মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ ||
সত্যবাদিতার
বিপরীত হচ্ছে মিথ্যাচার। মিথ্যা মানুষকে নিন্দিত করে এবং পাপের পথে
পরিচালিত করে। নিম্নে মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো-
মিথ্যা
হিদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত করে : মিথ্যা মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল
সৃষ্টি করে। এই স্বভাবের কারণে সে ছিরাতে মুস্তাকিম থেকে ছিটকে পড়ে এবং
আল্লাহর হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা
লঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সুপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা : মুমিন/গাফের,
আয়াত : ২৮)
প্রশান্তি বিলুপ্ত ও সন্দেহ সৃষ্টি করে : মিথ্যা মানুষের মনে
সন্দেহ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মিথ্যাবাদীর অন্তরে সর্বদা অস্থিরতা বিরাজ
করে এবং এটি তার মানসিক প্রশান্তি বিদূরিত করে। রাসুল (সা.) বলেন, যে বিষয়ে
তোমার সন্দেহ হয় তা পরিত্যাগ করে যাতে সন্দেহ নেই, তা গ্রহণ করো। কেননা
সত্য হচ্ছে প্রশান্তি আর মিথ্যা হচ্ছে সন্দেহ। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৮)
রিজিক
ও বরকতে ঘাটতি সৃষ্টি করে : মিথ্যা এমন এক জঘন্য অপরাধ, যা মানুষকে পাপের
পথে পরিচালিত করে। মিথ্যা বলার মাধ্যমে মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হতে চেষ্টা
করে, কিন্তু এতে সে সাময়িক কিছু অর্জন করতে পারলেও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর
রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, মিথ্যা কসম পণ্যের কাটতি
বাড়ায়, কিন্তু বরকত কমিয়ে দেয়। (বুখারি, হাদিস : ২০৮৭)
মিথ্যা শপথকারী
আল্লাহর ক্রোধের পাত্র : মানুষ যেসব পাপের দ্বারা দুই জাহানে ক্ষতির অতল
তলে নিমজ্জিত হয়, তন্মধ্যে মিথ্যা শপথ অন্যতম। এটি কবিরা গুনাহ। এর মাধ্যমে
মানুষ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে এবং অন্যের ক্ষতি করতে তৎপর হয়। এসব
ব্যক্তিকে আল্লাহ পরকালে মুক্ত করবেন না। ফলে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির
শিকার হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির
সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যা শপথ করে, সে আল্লাহর
সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে আল্লাহ তার ওপর ক্রোধান্বিত থাকবেন।
(বুখারি, হাদিস : ৪৫৪৯)
মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনাকারীর শাস্তি : মানুষ
বিভিন্নভাবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তন্মধ্যে মিথ্যা স্বপ্ন
অন্যতম। উচ্চ মর্যাদা পেতে, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে, নিজেকে ডাক্তার,
কবিরাজ বা ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিংবা শত্রুকে ভীতচকিত করার
মানসে অনেকে মিথ্যা স্বপ্ন বলে বেড়ায়। অনেকেই তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত
হয়, অর্থ-সম্পদ ও ইজ্জত-সম্মান হারায়। এসব মিথ্যা স্বপ্ন যারা বলে বেড়ায়,
পরকালে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সবচেয়ে বড়
মনগড়া বা মিথ্যার মধ্যে রয়েছে ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে নিজ বাবা ছাড়া অন্যের
সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে, যে স্বপ্ন সে দেখেনি, তা দেখার দাবি করে এবং
রাসুলুল্লাহ (সা.) যা বলেননি তাঁর নামে তা বলে। (বুখারি, হাদিস : ৩৫০৯)
মিথ্যা
পাপ ও জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে : মিথ্যা মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের পথে
পরিচালিত করে। আর পাপ তাকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)
বলেন, ‘আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা মিথ্যা পাপাচারের পথ
বাতলিয়ে দেয়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা
মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহ তাআলার দরবারে তাকে
কাজ্জাব (চরম মিথ্যুক) বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম, হাদিস : ২৬০৭)
মিথ্যা
বলা মোনাফেকি : মিথ্যা বলা মোনাফেকির পরিচায়ক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
মোনাফেকির আলামত তিনটি। (১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে; (২) ওয়াদা করলে
ভঙ্গ করে এবং (৩) আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩)
মিথ্যাবাদীর
মর্মান্তিক শাস্তি : সামুরাহ বিন জুনদুব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)
সালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। একদিন তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে
আজ কেউ স্বপ্ন দেখেছ কি? কেননা আমাদের কেউ এরূপ স্বপ্ন দেখে থাকলে তা
বর্ণনা করত এবং তিনি আল্লাহ যা চাইতেন সে অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে দিতেন।
যথারীতি একদিন (ফজর সালাত শেষে) তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ আজ
কোনো স্বপ্ন দেখেছ কি? আমরা বললাম, না। তিনি বলেন, কিন্তু আমি দেখেছি যে
দুজন ব্যক্তি আমার কাছে এলো। অতঃপর তারা আমাকে পবিত্র ভূমির (শাম বা বায়তুল
মুকাদ্দাসের) দিকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে এবং
অপর ব্যক্তি একমুখ বাঁকানো ধারালো লোহার সাঁড়াশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ওই
বসা ব্যক্তির গালের এক পাশ দিয়ে ওটা ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পেছন পর্যন্ত চিরে
দিচ্ছে। অতঃপর গালের অপর পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পেছন পর্যন্ত চিরে
দিচ্ছে। এরই মধ্যে গালের প্রথমাংশটি ভালো হয়ে যায়। তখন আবার সে তা-ই করে
(এভাবে একবার এগাল, একবার ওগাল চিরতে থাকে)।...অতঃপর তারা আমাকে ব্যাখ্যা
বলে দিল যে যাকে সাঁড়াশি দিয়ে গাল চেরা হচ্ছিল সে হলো মিথ্যাবাদী। সে
মিথ্যা রটনা করত। এমনকি তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিত। ফলে তার সঙ্গে কিয়ামত
পর্যন্ত (কবরে) ওই ধরনের আচরণ করা হবে। (বুখারি, হাদিস : ১৩৮৬)