মিরাজুল ইসলাম ||
দেশের মাদকাসক্ত যুবসমাজ এবং সামাজিক অনাচারের জন্য দায়ী বিভিন্ন ক্ষতিকর মাদকের প্রসার রোধ করতে বিকল্প উপায় খোঁজা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে মদের ওপর শুল্ক কমানোর ব্যাপারে গত সপ্তাহে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা হয়। খবরটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম।
সেই আলোচনায় সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. শামসুল হক টুকু বলেন, অ্যালকোহল সেবন উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তবে অ্যালকোহল আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত নেওয়া যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, যুবসমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার। এলএসডি, ইয়াবা, হেরোইন ক্ষতিকর; তাই এগুলো থেকে যুবসমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বাস্তবতার নিরিখে উল্লেখ করেন, আমেরিকা ও কানাডা গাঁজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশে মাদক কখনো বন্ধ করা যাবে না। তবে হয়তো কিছুদিনের জন্য কমিয়ে আনা যেতে পারে। কারণ মাদকের বিকল্প কিছু একটা সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাই অ্যালকোহল, মদ, গাঁজা—এগুলো সম্পর্কে আরো চিন্তা-ভাবনা করা উচিত বলে তিনি মতামত দেন।
সংসদীয় কমিটির সদস্য জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমানের মতে, মদ, বিয়ার বা অ্যালকোহলের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে যদি রাজস্ব বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাই করা উচিত। ড্রাগ অর্থাৎ আইস, ইয়াবা, এলএসডি এগুলো ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক। মদ, বিয়ার, গাঁজা ইত্যাদিতে যদি ৫ শতাংশের নিচে অ্যালকোহল থাকে, তাহলে এগুলো বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া উচিত।
এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে এই আলোচনার সিদ্ধান্তের ওপর। মদ্যপানের আইনগত বৈধতা সীমিত পর্যায়ে থাকলেও পুরো প্রক্রিয়াটি এখনো স্পষ্ট নয়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশে খোলাখুলিভাবে মদ্যপানের পক্ষে কথা বলার পরিবেশ কখনো অবারিত হবে না। আবার একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামাজিক বলয়ে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে মদ্যপান স্বাভাবিক বিষয়। এই দুই পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার হলেও বাংলাদেশে মাদকাসক্তের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে মদ্যপানের তুলনামূলক কম ক্ষতিকর প্রভাবকের বিষয়টি এখন নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে আমরা দেখব, হাজারবার নিষেধ করার পরও মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে ‘মদাসক্ত’ হচ্ছে।
পানীয় হিসেবে এই তরলের প্রতি আসক্তি ও ভক্তি বিশেষে এর ভোক্তার শ্রেণিবিন্যাস করা খুবই সম্ভব। ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ বচন আর এমনি এমনি তো আসেনি! বহু প্রাচীনকাল থেকে ‘সুরা পানে মত্ত’ হওয়ার ইতিহাস আমরা জানি।
রোমান পুরাণে ব্যাক্কাস ও গ্রিক পুরাণে ডায়ানোসিস ‘সুরা বা মদের দেবতা’ হিসেবে পূজিত হয়ে এসেছেন। এরপর যতই সভ্যতা এগিয়েছে এই দেবতারা নিয়মিত মর্তের মানুষের পূজা পেয়ে এসেছেন। তাঁদের এড়ানো ভীষণ কঠিন ব্যাপার। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পিছু হটেনি ব্যাক্কাসের শাগরেদরা। দেবতারা যে সুধা পান করতেন আদতে সেটাই তো নিষিদ্ধ ‘সুরা’। ইসলাম ধর্মে ‘খমর’ নামের ক্ষতিকর পানীয়কে শুরুতে পরিমিত ও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ তথা হারাম বিধান করেও এর পানচর্চা ঠেকানো যায়নি। ইহকালে এই সুরা পানে নিবৃত্ত হলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, পরকালে পবিত্রতম পানীয় শরাবুন তহুরা পান করানো হবে বিশ্বাসী বান্দাদের।
অথচ ইহকালে এটি মাদকের মতো সর্বনাশী নয়, কিংবা প্রাচীন দেহব্যবসার মতো নিষিদ্ধ সামাজিক ‘ট্যাবু’ও নয়। তবু সমাজে কোথাও এটি দৃশ্যমান, কোথাও অদৃশ্য। কালক্রমে এই সঞ্জীবনী সুরা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের মিশেলে এক বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে। হাজার বছরের পরিক্রমায় অনেক বদলে গেছে এই পানীয় তৈরির গতি-প্রকৃতি।
প্রাচীন আমলে এক নামে ডাকলেও গত এক হাজার বছরে তার রূপ-রস-গন্ধে এসেছে নানা মাত্রা ও বৈচিত্র্য। পানরসের সম্ভার এখন বহুধাবিভক্ত। ভক্তকুলও যুগে যুগে নিঃশঙ্ক, ত্রিকালজ্ঞ।
যেমন ওমর খৈয়ামকে সবাই মনে রেখেছে তাঁর ‘রুবাইয়াত’ কাব্য সংকলনটির জন্য। এই ‘রুবাইয়াত-এ-ওমর খৈয়াম’ কাব্যগাথার পরতে পরতে আছে দ্রাক্ষা ফলের রসজাত ‘মদিরা-সুরা’র মাহাত্ম্য। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা বাহ্যিক জীবনের কামনা-বাসনার রূপক অর্থে লাল মদিরার স্তব উচ্চারিত হয়েছে। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, খৈয়াম-হাফিজ-সাদী প্রমুখ সুফি মুসলিম ঘরানার কবিরা ঘুরেফিরে ‘লাল মদ’ অর্থাৎ যাকে রেড ওয়াইন বলা হচ্ছে তার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন তাঁদের লেখায়।
এ ছাড়া সর্বজনপ্রিয় কবি মীর্জা গালিব থেকে শুরু করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে—প্রত্যেকেই পান করতেন নিজস্ব পছন্দের সুরা।
লাল মদিরা তথা রেড ওয়াইন ছাড়াও এই পানীয়ের জগতে বিয়ার, রাম, ভদকা, হুইস্কি, জিন, ব্র্যান্ডি, রাই, টাকিলা, কনিয়াক নানা পদের সুরায় নানা স্বাদের আসক্তি।
তবে আমাদের সংসদীয় কমিটি কোন ধরনের মদের ওপর করারোপ হ্রাস করবে তা নিয়ে এখনো বিশদ আলোচনা হয়নি। কারণ বাজার অর্থনীতির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ জড়িত।
মদের বাজার খুলে দিলেই মাদকাসক্তের সংখ্যা কমে যাবে—এমন ভাবনার মূলে রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা।
যে বিষয়ের বৈধতা গোপনে দেওয়া হয় তার ফলাফল কখনো ভালো হয় না। প্রত্যেকের নিজস্ব অভিরুচি তথা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত নিজস্ব। কেউ যদি মাদক পরিহার করে মদ্যপান বেছে নেয় কিংবা মদ্যপান করতে গিয়ে মদ ও মাদক দুটিই পরিহার করে, তাহলে সমাজের লাভ।
মাদক বনাম মদের স্বচ্ছ পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা নীতিনির্ধারকরা দেরিতে হলেও অনুধাবন করতে পেরেছেন, এ জন্য তাঁদের স্বাগত জানাই। কারণ বিগত বছরে অবৈধ পথে মদের চোরাচালানে সরকার বিপুল অর্থের রাজস্ব আদায়ে বঞ্চিত হয়েছে।
সুতরাং আইনগত ভিত্তির মাধ্যমে মাদক নির্মূল করে একই সঙ্গে মদ্যপানকে বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করার ধারণাটি যুগোপযোগী। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অতিরিক্ত মদ্যপানের ক্ষতিকর বিষয়গুলো আলোচনায় আনা দরকার।
আমরা দেখেছি, এক আউন্স সোনা পেতে প্রায় দুই টন পাথর ভাঙতে হয়। তেমনি যেকোনো মূল্যে নবীন প্রজন্মকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে ভাঙতে হতে পারে সুকঠিন সামাজিক সংস্কার ও প্রতিবন্ধকতা।
আগামী বছরের আগাম শুভেচ্ছায় অপেক্ষায় আছি সব ট্যাবু ভেঙে মাদকের বিরুদ্ধে নতুন কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক।
লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা, চিকিৎসক