
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ বিষয়ক পরিচালক হ্যালস ক্লাগ গত রোববার (২৩.০১.২২) এক সাক্ষাতকারে বলেন, আগামী মার্চের মধ্যে ইউরোপে ৬০ ভাগ মানষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হতে পারে। আপাত: দৃষ্টে মনে হচ্ছে ইউরোপ মহামারির শেষের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইউরোপে ওমিক্রনের সংক্রমণ কমে গেলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ও বেশ কয়েক মাস ধরে বিশ^ব্যাপী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট থাকবে। টিকা নেয়া ও রোগ সংক্রমণের কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। ক্লাগের মতে এবারের শেষের দিকে করোনার সংক্রমণ হয়ত আবার ফিরে আসতে পারে তবে তার আগের সময়কালে করোনার প্রভাব খুব বেশি থাকবে না। ঐদিন যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসিও একই রকম সম্ভাবনার কথা বলেছেন। এবিসি নিউজের এক টকশোতে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে করোনার সংক্রমন কমে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বে সংক্রমণের হার এভাবে কমতে থাকলে মহামারি পরিস্থিতিতে অনেক পারিবর্তন আসবে। আফ্রিকায় বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয় বলছে, ওমিক্রনের চতুর্থ ঢেউ শুরুর পর গত সপ্তাহে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার প্রথমবারের মত কমেছে। গবেষণা বলছে, ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রনে গুরুতর অসুস্থতা কম। বিশেষ করে যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের অসুস্থতা কম থাকে। আশা করা হচ্ছে করোনা ভাইরাস মহামারি থেকে সাধারণ মৌসুমী জ¦রে রূপ নিতে পারে।
১৭ থেকে ২৩ শে জানুয়ারি এই এক সপ্তাহ দেশে করোনা সনাক্ত হয়েছে ৬৭ হাজার ৪২৫ জন। করোনার মৃত্যু হয়েছে ৭৯ জনের। এর আগের সপ্তাহে (১০-১৬ জানুয়ারি) রোগী সনাক্ত হয়েছিল ২৪ হাজার ১১ জন। ঐ সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছিল ৪২ জনের। সেই অনুযায়ী রোগী বেড়েছে ১৮০.৮০ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে ৮৮.১০ শতাংশ। এখন করোনায় যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের একটা বৃহৎ অংশ টিকা না নেয়া মানুষ। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত এক সপ্তাহে মারা যাওয়া ৭৯ জনের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ২৮ জন। এবং এ ২৮ জনের ৬ জন নিয়েছেন শুধু প্রথম ডোজ এবং ২২ জন নিয়েছেন দুই ডোজ। ৬ জানু’২২এ ও পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নীচে। শনাক্ত ১০ শতাংশ ছাড়ায় ১২ই জানু’২২। আর গত ২৪ জানু’২২ রোগী শনাক্তের হার ছিল ৩২.৩৭ শতাংশ। দুই সপ্তাহের বেশী সময় ধরে এ হার ৫ শতাংশের নীচে থাকলে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলা যায়। সে হিসেবে এখন দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ভাইরাস সামলাতে সরকার হোটেল রেস্তোরাঁয় টিকার সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের কাছে খাবার বিক্রি হচ্ছে টিকার সনদ না দেখে। রাজধানীসহ সকল শহরেই হোটেল রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধির বালাই নাই। গাদাগাদি করে বসে এসব রেস্তোরাঁয় খাবার খাচ্ছে মানুষ। হোটেল, রেস্তোরাঁ মালিকরা বলছে দেশের সব মানুষ এখনো টিকা পায়নি, তাই সরকারি নির্দেশনা পালন করা যাচ্ছে না। আবার অনেকেই এই নির্দেশনা সম্পর্কে জানেনই না। হোটেল মালিকরা জানান দেশে এ খাতে ৩০ লাখেরও বেশি শ্রমিক রয়েছে যাদের ৩০ শতাংশ এখনও টিকা দিতে পারেনি। ফলে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব শ্রমিকের অনেকের জন্মসনদ নাই, অনেকের জাতিয় পরিচয়পত্র নাই, যার জন্য তারা টিকার নিবন্ধন করতে পারছেন না। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, টিকার সনদ দেখে সেবা দানের নির্দেশনা সঠিক হয়নি তারপরও মেনে চলার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, হোটেলে খাবার খেতে এলে অনেকেই পরিবার বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসেন। এক পরিবারের পাঁচজন সদস্য আসলে দেখা যাবে দুজন টিকা নেননি। তখনতো ঐ কাস্টমারকে সেবা না দিয়ে বের করে দেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের সামনে সাধারণত ছোট ছোট হোটেল থেকে তিন বেলা দুর দুরান্ত হতে আসা রোগীর আত্মীয় স্বজনরা খায় এমন কি রোগীর খাবারও যায় এ সকল হোটেল থেকে। সেখানকার হোটেল মালিক ও কর্মচারীর টিকার সনদ দেখে খাবার পরিবেশনত দুরের কথা, নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। দেদারছে বিয়ে সাদি ও অন্যান্য অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে। পরিবহন সেক্টরে কেহই মানছেন না বিধি। মেলায় সমাগম হচ্ছে হাজার হাজার জনতা। পর্যটনকেন্দ্রসমূহে উপচে পড়ছে অঢেল জনতা। স্বাস্থ্যবিধি মানার নামে এরকম নৈরাজ্য তাৎক্ষনিক বন্ধ করা জাতীয় জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় দেখা যায় জিনোম সিকোয়েন্সে ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের তিনটি সাব টাইপ রয়েছে। এগুলো আফ্রিকান, ইউরোপ-আমেরিকান এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ওমিক্রন ধরনের সঙ্গে মিলে যায়। আইসিডিডিআরবি বলেছে জানু’২২ এর প্রথম দুসপ্তাহে তাদের ল্যাবে ১,৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৮ শতাংশই ছিল করোনায় আক্রান্ত। আর আক্রান্তদের মাঝে ওমিক্রন ছিল ৬৯ শতাংশের দেহে। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে ৬ই ডিসেম্বর’২১ ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় তবে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে ১১ই ডিসেম্বর’২১ । ঐ মাসেই আইসিডিডিআরবি’র ল্যাবে পরীক্ষা করা ঢাকা শহরের ৭৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে পাঁচটিতে ওমিক্রন শনাক্ত হয। অন্যগুলো ছিল ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। ওমিক্রনে ২৯ জনের সাক্ষাতকারও নিয়েছে এ গবেষণা সংস্থা। এর মধ্যে পুরুষ ১৩ জন ও নারী ১৬ জন। ২৭ জনের কোন উপসর্গও ছিল না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় ২৪ জন টিকার ২য় ডোজ নিয়েছেন। আর প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৩ জন। ২৯ জনের মধ্যে মাত্র ১ জনকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। করোনার এই ধরনে আক্রান্ত একজন সৌদি আরব থেকে ফেরা। বাকিরা দেশেই ছিলেন। দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ফের উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। শুরু হয়েছে তৃতীয় ঢেউ। করোনা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে অধিদপ্তর থেকে বলা হয়, দেশে করোনা সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা ৮০ শতাংশই করোনা পজিটিভ আসছে। ধারনা করা হচ্ছে এদের বেশিরভাগই নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্ত। অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমন ঘটেছে, ধীরে ধীরে ডেল্টার জায়গা দখল করে ফেলেছে ওমিক্রন। তিনি জানান, ৭৩ শতাংশ মানুষের নাক দিয়ে পানি ঝরছে। ৬৮ শতাংশের মাথাব্যাথা। ৬৪ শতাংশ অবসরক্লান্তি অনুভব করছেন। ৭ শতাংশ রোগী হাঁচি দিচ্ছেন। গলা ব্যাথা হচ্ছে ৭ শতাংশ রোগীর। ৪০ শতাংশ রোগীর কাশি হচ্ছে। নাজমুল ইসলাম বলেন, এখন সিজনেল যে ফ্লু হচ্ছে তার সাথে ওমিক্রনের মিল রয়েছে। তাই এখন থেকে আরও সতর্ক হতে হবে। ওমিক্রন রোধে কিছু সুপারিশ রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরমধ্যে রয়েছে:-
১. টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়ানো
২. স্বাস্থ্যবিধি মানার উপর জোর দেয়া
৩. সঠিক নিয়মে মাক্স পরা
৪. শারিরীক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা ও ঘন ঘন সাবান পানিতে হাত ধৌঁত করা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ