ইমরান মাহফুজ ||
একটি জাতিকে
জানতে হলে সেই জাতির অতীত জানা আবশ্যক। এর মধ্যেই থাকে সমাজ কাঠামো
বিশ্লেষণ, কালজয়ীদের অবদান, পুরনো মানুষের জীবন ও শেকড়ের গল্প। আর চিরায়ত
সত্য যে, সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজ নির্মাণ হয়। যে সমাজের অতীতে আমরা ছিলাম,
আছি বর্তমানে, কাজের মাধ্যমে থাকবে আগামীতে। মানবজীবনের ভিত্তি প্রাচীর
এমনই।
এর মধ্যে প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা সংস্কৃতি ইতিহাসই জাতীয় ইতিহাসের
অংশ। জাতীয় ইতিহাস জানতে আঞ্চলিক ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিহার্য। এটাই সামনে
আনেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও দৈনিক কুমিল্লার কাগজ (২০০৪ সাল থেকে
প্রকাশিত হচ্ছে) সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়। তিনি রচনা করেন মুক্তি সংগ্রামে
কুমিল্লা , জেলা ও সেক্টর-ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ বই অপারেশন কিল এন্ড বার্ন ,
কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু, কুমিল্লা সেনানিবাসের ইতিহাস' উল্লেখযোগ্য বই। তার
ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক গবেষণা সম্পাদনা আমাদের অসামান্য কিছু তথ্যের সাথে
পরিচয় করিয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় আত্নপরিচয়।
তার কাজ দেখে মনে হয়েছে
আঞ্চলিকতা বলতে আর কিছু (বাঁধা) নেই। চাইলে যে কেউ বড় কাজ করতে পারে। বাঁধা
হতে পারে না! দরকার উন্নত চিন্তা, কাজের মানসিকতা। সাংবাদিকতার বাহিরেও
সাহিত্য জানা এই সাংবাদিকের বিরচণ বহুমূখি। তিনি কাজ করেন প্রিন্ট মিডিয়ার
সাথে টেলিভিশন মিডিয়ায়। দেখেন চারপাশ। দেখে ঠেকে কথা বলেন। সমাজ ও মানুষের
সংকট দূর করার চেষ্টা করেন। কুমিল্লায় সেই সংকট কিছুটা পূরণ করতেছেন নিজের
মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে।
তাছাড়া চারপাশে যে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক,
রাজধানীকেন্দ্রিক, সরকারকেন্দ্রিক এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চরিত্র
গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের, মিডিয়ার, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার
পক্ষে তা সুখসংবাদ নয় অবশ্যই। তা একদিন ডেকে আনবে দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা। তবে
আমাদের ঢাকা, ঢাকার বাইরের সমস্যা অনেক- সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক;
এবং সবে মিলে একটি বৃহত্তর নৈতিক।
যদি আমাদের সংবাদমাধ্যমের কর্মপদ্ধতি
ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, ক্ষমতাসীনের সঙ্গে তাদের গড়ে ওঠে সখ্য, শহুরে
বিত্তবানরাই থেকে যায় তাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাহলে গণতন্ত্রের
শরীর-স্বাস্থ্যের আসল সমস্যাগুলিকে নিয়ে ভাববে কারা? নগর শহরের লাগামছাড়া
বাজার ভোগবাদ আজ আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো গিলে খাচ্ছে সাংবাদিকতাকেও।
ব্র্যান্ডের সঙ্গে নিজেদের জুড়ব, কিন্তু কাজের বেলায় শর্টকাটে কাজ সারব- এই
প্রবণতা একদিকে যেমন নতুন প্রজন্মকে প্রথম থেকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে,
অন্যদিকে বেশি ঝুঁকির রাস্তায় না গিয়ে চেয়ার এবং বেতন সুরক্ষিত রাখতে
সমঝোতার পথে চলতে গিয়ে পেশাটির বিশ্বস্ততাকেই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন অনেক
বর্ষীয়ান সাংবাদিক। তা থেকে বের হয়ে আসবে প্রজন্ম।
খ।
যে
কোনো ইতিহাস রচনা সাধারণ কোনো কাজ নয়। তার জন্য দরকার তথ্যের সত্যতা,
আন্তরিকতা, সাধনা ও অধ্যাবসায়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সম্পাদক আবুল
কাশেম হৃদয় অনেকটা করতে পেরেছেন। তথ্যসূত্রগুলো আরও ভালো হলে সত্যতা যাচাই
সহজ হতো। তবু সাধুবাদ পাওয়ার উপযুক্ত তার গবেষণা ও সম্পাদনা। আমার ধারনা
নির্দিষ্টভাবে তথ্যের অভাবে কাজের সমস্যা হয়েছে নিদারুণ তার। তবু দায় অনুভব
করে দায়িত্ব নিয়েছেন পাথর কাটার।
প্রসঙ্গত আলী হোসেন চৌধুরী লিখেন,
কুমিল্লার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রটি অনেক আগে থেকেই চর্চিত হয়ে
আসছিল। দাবি আছে প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদের কোনো কোনো চর্যাকারের জন্ম
কুমিল্লা বা প্রাচীন সমতট রাজ্যে। নাথ সাহিত্যের কোনো কোনো কবি সম্পর্কেও এ
দাবি আছে। মধ্যযুগের একাধিক কবির নাম পাওয়া যায় কুমিল্লায় যাদের জন্ম।
কালের
পরম্পরায় গল্প কবিতা ছাড়াও কুমিল্লাকে নিয়ে ইতিহাসের বিষয় থেকে একাধিক
গ্রন্থ রচনা করেছেন গোলাম ফারুক, আহম্মদ আলী, আহসানুল কবীর ও আবুল কাশেম
হৃদয় ।
কবি পিয়াস মজিদ লিখেন, 'মুক্তিসংগ্রামে কুমিল্লা'-সহ একগুচ্ছ
গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-বইয়ের লেখক আবুল কাশেম হৃদয় 'দৈনিক কুমিল্লার কাগজ'
সম্পাদনা করে আসছেন নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে। আমার বিশেষ ভাল লাগার বিষয়, শত
ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতি বইমেলায় হৃদয় ভাই আমার কবিতার বইয়ের খোঁজ করেন,
সংগ্রহ করেন।'
যে প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে
আমাদের দেশ ও সমাজ এগিয়ে নেওয়া মানুষদের গল্প। এমন মানুষের স্মৃতি,
জীবনবোধ, সমাজ চিন্তা ও ত্যাগের কথা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। আর
তা এখনই সময়। কারণ বাংলা ও বাঙালির রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। যে ইতিহাস
অস্বীকার করবার নয়। আর সেই ইতিহাসের মাধ্যমেই আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।
মূলত সত্যিকারের ইতিহাস/ মানুষকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই অঞ্চলের
চৌহদ্দি নিয়ে ভাবনা হৃদয়দের।
আমি মনে করি তার মতো কিংবা মোতাহের হোসেন
মাহবুব, পিয়াস মজিদের মতো মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ, বিষয়ক গবেষনা হৃদয় দিয়ে সবাই
সকল মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে করলে কুমিল্লাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া
সম্ভব।
ইমরান মাহফুজ
কবি ও গবেষক
সহ সম্পাদক দ্য ডেইলি স্টার