![জীবনবোধ ও জীবনদর্শন]( https://comillarkagoj.com:443/2024/02/08/CK_1707329961.jpg)
৮৭
আজকের দিনে ছেলে-বুড়ো
অধিকাংশ মানুষই সিনিক ভাবাপন্ন। আধুনিক জীবনের ভৎঁংঃৎধঃরড়হ থেকে এর
উৎপত্তি। এর খানিকটা আবাস জিরিমিয়াড প্রবন্ধেও দিয়েছি। তথাপি বলব, কঠোর
বাস্তবের কাছে পরাজয় স্বীকার করা যৌবনের ধর্ম নয়। এ যুবকরা কি তবে যৌবন
হারিয়েছেন? না আমি তা মনে করি না। যুবকেরা যুবকই রয়েছেন। সিনিক মনোভাব এ
যুগের একটা ঢ়ড়ংব বা মানসিক ভঙ্গি; ফ্যাশানও বলা যেতে পারে। গভীরতর কোনো
জীবনবোধ থেকে এর উৎপত্তি নয় এটা এক জাতীয় নাস্তিকতা জীবনের সব কিছুতে
অনাস্থা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে পুরোমাত্রায় ধর্মজ্ঞান যার আছে তাকেই
নাস্তিক হলেও মানায়; তেমনি যিনি সত্যিকারের জীবন রসজ্ঞ সিনিক হওয়ার অধিকার
তাঁরই। জীবনের স্বাদ-গন্ধই যিনি পাননি, তিনি সিনিক সাজলে কী হবে? আমি তাকে
সিনিক বলে মানতে রাজি নই। সিনিক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়; কঠিনতম অভিজ্ঞতার
মূল্য দিয়ে সেই গৌরব অর্জন করতে হয়।
আজ পৃথিবীময় যে সিনিকের সংখ্যা
এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার কারণ এটা খাঁটি সিনিসিজম নয় এ হচ্ছে সিনিসিজম-এর
অতি সুলভ সংস্করণ। এর আদি এবং অকৃত্রিম রূপ সম্পূর্ণ আলাদা সিনিক দর্শনের
আদি কথা যাদের জানা আছে তারাই বলবেন যে, আজ যারা সিনিক বলে পরিচিত তাদের
সঙ্গে পুরাকালের সিনিকদের আদৌ কোনো মিল নেই। পূর্বতনরা বিশেষ এক জীবন
দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। এরা সর্ব বিষয়ে অবিশ্বাসী। ওদের ফিলসফি পজিটিভ এদের
আচরণ নেগেটিভ। সিনিক দর্শনের গোড়াকার ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নিলে কথাটা
আরেকটু স্পষ্ট হবে। গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস্ (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ
শতাব্দী) পুহরপংস -এর জন্মদাতা বলে পরিচিত। কিন্তু কারও কারও মতে তাঁরও
প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে অপর একজন গ্রিক দার্শনিক অনুরূপ মতবাদ প্রচার
করেছিলেন। প্রচলিত রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের অযৌক্তিকতা প্রমাণ করাই এদের
প্রধান কাজ ছিল; সমাজের সকল প্রকার অনাচারকে এরা অতি কঠোর ভাষায় নিন্দা
করতেন। স্পষ্টবাদিতা এদের অন্যতম চরিত্র বৈশিষ্ট্য- কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন
না। মার্কাস অরেুলিয়াস এদের আখ্যা দিয়েছিলেন গড়পশবৎং মতো সধহশরহফ অবশ্য
এদের জীবন-দর্শন নিন্দাতেই পর্যবসতি ছিল না। তাহলে এটিও একটি হবমধঃরাব
ঢ়যরষড়ংঢ়যু-তেই পরিণত হতো। এরা জীবনের সর্বপ্রকার কৃত্রিমতার বিরোধী ছিলেন।
জীবনকে যতখানি সরল এবং সহজ করা যায় তারই পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের জীবনের
সর্বপ্রধান কাম্য বস্তু ছিল স্বণির্ভরতা ঃড় যধাব ধষষ ড়হ বহববফং ডরঃয রহ
ড়ঁৎংবষভ সর্বং আত্মবশং সুখম এই ছিল তাদের জীবনাদর্শ কোনো ব্যাপারেই
পরমুখাপেক্ষী হওয়া তারা অপর বলে মনে করতেন এই কারণে কৃচ্ছ্রসাধন তাদের
অন্যতম ব্রত ছিল। ডায়েজিনিস নিজে কী কঠোর জীবনযাপন করতেন আজকের দিনে তা
বিশ্বাস করা কঠিন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে সর্বপ্রকারে খর্ব করে ন্যূনতম
উপকরণের সাহায্যে জীবনধারণ করেছেন। এ দিক থেকে এরা ঘোরতর আদর্শবাদী। পরে
গ্রিসদেশে ইঢ় ংঃড়রপ ফিলসফির উদ্ভব হয় সেটি সিনিক দর্শনের দ্বারা বিশেষভাবে
প্রভাবিত হয়েছিল।
জীবনকে সকল প্রকার জটিলতা থেকে মুক্ত করে মুক্ত
প্রকৃতির সঙ্গে যতখানি তাকে সংলগ্ন করা যায় তাই এদের লক্ষ্য ছিল। এই জন্য
সমাজের বাঁধাবাঁধি কিছুই তারা মানতেন না, রীতিনীতি প্রথাকে উড়িয়ে দিতেন।
এমনকি বিবাহ প্রথায়ও এদের বিশ্বাস ছিল না। এদের মতে নর-নারীর সম্পর্ক
একমাত্র প্রকৃতির অনুশাসনেই নির্ধারিত হওয়া উচিত– সমাজের অনুশাসনে নয়। এদিক
থেকে এরা ঝঃধঃব ড়ভ ঘধঃঁৎব-এর পক্ষপাতী ছিলেন।
বাধা-নিষেধ, আইনকানুন,
রীতি-প্রথা, আচার-ব্যবহার সকল কিছুকেই ধরতেন বলেই এরা বিশ্বনিন্দুক আখ্যা
লাভ করেছিলেন। কৌতুকের কথা এই যে এদের সম্প্রদায়গত সিনিক নামটি ও
বিরুদ্ধবাদীদের দেওয়া গ্রিক ভাষায় সিনিক শব্দের মূলগত অর্থ কুকুর।
সবকিছুতেই খেঁকিয়ে ওঠা কুকুরের স্বভাব। তা ছাড়া কুকুরের আরেক স্বভাব হলো
কোনো কিছুর মান-সম্ভ্রম রাখে না। যেখানে-সেখানে মূত্র ত্যাগ করে
ল্যাম্পপোস্ট আর তুলসী মূলে কোনো তফাত রাখে না। ঐসব কারণেই নিন্দুকেরা
সিনিক আখ্যা দিয়েছিল। তারা সেই অপবাদ শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন। তারা বলেছেন
বেশ ঔ নামই গ্রাহ্য। আমরা কোনো কিছুকেই অভ্রান্ত মনে করি না, সম্ভ্রান্ত
বলেও মানি না। সমাজকে দুরস্ত করতে হলে সব জিনিসের মুখোশ খুলে দিতে হয়,
তথাকথিত সম্ভ্রান্ত ব্যাপারেও সম্ভ্রমহানি করতে হয় সর্বব্যাপারে এদের
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তির্যক আর বাক্যভঙ্গি তীক্ষè।
এ যুগের সিনিকরা আদিযুগের
সিনিক মতবাদের আদর্শটুকু ভুলে গিয়ে তাঁদের ভঙ্গিমাটুকু শুধু গ্রহণ করেছেন।
শেষ বাক্য প্রয়োগে এরাও সিদ্ধহস্ত। প্রচলিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত করা সহজ।
কিন্তু তার পরিবর্তে নতুন বিশ্বাসের ভিত্তিতে নতুন জীবন- দর্শন গড়ে তোলা
সুকঠিন। এরা সেটি করতে পারেনি। এইজন্যই বলেছিলাম এদের জীবন-দর্শন নেতিবাচক।
প্রকৃত সিনিসিজম জীবন বিদ্বেষী নয়, জীবনের কৃত্রিমতা বিরোধী। আদি যুগের
সিনিকরা চেয়েছিলেন জীবনের সরলীকরণ আর আধুনিকরা চান লঘুকরণ। এ কথা স্বীকার্য
যে, আদি ও অকৃত্রিম বহুকাল পূর্বেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। রেনেসাঁসের
যুগে গ্রিক রোমান সভ্যতাকে পশ্চিম ইউরোপ যখন নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে নেয় তখন
সিনিসিজম এরও রূপান্তর ঘটল। এর সঙ্গে যে ধংপবঃরপরংস এর ভাবটুকু যুক্ত ছিল
তা সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হলো। সিনিসিজম এর সংজ্ঞা গেল বদলে। গত কয়েক শতাব্দী
ধরেই সিনিসিজম বলতে আমরা বুঝে আসছি জীবনের সর্ব ব্যাপারে অনাস্থা। একে বলা
যেতে পারে নিউ সিনিসিজম সংসারের কঠোরতম অভিজ্ঞতার ফলে যখন ঐ অনাস্থা
জন্মায় তখন সেটাকে অস্বাভাবিক বলা চলে না; সেই অভিজ্ঞতাকে যেমন মূল্য দিতে
হয়, অভিজ্ঞতাজাত অনাস্থাকেও তেমনি মেনে নিতে হয়। কিন্তু আজকের সিনিক মনোভাব
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ। অর্থাৎ যে সিনিসিজম এককালে সকল
প্রকার কৃত্রিমতার বিরোধী ছিল এখন সে সিনিসিজম্ নিজেই কৃত্রিম হয়ে উঠেছে।
এটা যুগের ধারা। এখন সবকিছুতে ভেজাল সিনিক দর্শনেও ভেজাল দেখা দেবে তাতে আর
বিচিত্র কি? কিন্তু এ কথা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, কৃত্রিমতারও একটা রস
আছে। আর এ কথাও নিশ্চিত যে সরল প্রাণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের চাইতে অবিশ্বাসী
দোষান্বেষী মানুষ ঢের বেশি ইন্টারেসটিং। গুণাগ্রাহী সহজেই হওয়া যায়,
দোষাগ্রাহী হতে হলে মনকে অনেক বেশি সতর্ক এবং সজাগ রাখতে হয়। এ কথা
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে দোষান্বেষী ব্যক্তিরা সমাজে সাহিত্যে যথেষ্ট
রসের সঞ্চার করেছেন। সাহিত্য রসিক হিসেবে আমি যেমন ব্ল্যাসফেমারের ভক্ত
তেমনি সিনিকের। আর সিনিক যদি খাঁটি জাতের হয় তবে তো কথাই নেই। আধুনিক
সংজ্ঞা মতেই বলছি মানুষ আজীবন যেসব ধ্যানধারণা মনে- প্রাণে লালন করে এসেছে
অকস্মিক কোনো নিষ্ঠুর আঘাতে যখন বিশ্বাসের নিরাপদ আশ্বাস বিনষ্ট হয়ে যায়
তখন যে অবিশ্বাসীর জন্ম হয় তারই নাম সিনিক। সেই সিনিকের অপূর্ব চিত্র
উদ্ঘাটিত হয়েছে হ্যামলেট চরিত্রের। নাটকের প্রথমাবধি শেষ পর্যন্ত হ্যামলেট
ঘোরতর সিনিক কিন্তু বরাবর তিনি যে তা ছিলেন না তারও আভাস গ্রন্থের মধ্যেই
আছে। নাটকের ঘটনাবলি ঘটনার আগে ডেনমার্কের রাজুপুত্রকে আমরা দেখি না, চিনি
না শুধু ক্ষণিকের জন্য তাঁর উজ্জ্বল মূর্তিটি আমাদের চোখে জাজ্বল্যমান হয়ে
উঠেছে ওফেলিয়ার মুখে একটি স্বগতোক্তিতে ঙ ডযধঃ ধ হড়নষব সরহফ রং যবৎব ঙ
বৎঃযৎড়হি!/ ঞযব পড়ঁৎঃরবৎ’ং ংড়ষফরবৎং, ংপযড়ষধৎং বুব ঃড়হমঁব ংড়িৎফ/ ঞযব
বীঢ়বপঃধহপু ধহফ ৎড়ংব ড়ভ ঃযব ভধরৎ ংঃঃব/ ঞযব মষধংং ড়ভ ভধংযরড়হ ধহফ ঃযব ড়িঁষফ
ড়ভ ভড়ৎস / ঞযব ড়নংবৎাবফ ড়ভ ধষষ ড়নফবৎাবৎং ঁিরঃ ফড়হি!
আদর্শ চরিত্র।
বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, শৌর্যে-বীর্যে, গুণে-গরিমায় এমনটি দেখা যায় না, সকলের
চোখের মণি। এই হচ্ছে হ্যামলেট যা ছিলেন আর নাটকের হ্যামলেট হলো সংসারের
নিষ্ঠুর আঘাতের হ্যামলেট যা হয়েছেন। তিনি ডেনমার্কের রাজকুমারের মুখেও
উবহসধৎশ’ং ধ ঢ়ৎরংড়হ শুনতে বড় অদ্ভুত লাগে। বলেছেন সমস্ত দেশটাই এক বিরাট
কারাগার। কী বিষম তিক্ততা! ঋৎধরষু ঃযব হধসব রং ড়িসবহ সিনিকের বিষোদগার
সিনিসিজম যে কী ভয়ংকর নিষ্করণ হতে পারে তার চরম দৃষ্টান্ত ওফেলিয়াকে
উদ্দেশ্য করে এবঃ ঃযবব ঃড় ং হঁহহবৎু ডযু ড়িঁষফংঃ ঃযড়ঁ নব ধ নৎববফবৎ ড়ভ
ংরহহবৎং? ইত্যাদি। হ্যামলেটের কাহিনি যতই হৃদয়বিদারক হোক হ্যামলেটের মানব
বিদ্বেষ জীবন বিতৃষ্ণা অপূর্ব রসের সঞ্চার করেছে। এমন সিনিক স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথও সৃষ্টি করতে পারে না, একমাত্র শেকস্পিয়রই পারেন। শেকস্পিয়র
সাহিত্যে আরও দুই-চারটি সিনিক আছেন। টাইমন অভ এথেন্স তো বটেই। ট্রয়লাস
অ্যান্ড ক্রেসিডার অন্যতম চরিত্র হ্যারসিটিস্ বলতে গেলে একেবারে মর্ডান
সিনিক। এ যুগের সাহিত্যেও অনেক সিনিক চূড়ামণির সৃষ্টি হয়েছে। এরাও আমাদের
রসের ভান্ডারে যথেষ্ট জোগান দিয়েছেন।
লক্ষ করার বিষয় যে সাধারণ মানুষেরা
চেষ্টা করলেও সিনিক হতে পারে না। সাহেিত্য যেমন বাস্তব জীবনেও দেখা যায়
এরা তীক্ষèাধী ব্যক্তি বাস্তব জীবনেও দেখা যায় এরা তীক্ষèাধী ব্যক্তি এবং
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহানুভব প্রকৃতির মানুষ। দুনিয়ার হালচাল দেখে বিশেষ করে
মানুষের অকৃজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে মানুষেরও মন তিক্ত বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর- এমন মানব প্রেমিক সংসারে কয়জন জন্মেছে। সেই দয়ার
সাগরও শেষ জীবনে সিনিক হয়ে উঠেছিলেন। বন্ধু ব্যক্তি কথাপ্রসঙ্গে জানালেন
অমুক আপনার বড় নিন্দা করছিল। বিদ্যাসাগর অবাক হয়ে বললেন, সে আবার মিছামিছি
আমার নিন্দা করে কেন? তার তো কোনো উপকার আমি করি না। এ হলো সিনিকের উক্তি
এবং অসাধারণ উক্তি। সাধারণ মানুষের মুখে এমন কথা সহজে জোগাবে না। বলা
বাহুল্য, এ সিনিসিজম অনেক উঁচু দরের জিনিস। সংসারের সকল জিনিসকে যিনি
মনে-প্রাণে ভালোবাসেন, অথচ মূর্খ এবং অকৃতজ্ঞ মানুষরা যখন এই ভালোবাসার
উদ্দেশ্য আরোপ করে তখন মনে যে বেদনার সঞ্চার হয় সেই বেদনা থেকে এই সিনিসিজম
এর জন্ম। এর সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই দরের সিনিকও সংসারে বিরল।