন কিংবা নতুন আইনের দ্বারা সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিশুদের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে এবং সমাজের সব মহল এগিয়ে আসবেন, একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে শিশুর অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন, সেটাই আমাদের আশাবাদ।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইগনাইট পাবলিকেশন্স












সর্বশেষ সংবাদ
এক বছরে সাড়ে ৩ শ ধর্ষণের অভিযোগ কুমিল্লায়
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পেলে ধারনা করা যাবে নির্বাচন কবে হবে: সিইসি
আজ কুমিল্লায় আসছেন সিইসি
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
এক বছরে ৯৬ বেওয়ারিশ লাশ দাফন কুমিল্লায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা ইকরা মডার্ণ স্কুলের বার্ষিক ফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা
জিয়া সাইবার ফোর্স- কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটি অনুমোদন
কুমিল্লায় বিজিবি অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজা জব্দ
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয়’
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২