
জুলফিকার নিউটন ||
মনীষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথমেই শব্দের প্রেমে পড়েছেন। তাঁর কাছে শব্দ সুন্দর, উজ্জ্বল ও লাবণ্যময়, তিনি শব্দের আলো ছড়াতে চেয়েছেন দূরে, আর শব্দের বিভায় কাছে আনতে চেয়েছেন গোপন; সেজন্য শব্দের বিবর্ধমান বিবরণ, ধ্বনি আর আবেগ তাঁকে উৎপন্ন করেছে শস্যের মতন। তিনি বারবার নিজেকে ফলিয়েছেন, শব্দের মধ্যে দিয়ে তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন নিজেকে ও অন্যকে, এবং এই অন্যটি তিনি নিজেই : অন্যের আয়নায় তিনি নিজেকে দেখেছেন, নিজেরই কথা বলা শুনেছেন, দেখেছেন শব্দে তৈরি হচ্ছে জগৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কিংবা নিশীথের ভীষণ থেকে বদান্য দিন পর্যন্ত, শব্দে জেগে ওঠে উষ্ণতা, শব্দে চঞ্চল হয় সর্বজীব, শব্দে লিপ্ত হয় মানুষেরা। সেজন্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রাথমিক নায়কেরা নিঃসঙ্গ, ভাবনায় তারা সচেষ্ট, অনুসন্ধানে সুখি, তাদের খোঁজের লক্ষ্য : নিজেদের মানস, শব্দ দিয়ে সেই মানসে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যের টানে তারা আবেগে উত্তাল, বারবার ভেঙে যায় সাংসারিক বাস্তব, শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা যায়, সেজন্য তথ্য অকিঞ্চিৎকর, তারা মেলাতে চায় বিভিন্ন প্রতিষঙ্গ, সেজন্য শব্দ দিয়ে তারা ঘুরে-ঘুরে তাকায় নিজেদেরই দিকে। এভাবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যে এক ধরনের চরিত্র তৈরি করতে চেয়েছেন : শব্দ দিয়ে নড়ানো যায় কি দেহের কিংবা সমাজের ভিত? শেষ পর্যন্ত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অন্তিম চরিত্ররা হয়ে ওঠে বাকপ্রেমিক, শব্দেরই কারিগর; কারণ একটাই : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নায়কদের মধ্যে দিয়ে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছেছেন। শব্দ প্রেম আসলে ভাষারই প্রেম, আর ভাষা চর্চা তাঁকে ভাষার মূলে নিয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে সংস্কৃত আর সংস্কৃতের সঙ্গে জড়িত ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য। তিনি শুরু করেছেন নিঃসঙ্গ আবেগ নিয়ে, সেজন্য প্রাথমিকভাবে তাঁর শব্দ উত্তাল কিংবা অস্থির, উজ্জ্বল ও বিচ্ছুরিত, কিন্তু অন্তিমে, গন্তব্যে পৌঁছে তিনি ঘন আর সংহত, তিনি নিজের মধ্যে সংহার করেছেন তাঁর আবেগের উত্তালতা, সংবরণ করেছেন উচ্ছ্বাসের অমিতাচার, বদলে লাভ করেছেন ভাষার সংহতি আর বেগ, দূরস্পর্শী ইঙ্গিত আর রীতির ঘনত্ব, সেজন্য শেষ পর্যায়ে তাঁর নায়কেরা কিংবা তিনি শব্দকে ভাষার মধ্যে শৃঙ্খলায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর, ঐতিহ্যের খোঁজে বর্ধিত বেগ, এভাবেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী শব্দের গন্তব্যে পৌঁছে ভাষার উৎসে নিজেকে নিয়ে গেছেন।
প্রথম দিকে তিনি কবিতায় ও গদ্যে মানবিক ও নৈসর্গিক পরিবেশের মধ্যে নিবিষ্ট ও দ্বন্দ্বময়, ঐ নিবিষ্টতা উৎপন্ন করেছে আবেগ, ঐ দ্বন্দ্ব উৎপন্ন করেছে উত্তালতা, আবেগের চাপে তাঁর শব্দে এসেছে বর্ণনার ইন্দ্রচ্ছটা, দ্বন্দ্বের অভিঘাতে তাঁর শব্দে এসেছে আন্দোলনের বৈচিত্র; তিনি কবিতায়, গদ্যে শব্দের পর শব্দের মূর্ছনা তুলেছেন, শব্দে ফেটে পড়েছে প্রকৃতি, নিসর্গ, ব্যক্তি, ঘটনা; শব্দ সাপের সশব্দ জিভের মতন জ¦লেছে পাতার পর পাতা জুড়ে কিংবা রৌদ্রের সাঁকোর মতন মাতাল করেছে আমাদের, পারাপার করিয়েছে সংসারের বাস্তব থেকে শব্দের উজ্জ্বল আলোকে : শব্দ জ¦লছে, শব্দের সুখি গোঙ্গানী শোনা যাচ্ছে, শব্দের তৃপ্ত নিশ^াস বেড়ে-বেড়ে ভেঙে দিচ্ছে দিন যাপনের দেয়াল, শব্দ টাগরায় ঢেলে আমরা পান করেছি কবিতা আর গদ্য, শেষ পর্যন্ত সবই শিকল ছেঁড়া ভাষা। কিন্তু, তিনিই শেষবেলা, যখন তাঁর কবিতা ঘন আর গদ্যের, নাটকের কুশীলবেরা ভাষা থেকে এক-একটি শব্দের প্রতিশব্দ সরিয়ে দিচ্ছে, শব্দ করে তুলছে নিরপেক্ষ তখন তিনি তাঁর কবিতায়/নাটকে/গদ্যে/শব্দের ধাক্কায় আর ফেটে যান না, সটান দাঁড়িয়ে শব্দের ভাঁজ খুলতে থাকেন, আবিষ্কার করেন শব্দের মধ্যে সংহত গুপ্ত সংযোগ, সাদৃশ্য, দূর উল্লেখ, শব্দকে করে তোলেন উপায়, তাঁর নিজের বার্তা: এভাবেই তিনি পৌঁছে যান বাঙালির ঐতিহ্যে।
গাফ্ফার চৌধুরী নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদে বিশ^াসী। তাঁর অভিজ্ঞতা সংগ্রহের ধরণ একান্তভাবে ব্যক্তিক, জগৎ-সংসার সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও তাঁর কবি কল্পনার মধ্যে একটা ফারাক আছে, কোনো সাঁকো নেই দুইয়ের মধ্যে, সেজন্য গাফ্ফর চৌধুরীরবের পারাপার নেই বিষয় বিশে^র সঙ্গে ব্যক্তিক বিষয়ীর, তাই তাঁর বিচ্ছিন্নতাবোধে তাঁর অভিজ্ঞতার শুদ্ধি ঘটায় না, তিনি নিজেকে কখনো ছাড়তে পারেন না। তাঁর নিজের প্রতি ভালবাসা তীব্র, জ¦লন্ত, প্রখর, সেজন্য তাঁর রচনায় বিস্ময়কর নাটকীয়তা ও নৈপুণ্য জ¦লজ¦ল করে, কিন্তু তাঁর আত্মপ্রেম, লাভ, আসক্তি তাঁর শিল্প জিজ্ঞাসার চৈতন্যের শুদ্ধতা তৈরি করে না, তিনি থেকে যান অতুলনীয় কুশলী হিসাবে, তাঁর শিল্পের নন্দনতত্ত্ব চমকের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়, সমগ্র জীবনের বদলে মুহূর্তের সন্ধানে তিনি পশ্চিমী সাহিত্যের বিভিন্ন ঝোঁকে তাল মেলাতে থাকেন, এভাবেই তাঁর কাজে এসে যায় ব্যক্তিগত ঝোঁকের প্রবলতা, সেজন্য তাঁর মনোভঙ্গি থেকে আমাদের চমকিত করে, আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাই, তাঁর ভাষা আমাদের দখল করে, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতার বয়স বাড়ে না কারণ হয়তো তাঁর ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, তাঁর অভিজ্ঞতার ব্যক্তিক প্রাধান্য, তাঁর নন্দনতত্ত্বের আত্মসর্বস্বতা। অথচ গাফ্ফার চৌধুরী ভাষা, শব্দ ক্ষেত্রে নির্লোভ হতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত, ভাষা জিজ্ঞাসায় উপলব্ধি করেছেন ভাষায় চিত্তশুদ্ধতা দরকার, তাই আবেগ উচ্ছ্বাস ছেড়ে- ছেড়ে শব্দকে ঘন, গভীর, শানিত করে তুলেছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তিনি নির্লোভ হতে পারেননি, সেজন্য বিষয়বিশে^র কাছে ব্যক্তিবিষয়ীর আত্মবিসর্জন তাঁর ক্ষেত্রে ঘটে না, তাঁর অভিজ্ঞতার আধ্যাত্মপ্রকাশ শেষ পর্যন্ত থেকে যায় একান্ত ব্যক্তিক, তাঁর জ্ঞান ও কল্পনার মধ্যে, তাঁর আবেগ ও শিল্প জিজ্ঞাসার মধ্যে থেকে যায় বরাবর এক পাঁচিল : উল্লঙ্ঘনের চেষ্টা গাফ্ফর চৌধুরীরবে নেই। আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও অসাধারণ রূপদক্ষতা তাঁর প্রতিভাকে চিহ্নিত করে, তিনি খুঁজে ফিরেছেন মৌল ভিন্নতা : জড় ও চৈতন্যের, নরনারী সম্বন্ধের; ঐ মৌল ভিন্নতাকে তিনি কল্পনার আবেগে, তীব্র বোধশক্তিতে, প্রখর উপলব্ধিতে তাঁর সাহিত্যকর্মে মেলে ধরেছেন, গাফ্ফর চৌধুরীরবের জীবনে এভাবেই সাহিত্য আশ্রয় পেয়েছে।
০২
মনীষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা স্বচ্ছ, একাগ্র, স্থির। এই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সরে যাননি। এখানেই তাঁর চারিত্রিক সততা। খুব সম্ভব এখন কেউ সৎ হতে চায় না, চায় সফল হতে। গাফ্ফার চৌধুরী এ ক্ষেত্রে ভিন্ন, হয় তো সবার চেয়ে ভিন্ন। গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম থেকেই তাঁর কাজের ভিতর মগ্ন, তাঁর আশার ভিতর অবিচল। তাঁর কাজ এবং তাঁর আশাকে মৃত্যু ও নোংরামি ঘিরে ধরতে পারেনি। মৃত্যুর ভয় ও আরাম আয়েসের লোভ তাঁকে আপোসের দিকে ঠেলে দেয়নি। তাঁর আশা বাংলাদেশ কোনো একদিন সৎ হবে। নিয়তি তাঁর হাত ধরে এই দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করেছে, বাংলাদেশের প্রতি অবিচল থাকার দায়িত্ব। তাঁর নিয়তি, তাঁর কাজ, তাঁর চিন্তা, তাঁর সংস্কৃতির ভিত্তি এখানেই, তিনি যেখানেই থাকুন বাংলাদেশের চিন্তা থেকে দূরে সরে যেতে পারেন না। গাফ্ফার চৌধুরী তার চারপাশ থেকেই একটার পর একটা দেয়াল ভেঙে চলেছেন : তাঁর চেষ্টা ছত্রখান জীবনকে ঐক্যবদ্ধ করা। কখনো মনে হয় গাফ্ফার চৌধুরীর চারপাশে অনেক লোক, কখনো মনে হয় গাফ্ফার চৌধুরী একেবারেই একা। তার কারণ তিনি নিজের মতো জীবনকে দেখেন এবং বোঝার চেষ্টা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দেখা এবং বোঝা অনেকের সঙ্গে মেলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে মেলে না। তিনি দুঃসাহসী ও নিঃসঙ্গ, তিনি সাহসী ও সবার সঙ্গে লগ্ন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভিসিডি : পলাশী থেকে ধানম-ি দেখতে দেখতে আমার মনে এসব কথাই জেগেছে। গাফ্ফার চৌধুরীর ইতিহাসের কল্পনা ব্যবহার করেছেন বাস্তব বাংলাদেশের আখ্যান ও ঘটনা বোঝার জন্য। তাঁর কাছে বাংলার অর্থ হচ্ছে : স্বাধীনতা ও স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের ইতিহাস। স্বাধীনতার পক্ষে অবিরাম লড়াই করেছেন নবাবী বাংলার সিরাজউদ্দৌলা থেকে কলোনি ও কলোনিউত্তর বাংলার বঙ্গবন্ধু। তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন সেনাপতিরা : মীর জাফর থেকে মীর কাশিমরা, ব্যবসায়ীরা : উর্মিচাদরা বিদেশী বাণিজ্যিক স্বার্থের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টরা : ক্লাইভরা; তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিকরা ; খন্দকার মোশতাকরা; সেনাপতিরা : জিয়াউর রহমানরা, ব্যবসায়ী-আমলারা : মাহবুব আলম চাষীরা, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা : মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টাররা। এভাবেই নবাবী বাংলার স্বাধীনতার লড়াই মিলে যায় বর্তমান বাংলার স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্যে। স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্রকারীরা : স্বাধীনতার পক্ষে আছেন সিরাজউদ্দৌলা ও দেশের সাধারণ
মানুষ, স্বাধীনতার পক্ষে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও দেশের সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতার বিপক্ষে আছে সর্বত্র ষড়যন্ত্রকারীরা : রাজনীতিক-সেনাপতিরা : মীর জাফর, মীর কাশিমরা, জিয়াউর রহমানরা, মন্ত্রী, কূটনীতিকরা : মীর জাফররা, মোশতাকরা, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিনিধিরা : ক্লাইভরা, বোস্টাররা। সেজন্য দায়বদ্ধহীন কূটনীতিক, সেনাপতি, ব্যবসায়ী, আমলা এবং বিদেশী শক্তির সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধিদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, এরা দায়বদ্ধহীন ষড়যন্ত্রকারী, এরা ক্ষমতা বাদে কোনো কিছু বোঝে না।
মীর জাফর থেকে মীর কাশিম থেকে জিয়াউর রহমান থেকে খন্দকার মোশতাক পর্যন্ত সবাই ক্ষমতার জন্য সবকিছু করতে পারে। আত্মবিক্রয়কারী, ক্ষমতালোভী মানুষরা সবকিছু করতে পারে : ষড়যন্ত্র থেকে হত্যা পর্যন্ত, যার শুরু ষড়যন্ত্র থেকে তার শেষ রক্তাক্ত হত্যায়। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর সত্যকে উন্মোচিত করেছেন গাফ্ফার চৌধুরী, সিরাজউদ্দৌলা-বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়ে। এভাবেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা তৈরি হয়: সিরাজউদ্দৌলা মিশে যান বঙ্গবন্ধুর মধ্যে; মীর জাফর মিলে যায় খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমানের মধ্যে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আরেকটি সত্য উন্মোচিত করেন : যাদের হাতে তরবারি আছে, যাদের হাতে বন্দুক আছে তাদের বিশ্বাস করতে নেই, সশস্ত্র ব্যক্তি সবকিছু করতে পারে। যেমন আমেরিকানরা করছে ইরাকে, ইজরায়েলিয়া করছে ফিলিস্তিনে, যেমন কৃষকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নিম্নআয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ-র্যাব- গোয়েন্দাদের পার্টি কাতারদের। ষড়যন্ত্রকারীদের কবর কোথায় মুর্শিদাবাদের মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়, ষড়যন্ত্রকারীদের কবর কোথায়-ঢাকার মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। এসব কবর ইতিহাসের এক ধারাবাহিকতা, ধিক্কারের ধারাবাহিকতা, এসব কবরে শুয়ে আছে অপরাধীরা।
গাফ্ফার চৌধুরী এই কাজটাই করেছেন। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে, কোনো অপরাধের মাপ নেই। তারা অভিশপ্ত। গাফ্ফার চৌধুরী অভিশপ্তদের নিয়ে নাটক লিখেছেন স্বাধীনতার এক সুদীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য, যেখানে তাদের মাথায় মাথায় সিরাজের নৌকা বয়ে যায়, যেখানে নৌকার ভিতরে লণ্ঠনের আলো ফেলে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতের দিকে বয়ে যায়, মানুষ জাগে, সর্বত্র জাগে, সবসময় জাগে, তারা সঙ্গীত রচনা করে স্বাধীনতার। গাফ্ফার চৌধুরীর এই কাজটি নাটক ও যাত্রার কোলাহল, সিনেমা ও। টেলিভিশনের মধ্যবর্তী অংশ : শিল্পের একটা দিক তিনি তুলে ধরেছেন। একটা রাস্তা তিনি তুলে ধরেছেন : স্বল্প বাজেটের ভিতরে কি করে নাটকের সঙ্গে যাত্রার, সিনেমার সঙ্গে টেলিভিশনের মেলবন্ধন করা যায়। আবার এখানে তিনি একত্র করেছেন কবিতা, ইতিহাস, কল্পনাকে, এক সঙ্গে, তিনি এই যুক্ততার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেছেন মানুষ নামক সন্তকে এবং মানুষ নামক জানোয়ারকে। এই অবস্থান থেকে আমরা কতদূর যেতে পেরেছি? আমরা এবং আমরা।
নবাবী বাংলার ষড়যন্ত্রকারী, মীর জাফর-জগৎ শেঠরা স্বাধীন বাংলাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ব্রিটিশ বাংলায় পর্যবসিত করে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর বাংলার ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমানরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ইতিহাসের অন্তর্গত মুসলিম বাংলায় পর্যবসিত করে। গাফ্ফার চৌধুরীর নাটকে ইতিহাস উৎসারিত কল্পনার বিস্তার এভাবেই ঘটেছে। এ শুধু ব্যক্তিকে হত্যা নয়, স্বাধীনতাকে হত্যা, মানবিকতাকে লক্রঘন : এ দুই হত্যার মধ্যে টেররিস্টিক দূরস্পর্শিতা রয়েছে, গাফ্ফার চৌধুরী আমাদের বুঝিয়ে দেন। সে জন্য অতীত ও বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়। আমরা ইতিহাসের মধ্যে হাঁটতে থাকি নিজেদের মুক্তির জন্য। মুক্তি আমাদের লক্ষ্য, মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকার, সে অধিকার অর্জন বাদে ইতিহাসের এই দুই হত্যার বীভৎসতা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়।
হে মহামতি, যে যাই বলুক, রাশি রাশি লেখকবিস্তৃত হবে ভাবীকালে, অথচ আপনার নাম নিশ্চিত ঘুরবেগুণীজন আর জনতার মুখে যুগে যুগে।এই সত্য উজ্জ্বল আপনার কাছে,বুঝি তাই আপনি প্রায়শই চালান কলমসাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে।ক্রান্তদর্শী, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মৃতিপটেরাখবে সাজিয়ে ভালোবেসে,শ্রদ্ধাভরে আপনার অক্ষয় নাম,গাইবে আপনার গান যুগযুগান্তর-“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি?”