প্রধানমন্ত্রী ফের অম্লমধুর
Published : Saturday, 17 September, 2022 at 12:00 AM
মোস্তফা কামাল ।।
ফেলে-ছেড়ে কথা বলা তার অভিধানেই নেই, বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করে জবাব পাওয়া যায় না- এমন রেকর্ড নেই। কথা চিবান না, আমতা আমতা করেন না। অর্ধেক বলেন না। পুরো কথা তো বলেনই, সাপ্লিমেন্টারির মতো দুই-চার কথা বাড়তিও বলেন। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে তার মন-মর্জি ও অভিপ্রায়ও চট বরে বুঝে নেওয়ার সুযোগ আছে সাংবাদিকদের। তা দর্শক, পাঠক ও শ্রোতার জানা-বোঝার জন্যও জুতসই।
প্রধানমন্ত্রীর এ বৈশিষ্ট্যের আরেক ঝলক দেখা গেছে গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনেও। তার সাম্প্রতিক ভারত সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনটি শেষতক ভারত-বাংলাদেশ বা তার সফর নিয়ে থাকেনি, কথা চলে গেছে নানা দিকে। টাকা পাচার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী মুখের ওপর সোজা কথায় বলে দেন- ‘বিষয়টি নজরদারিতে আনার কারণেই সবাই জানতে পেরেছেন। আপনারা খুঁজে বের করেননি তো। আবার এমন এমন ব্যক্তি অর্থপাচারের তথ্য আছে- সেটি আপনারা লিখবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। বহু তথ্য... অনেক স্বনামধন্যদের ব্যাপারেও তথ্য আমার কাছে আছে। এটি আমাদের দুদক ও ব্যাংকের মাধ্যমে তথ্য আসছে। তবে সেটি আপনারা লিখবেন কিনা, তা দেখব।’
উপরোক্ত কয়েকটি বাক্যে সাংবাদিকতার এক করুণ হাল নির্দেশ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি, পাচার, জালিয়াতি, প্রতারণা, ক্যাসিনো, মাদক ইত্যাদি বিষয়ে গত কয়েক বছরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি নিদানকাল চলছে। পিকে হালদার, পাপিয়া, শাহেদ, সম্রাট, ড্রাইভার মালেক ধরনের একটি সংবাদও সাংবাদিকদের মাধ্যমে উঠে আসেনি। একটিরও নিজস্ব কোনো আগাম সংবাদ হয়নি। তাদের প্রত্যেককেই পুলিশ-র্যাব বা সরকারের কোনো সংস্থা ধরার পর সাংবাদিকরা কেবল গরম খবর হিসেবে বয়ান করেছেন। র্যাব জানিয়েছে, পুলিশ জানিয়েছে ধরনের বাক্য দিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছেন। নিজেদের জোগাড় করা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনির বরাত দিয়ে ঘটনা বা তথ্য বয়ান সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যই লজ্জার ও শিক্ষণীয়। কারও কারও স্মরণে থাকার কথা, বহুল আলোচিত সম্রাটকে ধরার পর সাংবাদিকদের এ নিয়ে অতিতৎপরতার মধ্যে তখনকার যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর তীর্যক মন্তব্যের কথা। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলে বসেছিলেন, ‘আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন... আঙুল চুষেছিলেন ...।
এ নিয়ে তখন অনেক কথা হয়েছে। সমালোচনা তো হয়েছেই। সংবাদ সম্মেলনটিতে প্রধানমন্ত্রী সাশ্রয়ীমূল্যে ভারত থেকে জ্বালানি তেল আনার ব্যাখ্যা জানিয়েছেন। তা এর আগে আসেনি গণমাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই তা জানাতে হয়েছে। জানিয়েছেন, সাশ্রয়ীমূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি করতে ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে তুলনামূলক স্বল্পসময় ও সাশ্রয়ীমূল্যে ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস তেল, এভিয়েশন ফুয়েল আমদানি করা সম্ভব হবে।
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে পারেননি আসল ঘটনা কি আসলে সেটিই ...। এর আগে-পরে আর কিছু নেই...। বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার হওয়া সংবাদ সম্মেলনটি যারা দেখেছেন, এ প্রশ্ন তাদেরও আহত করেছে। জুতসই কোনো প্রশ্ন না থাকায় শেখ হাসিনাকেই নানা তথ্য দিতে হয়েছে। তার ভারত সফরের প্রাপ্তি জানাতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত সফর করেন। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন ছিল সাধারণ মানুষের। জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব বেরিয়ে আসা উচিত ছিল সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে। বাস্তবে তা হয়নি। একের পর এক প্রধানমন্ত্রীকেই জানাতে হয়েছে। অথচ আগের বেশ কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি রসিকতাচ্ছলে সাংবাদিকদের অম্লমধুর পরামর্শের মতো করে বলেছিলেন তার প্রশংসা বা বন্দনা বাদ দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করতেন। সিনিয়রদের বদলে জুনিয়রদের বেশি প্রশ্ন করার আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকই এ থেকে শিক্ষা নেননি। প্রশ্নের চেয়ে তারা বন্দনাই বেশি করে চলছেন।
সংবাদকর্মীদের এ চর্চার পরিণতিতে প্রধানমন্ত্রীকেই নানা প্রশ্ন ও উত্তর সামনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। সাপ্লিমেন্টারি জবাব দিয়ে নানা তথ্য সামনে আনতে হচ্ছে। কমবেশি এবারের সংবাদ সম্মেলনেও সেটিই করতে হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে লিখিত বক্তব্য দিয়ে পরে দিতে হয়েছে নানা প্রশ্ন ও জবাব। জানাতে হয়েছে ‘জ্বালানি তেলের আমদানির উৎস বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে গত ২৮ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডকে (আইওসিএল) জিটুজি ভিত্তিতে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী হিসেবে তালিকাতুক্তির কথা। জানান, আইওসিএলের অন্তর্ভুক্তির ফলে তুলনামূলক স্বল্পসময় ও সাশ্রয়ীমূল্যে ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস তেল, এভিয়েশন ফুয়েল আমদানি করা সম্ভব হবে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
ভাইটাল প্রশ্ন ছিল, ভারত সফরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কী হয়েছে ...। জাবাবে বলেছেন, ‘অর্জন অনেক এসেছে। কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর। এর মাধ্যমে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত। ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হবে।’ এই সফরে সহযোগিতার যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে।
বঙ্গবন্ধু সিনেমা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বলেন- ‘করোনার কারণে অনেক দিন এটার শুটিং বন্ধ ছিল, করতে পারিনি। আসলে এই সিনেমার মূল শুটিং ঢাকায় করার কথা ছিল, করোনার কারণে সেটি হয়নি। কিছু শুটিং ঢাকায় হয়েছে। এখন সেটির এডিটিং চলছে। ট্রেইলার দেখার পর কিছু প্রশ্ন এসেছে। এখানে একটি বিষয় বলতে পারি- ট্রেলারটা যদি গ্রহণযোগ্য না হতো, তা হলে ফ্রান্সের কান ফেস্টিভ্যাল এটি গ্রহণ করত না। কান ফেস্টিভ্যাল যা-তা গ্রহণ করে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি যেটি বুঝলাম, আসলে ৭ মার্চে জাতির পিতাকে ওভাবে দেখার পর সেটিকে অভিনয় করে দেখালে এটি নিতে অনেকের একটু কষ্ট হয়। যখন সিনেমা হবে, তখন কাউকে না কাউকে তো অভিনয় করতেই হবে। আর সেভাবে করার চেষ্টা করতে হবে। আমি মনে করি, যেটুকু করেছে চমৎকার করেছে।’
খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে ভারত আর লুকোচুরি করবে না, বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দেবে- এ বার্তাও সংবাদ সম্মেলনে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে। সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন- চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দিতে ভারত সরকার পদক্ষেপ নেবে। এর পাশাপাশি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ওপর আরোপিত অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহার, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দ্রুত প্রত্যাবাসন বিষয়ে সহযোগিতা, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। এ ছাড়া পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রযুক্তি, গ্রিন ইকোনমি, সুনীল অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক ও জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধার কথা মাথায় রেখে ভারত থেকে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য- ধান, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদির অনুমানযোগ্য সরবরাহের জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছেন বলেও জানিয়েছেন।
বাস্তবে কী পয়েছি ... কী পেতে পারি... এর একটি খসড়া হিসাব অবশিষ্ট নেই। তা প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস না করলেও কষা যায়। একেবারে খালি হাতে ফিরেছেন, তা মোটেই বলা যায় না। ভারতের শিলিগুড়িতে অবস্থিত নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার (বাংলাদেশ অংশে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার ও ভারতের অংশে ৫ কিলোমিটার) পাইপলাইন ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। তা মোটেই হাওয়াই খবর নয়। পাইপলাইন নির্মাণের ফলে কম খরচে দ্রুত জ্বালানি তেলের পরিবহন করা যাবে। বর্তমানে রেলওয়ের মাধ্যমে ভারত থেকে বার্ষিক ৬০-৮০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা হয়। পাইপলাইন নির্মাণ হলে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করা সম্ভব হবে।
এ ধরনের ইতিবাচক ভাবনার অনেকটাই নির্ভর করে মানসিকতা ও উপলব্ধির ওপর। এর বিপরীতে বলা যায়, তিনি কেবল দিয়েই এসেছেন। বাস্তবতা স্বীকার করারও মন লাগে। বোধের আওতায় রাখতে হবে, বাংলাদেশের চারদিকেই ভারত। প্রতিবেশী দেশ দুটির সামনেই নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দুই দলেরই বিশেষ সময়। তাই সময় যত যাবে, ততই পরিষ্কার হবে বিষয়টি।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক এবং বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন