রেজানুর রহমান ||
জানি না করোনা ও ওমিক্রন নিয়ে আমরা কিছুটা তামাশা করছি না। করোনার পাশাপাশি ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে। টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেকেই বিষয়টা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং স্বাস্থ্যবিধি না মানার তীব্র প্রতিযোগিতাই স্পষ্ট। দেশের শহর, বন্দর, গ্রামে যেখানেই তাকাবেন জনসমাবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই দেশে করোনার আতঙ্ক রয়েছে। মেলা হচ্ছে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি উধাও।
কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। নির্বাচনি মিছিল সমাবেশ হচ্ছে, সেখানেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। সরকার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যেতে হলে করোনার টিকা নিতে হবে। রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলের সামনে করোনার টিকা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ছবি দেখে একটা প্রশ্নই মনে হলো– এই যে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা জনসমাবেশে দাঁড়িয়েছে, তারা কি টিকা নেওয়ার আগে শঙ্কামুক্ত থাকবে। দেশে চলছে ইউপি নির্বাচন। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার লক্ষণ নেই। অথচ ভোটের সভা, সমাবেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে একটা কাজের কাজ হতো। নিদেনপক্ষে সবার মুখে মাস্ক তুলে দেওয়ার নিয়ম চালু করা গেলে মাস্ক পরার ক্ষেত্রে একটা সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে যেতো।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদিন কথার লড়াই চলছে। প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনার জন্য বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কারও মিছিলেই অংশগ্রহণকারী ভোটারদের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। অথচ পরিস্থিতি বিবেচনায় মিছিল সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের জন্য মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল। আজকাল তো সামান্য ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অতিদ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। কাজেই দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যখন নীতিনির্ধারণী কথা বলেন, জনগণকে সচেতন হবার আহ্বান জানান, তখন নিজেদেরও উচিত নিয়মনীতি মেনে চলা। একজন মন্ত্রী একটি সভায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। অথচ তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন ভিড়ের মাঝে। এই যে তিনি ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে করোনা ও ওমিক্রন থেকে বাঁচতে ভিড় এড়ানোর পরামর্শ দিলেন, এতে কি কাজের কাজ কিছু হবে?
একটা ছোট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। ’৮০ দশকে দেশে বিনোদনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল সিনেমা। আমরা দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। স্থানীয় মসজিদের সম্মানিত ইমাম সিনেমা না দেখার ব্যাপারে আমাদের অনেক বোঝাতেন। সিনেমা দেখা শরিয়ত পরিপস্থি কাজ। কাজেই সিনেমা দেখা উচিত নয়। তখনকার দিনে দেশের প্রতিটি সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো, ইভিনিং শো ও নাইট শো’র আওতায় প্রতিদিন সিনেমা প্রদর্শিত হতো। একদিন আমরা বন্ধুরা মিলে নাইট শোয়ের সিনেমা দেখে হল থেকে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে সম্মানিত হুজুর আমাদের মতোই সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের এক বন্ধু হুজুরকে দেখে প্রশ্ন করলো– হুজুর আপনি সিনেমা দেখলেন? সিনেমা দেখা না গুনাহর কাজ? হুজুর দ্রুত যেতে যেতে বলেছিলেন, আমি যা বলি তা-ই করো। কিন্তু আমি যা করি তার সবকিছু মানতে যেও না...।
মাননীয় মন্ত্রীর ছবি দেখে পুরনো কথাই মনে পড়ে গেলো। ভিড় এড়িয়ে চলুন বলার সময় তাঁর কি উচিত ছিল না নিজের ভিড় এড়িয়ে চলা? আমরা কী অনেকে তাহলে কথার কথা বলি। কথা বলতে হয় বলে বলি? কিন্তু দায়িত্ববানদের উচিত কথা বলার সময় বুঝে শুনে কথা বলা।
এ কথা সত্য, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে কোনও কিছুই এখন আর বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু করোনা সতর্কতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে কেনই বা এত অনীহা? শহরে যদিও কিছু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। কিন্তু গ্রামে করোনা নিয়ে তেমন কোনও আতঙ্ক চোখে পড়ে না। বরং শহরের মাস্ক পরা মানুষ দেখলে গ্রামের অনেক মানুষ যারপরনাই অবাক হয়। অনেকে গর্ব করে বলে, গ্রামে করোনা নাই। মাস্ক খোলেন... এই যে গ্রামের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, এর কারণে পাছে না হিতে বিপরীত হয়ে যায়। গ্রামের সেই রাখাল বালকের কথা মনে পড়ে গেলো। বাঘ এলো, বাঘ এলো বলে সে বারবার গ্রামের মানুষকে প্রতারিত করেছে। যখন সত্যিকার অর্থে গ্রামে বাঘ আসে তখন আর তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এ কথা সত্য, গ্রামে এখন পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হয়ে ওঠেনি। কিন্তু হতে কতক্ষণ? তাই আগাম সতর্কতা জরুরি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী তো বটেই, এলাকার সম্মানিত স্কুলশিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ, মসজিদের সম্মানিত ইমামগণ, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন বলে মনে করি।
আবারও বলি, দেশে করোনার সংক্রমণ বেশ ঊর্ধ্বমুখী। কাজেই নির্ভার হওয়ার কোনও সুযোগ নাই। স্বাস্থ্যবিধি মানুন। ভিড় এড়িয়ে চলুন। মাস্ক পরে বাইরে যাবেন। যত দ্রুত সম্ভব করোনার টিকা গ্রহণ করুন।
শুভ কামনা সবার জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো