
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ।।
অতি
সম্প্রতি তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নের তিন গ্রামের
মানুষ হারিয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক বাড়িঘর। ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়েছে তিস্তা
পাড়ের মানুষ। বিলীন হয়ে গেছে দুটি মসজিদ, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ঈদগাহ
মাঠ, একটি মন্দির বজরা পশ্চিমপাড়া দাখিল মাদ্রাসা। একটি বেসরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় ও পুরাতন বজরা বাজার। ভাঙ্গন কবলিতরা আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের
নিচে। উত্তরে জজমিয়ার বাড়ী থেকে দক্ষিনে রুস্তম মৌলভীর বাড়ি পর্যন্ত প্রায়
দু’কিলোমিটার এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ভাঙ্গনের তীব্রতার ফলে
প্রায় আড়াই শতাধিক বাড়িঘর, ৫৬শ বিঘা ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ
মন্দির, গাছপালা, বাজারসহ মানুষের শেষ সম্বলটুকু নদী গ্রাস করেছে। কয়েকদিন
ধরে গ্রামের মানুষ পলিথিন টাঙ্গিয়ে খোলা মাঠে পড়ে আছে। মানুষগুলো গরিব
হওয়ায় আশ্রয় নেয়ারও কোন জায়গা নাই। দূর্দশাগ্রস্থরা বৃষ্টির মধ্যেই খোলা
প্রান্তরে মানবেতরভাবে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানা যায় গত
২০-২৫ বছর পূর্বে মূল নদীর স্রোত ছিল এই এলাকায়। গ্রামগুলোর উজানে নদী
শাসনের ব্যবস্থা নেয়ায় এখানে হঠাৎ করে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। নদী শাসন একটি
নদী ভাঙ্গনের কল্যানকর ব্যবস্থাপনা কিন্তু সাথে পাশ্ববর্তী বসবাসকারীরা
যাতে পুনরায় ভাঙ্গনের সম্মুখীন না হয় এবং ভাঙ্গনের সম্মুখীন হলে
পূনর্বাসনের ব্যবস্থা তৈরি করে রাখলে জন দূর্ভোগ কম হয়।
নদী ভাঙ্গনের
পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের টাষ্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার
ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস। সংস্থাটি
প্রতিবছরই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনে আগামীতে পদ্মা, যমুনা ও
ব্রহ্মপুত্রের বাঙ্গনের পূর্বাভাস দেয়া হয়। গত বছর কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছে তারও প্রতিবেদন দেয়া আছে। প্রকাশিত হয়েছে যে ২০২১ সালে পদ্মার উভয়
পাড়ে ৫৯৬ হেক্টর জমি নদীতে চলে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রায় ৫১০ হেক্টর জমি
ভেঙ্গেছে। আর যমুনার ৪১১ হেক্টর জমি নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। চলতি মৌসুমের
বাকি দিনগুলোতে পদ্মার কারনে দেশের ৭০০ হেক্টর জমি নদীর বুকে বিলীন হতে
পারে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রের ৫৬০ একর এবং যমুনার ৫৪০ হেক্টর জমির ভাঙ্গতে
পারে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে গত বছরের তুলনায় এবার ভরা বর্ষায় বন্যা হয়নি
বললেই চলে। মৌসুম শুরুতে তিন দফা বন্যা হয়। সেই পানি নেমেও গেছে। কিন্তু
এটাও ঠিক যে, উজানের বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই সাগরে যায়। তাই এই
পানি নেমে যাওয়ার সময় তিন নদীর অববাহিকায় ব্যাপক অঞ্চলে ভাঙ্গন দেখা দিতে
পারে। সবমিলে এর পরিমান ১৮শ হেক্টর হতে পারে। সংস্থাটি বলেছে এবার এপ্রিল,
মে ও জুনের যখন দেশে বন্যা হয়, পানি নেমে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে
ভাঙ্গন শুরু হয়। এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, সড়ক, ধর্মীয়
প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ী, হাটবাজার এমনকি হাসপাতালও বিলীন হয়েছে। এবার “নদী
ভাঙ্গন পূর্বাভাস-২০২২’ অনুযায়ী শুধু ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মা নদী
অববাহিকায় ১৭টি স্থানে ভাঙ্গনের ঝুঁকি আছে। এই ১৭টি স্থানের মধ্যে ৯টি
যমুনা, ৬টি পদ্মা ও ২টি পদ্মা নদীতে। নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রায় ১২টি জেলা
ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
স্যাটেলাইট প্রাপ্ত তথ্যে উপর ভিত্তি করে তারা
নদী ভাঙন স্থান চিহ্নিত করে থাকেন। যাতে ভাঙ্গনের তীব্রতা ও সম্ভাব্য
ক্ষয়ক্ষতি ঝুঁকির উপর ভিত্তি করে মানুষকে সতর্ক করা যায়। তাদের পূর্বাভাস
আমলে নিয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়। অনেক সময় স্থানীয়রাও সতর্ক হয়ে থাকেন।
এবারে আগাম বন্যায় ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙ্গন
শুরু হয়ে গেছে। অতি ঝুঁিকপূর্ণ এলাকার মধ্যে টাঙ্গাইলের নাগরপুর ও সদর,
রাজশাহীর চারঘাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, রাজশাহীর চারঘাট, মাদারীপুরের
শিবচর ও কুষ্টয়ার ভেড়ামারা আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জুলাই-আগষ্টে নদী ভাঙ্গন
বেশি থাকে। এবার কম বৃষ্টিপাত আর আগাম বন্যার কারনে নদীতে পানি প্রবাহ কম
ফলে ভাঙ্গন নিয়ে সেইরূপ হৈচৈ হয়নি। কিন্তু সেপ্টেম্বর এখনও শেষ হযনি যদি
পরিস্থিতি এমনই থাকে, তাহলে হয়তো নদী ভাঙ্গনের দিক থেকে গোটা দেশ স্বস্তি
পেতে পারত।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজলায় নওগাঙ্গা ইউনিয়নের গোড়কমন্ডপ
এলাকার ধরলা নদীভাঙ্গনে গৃহহীন অনেকগুলি নি:স্ব পরিবার। দীর্ঘ ৩৮ কিলোমিটার
পাড়ি দিয়ে প্রায় ২০০ পরিবার ভাঙ্গনে কবলিত। জানা যায় বেড়ি বাঁধসহ চলতি
বছরে ৩৫০টি এবং গত বছরে ৬৮১টি বাড়ি ভেঙ্গেছে। এতে এক হাজার একর জমি নদীতে
চলে গেছে। ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে আবাসন প্রকল্পসহ ফসলি জমি, মাছের ঘের ও
গরুর প্রকল্প। বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও আজ অব্দি পানি উন্নয়ন
বোর্ডের কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। নদী ভাঙ্গন এবং এ ভাঙ্গনে অনেক পরিবার
সর্বনাশের শিকার। এটা এককভাবে শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড চিন্তা করলে হবে না।
এটা গোটা দেশের একটি প্রকৃতিগত সমস্যা । এর সমাধান চিন্তা করে পাওয়া যাবে
না তবে বাধ নির্মানে সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার আবহাওয়া দপ্তরের আগাম সঠিক
প্রতিবেদন এবং জাতীয়ভাবে এর সঠিক পূনর্বাসন প্রকল্প তৈরি করে
ক্ষতিগ্রস্থদের কিছুটা হলেও মানসিক শান্তি ও বিপর্যয় মোকাবেলায় একটি
আশ্রয়ের খুজ মিলবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।