
বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ পাকিস্তানীদের পরাজিত করে সর্বত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধারা
ওড়াচ্ছে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। বাংলার ঘরে ঘরে উড়ছে বিজয় নিশান। ১৯৭১-এর
ডিসেম্বর। সে এক উন্মাদনার সময়। বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দোসর
আলবদর-রাজাকাররা শেষ আঘাত হানছে। হত্যা ও ধ্বংসের বিভীষিুকার তা-ব চালাচ্ছে
ওরা। কিন্তু সব পায়ে দলে এক নদী রক্ত পেরিয়ে বিজয় পতাকা উড়লো বাংলাদেশের
আকাশে। ফিরে দেখা যাক বিজয়ের সেই মুহূর্তগুলো।
চূড়ান্ত বিজয়ের
দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের অধিকাংশ জেলা শত্রুমুক্ত।
প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে পাক-হানাদার ও স্বাধীনতার শত্রু রাজাকার-আলবদর,
শান্তি কমিটির সদস্যরা। অকুতোভয় মিত্রবাহিনী সদর্পে চারিদিক ঘেরাও করে
ঢাকার সন্নিকটে চলে এসেছে। ঢাকায় পরিকল্পিত চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে শত্রুদের
আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
ডিসেম্বরের এ দিন
মিত্রবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ করে দিল,
বোমা-রকেট ছুড়ে বিধ্বস্ত করে দিল ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। পরাজয়
নিশ্চিত, তবুও আত্মসমর্পণের আগে বাঙালীর নিশ্চিত স্বাধীনতা কেড়ে নিতে তখনও
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিধ্বস্ত পাক
শাসকরা।
একাত্তরের এ দিন ৫৭ নম্বর ডিভিশন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল
মিত্রবাহিনী কিভাবে রাজধানী ঢাকার মুক্তিযুদ্ধে নদীর বাধা অতিক্রম করে। ভোর
রাত থেকে ভৈরববাজারের ৩/৪ মাইল দক্ষিণে হেলিকপ্টার করে নামানো হলো ৫৭নং
ডিভিশনের সৈন্য। সারাদিন ধরে মেঘনা অতিক্রমের সেই অভিযান চলে। প্রথম
বাহিনীটা ওপারে নেমেই ঘাঁটি গেড়ে বসল। কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই তখন
পাকিস্তানী সৈন্যদের বড় একটা মজুদ। ব্রিজটার একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে নদীর
পশ্চিম পারে ওঁৎ পেতে বসে থাকে হানাদাররা।
আকাশে সূর্য উঠতেই তারা দেখতে
পেল হেলিকপ্টার। নদীর পার হচ্ছে, কিন্তু দেখেও তারা ঘাঁটি ছাড়তে সাহস পেল
না। ভাবল ওটা বোধহয় মিত্রবাহিনীর একটি ধাপ্পা। ওদিকে ছুটে গেলেই আশুগঞ্জ
থেকে মূল মিত্রবাহিনীটা ভৈরবজার-ঢাকার রাস্তা ধরবে। সত্যিই কিন্তু
পাকিস্তানী বাহিনীকে ভুল বোঝানোর জন্য মিত্রবাহিনী একটা বড় সারি তখন এমন
ভাবসাব দেখাচ্ছিল যে, তারা আশুগঞ্জ দিয়েই মেঘনা পার হবে। পাকিস্তানী বাহিনী
এভাবে ভুল বোঝায় মিত্রবাহিনীর সুবিধা হলো এক রকম বিনা বাধায় মেঘনা পাওয়া
গেল। হেলিকপ্টারে পার হলো কিছু সৈন্য। অনেকে আবার পার হলো স্টিমার ও লঞ্চে
করে। কিছু পার হলো দেশী নৌকাতে করে। ট্যাংকগুলো নিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা
দিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু সেই সমস্যাও দূর হলো এক অভাবনীয় উপায়ে। রাশিয়ান
ট্যাংক সাঁতরাতে পারে ঠিকই, কিন্তু একনাগাড়ে আধা ঘণ্টার বেশি সাঁতরালেই
ট্যাংক গরম হয়ে যায়। অথচ মেঘনা পার হতে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। তখন
ঠিক হলো ট্যাংকগুলো যতটা সম্ভব নিজেরাই সাঁতরে এগুবে। এরপর নৌকাতে দড়ি
বেঁধে ট্যাংকগুলো টেনে নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু এতে স্থানীয়
মানুষের সাহায্য লাগবে।
মিত্রবাহিনী অবাক হয়ে দেখল, বাংলাদেশের কিছু
রাজাকার ছাড়া সব মানুষই স্বাধীনতা চায়। সাহায্য চাওয়ামাত্রই ছুটে আসল
হাজারও সাধারণ মানুষ। শত শত নৌকা নিয়ে এলো তারা। সে সব নৌকা বারবার মেঘনা
পারাপার করল। বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছেছিল ভৈরববাজার-ঢাকার
মূল সড়কে এবং পর দিনই তারা রায়পুরা দখল করে নিল। ওদিকে তখন উত্তরের
বাহিনীটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। ময়মনসিংহের কাছে তারা দাঁড়াল।
খবর ছিল যে,
ময়মনসিংহে পাকিস্তানী বাহিনীর একটা ব্রিগেড রয়েছে, কিন্তু সে ব্রিগেডকে
অনেক আগেই যে ভৈরববাজারের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে- তা মিত্রবাহিনী জানত না।
তাই মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহে বড় লড়াই করার জন্য সে দিনটা ব্রহ্মপুত্র নদের
ওপারে শম্ভুগঞ্জে অপেক্ষা করল।
অন্যদিকে, ভারতীয় বিমান আর নৌবাহিনীও সে
দিন পাকিস্তানী বাহিনীকে আরও ভয় পাইয়ে দিল। বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো
ঢাকা বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ করে দিল। কুর্মিটলার ওপর বারবার রকেট আর বোমা
ছুড়ল। নৌবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনার অবস্থাও অত্যন্ত কাহিল।
কয়েকটি স্টিমার ভর্তি হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালাতে
গিয়েছিল। একটা জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়েও কিছু পাকিস্তানী সেনা
সিঙ্গাপুরের দিকে যাচ্ছিল। সব ধরা পড়ল মুক্তিপাগল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের
হাতে।
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য। এটা বুঝতে
পেরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য বাঙালীকে
নেতৃত্বশূন্য করতে গোপণ ষড়যন্ত্র আঁটতে শুরু করে তারা। আর এ পরিকল্পনার
প্রধান নায়ক স্বাধীনতার প্রধান শত্রু এ দেশীয় জামায়াতের
রাজাকার-আলবদর-আলশামস। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর এ সব একাত্তরের গণহত্যাকারী
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে অনেকটাই
কলঙ্কমুক্ত করছে বর্তমান সরকার।