বন্যায়
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি সমন্বয়
কমিটি’র মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হবে। তা আবার মানুষের কাছে
প্রকাশ্যে তুলে ধরা হবে। তাই দশ টাকার জিনিস এক শ’ টাকায় কেনা যাবে না।
পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশে আর অতীতের মত কিছু করা যাবে না বলে ত্রাণ ও
পুনর্বাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম। তিনি রবিবার (১ সেপ্টেম্বর)
বিকালে কুমিল্লা সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে বন্যার্তদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে
করণীয় বিষয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে মতবিনিময় সভায় এ কথা
জানান। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে
সভায় সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের প্রতিনিধিরা কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতির
সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেন।
সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন
কুমিল্লা সেনানিবাসের কর্নেল স্টাফ কর্নেল আব্দুল আজিজ, কুমিল্লা পুলিশ
সুপার আশফিকুজ্জামান আক্তার, সিভিল সার্জন ডা. নাসিমা আক্তার, সড়ক ও জনপদ
বিভাগ এবং এলজিআরডি নির্বাহী প্রকৌশলী গন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাগণ,
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র সমন্বয়কগণ।
সভায় বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার বলেন, ভাঙ্গনের সম্মুখে থাকা বুড়িচংয়ের ৬ টি
গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
পুনর্বাসন করতে হবে দ্রুত। যেহেতু এই এলাকার মানুষের একসময় সবই ছিলো- এখন
তারা অনেকেই নিঃস্ব। তাই তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকেই আগ্রাসি আচরণও
করছে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে মানসিকভাবেও প্রশান্তি
দিতে হবে।
কুমিল্লা জেলার মৎস খাতের ক্ষতি তুলে ধরে জেলা মৎস কর্মকর্তা
মোঃ বেলাল হোসেন বলেন, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, বুড়িচংয়ে প্রচুর পুকুর-দিঘি,
মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। পোনা নার্সিংয়ের প্রজেক্ট থেকে পোনা বের হয়ে
গেছে। মাছ চাাষী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। বানের পানি নেমে গেলে আবার মাছের
রোগবালাই বাড়বে। সে জন্যও আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। সবমিলিয়ে
প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটিরও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২ টি পোনা বা বীজ উৎপাদন খামার
ভেসে গেছে। এখন পুনর্বাসনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দরকার।পানি সরে গেলে জানা
যাবে মোট কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার
উপ- পরিচালক আইয়ুব মাহমুদ জানান, সাম্প্রতিক বন্যায় আউশ ধান সবচেয়ে বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপা আমন ও রোপা আমনের বীজ তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রোপা আমনের মৌসুম পেতে হলে দ্রুত চারা তৈরী করে চারা রোপণ করতে হবে। আমরা
সরকারিভাবে বীজ সংগ্রহ ও বিতরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। বন্যায় এই মৌসুমে
সবজির পুরোটাই ক্ষতি হয়েছে। এখন আমাদের সামনের ফলন ও কৃষকদেরকে নিয়ে
পুনর্বাসনের কথা ভাবলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠা যাবে। সব মিলিয়ে
প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৮ শ’ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব ধরা হয়েছে।
পানি
উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান, গোমতী নদীর
ভাঙ্গনে পানির উচ্চতা ২ মিটার কমলে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করা যাবে। তার
আগে সেখানে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।
এলজিআরডি নির্বাহী প্রকৌশলী
মোহাম্মদ সায়েদুজ্জামান সাদেক জানান, রবিবার (১ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ৯১২
কিলোমিটার এলজিআরডির রাস্তা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব জায়গা থেকে পানি
নেমে গেলে বাকি তথ্য পাওয়া যাবে।
সড়ক ও জনপথ নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি
চাকমা বলেন, সওজের ১০০ কিলো মিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক ও জনপথ
বিভাগের সকল রাস্তা সচল আছে।
সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আক্তার জানান,
বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম ও ব্রাহ্মণ পাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ডুবে
গিয়েছিল। ১১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। সরকারি হিসেবে এখনো
পর্যন্ত ১৪ জন মারা গিয়েছে পানিতে ডুবে। ১ জন মারা গেছে বর্জ্যপাতে, ৩ জন
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট এবং ১ জন সাপে কাটায় মৃত্যুবরণ করেছে। বন্যায় বিভিন্ন রোগের
প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সেজন্য ২১৭টি মেডিক্যাল টিম গঠন করে
প্রাথমিকভাবে গ্রামে গ্রামে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের খাবার স্যালাইন ও
পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ আছে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের কর্নেল স্টাফ কর্নেল
আবদুল আজিজ বলেন, বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই ২৩ জন গর্ভবতী মাসহ অসংখ্য
মানুষকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী । ১১ টি মেডিকেল টীম কাজ করছে।
দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে সেনাবাহিনীস্পিডবোটসহ কাজ করে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনীকে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়রা সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী বন্যা কবলিত মানুষদের পাশে সবসময়ই আছে।
সভায় দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীর প্রতীক বলেন,
সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে একটি ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন
সমন্বয় কমিটি হবে। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য পেলেই এসব কমিটি করা হবে। বন্যা
কবলিতদের আমাদের সাথে সারা বিশ্ব এই সহযোগিতায় কাজ করছে। তাই আমরা একটি
দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।
তিনি তরুণ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান
জানিয়ে বলেন, প্রচলিত ধারা পুনর্বাসন কর্মসূচি পালন করবেন না, বরং তরুন
কর্মকর্তারা মেধার প্রয়োগ করবেন। আমরা ত্রান সমন্বয় কমিটি যা করবে তা নিত্য
যাচাই করা হবে। মানুষের কাছে প্রকাশ করা হবে। আমরা যা দেখবো- মানুষও তা
দেখবে। মানুষের কাছে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এমন দৃষ্টান্ত মূলক পুনর্বাসন করতে
হবে। রাস্তা বানাবেন যে ন দুই দিন পর আবার না বানাতে হয়। সকল মানুষ সমান
সাধারণ মানুষকে এই উপলব্ধি দিতে হবে। আর বৈষম্যের সুযোগ নাই। আমাদের ঐক্যের
সুযোগ এসেছে৷ এটা হেলায় হারালে হবেনা৷ আমরা ত্রান ও পুনর্বাসনে
দৃষ্টান্তমূলক ভালো করতে চাই।
তিনি সবার প্রতি মানব সেবায় এগিয়ে আসার
আহ্বান জানিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন৷ মোদ্দা
কথা, আমরা সুনিয়ন্ত্রণ ভাবে পুনর্বাসন কর্মসূচি পালন করতে চাই। কারো মাথার
উপর কোন বড় ভাই - আপনারা নিঃশঙ্ক চিত্তে মানুষের সেবা করবেন।
সভাপতির
বক্তব্যে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, আমরা
বন্যার সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে দৈনিক
রিপোর্ট পাঠাচ্ছি। তিনিও কুমিল্লার ব্যাপারে বেশ আন্তরিকতার সাথে খোঁজ খবর
নিচ্ছে। আশাকরি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন সফলভাবে
করতে পারবো।