শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২
লাকসামে বন্যায় দুর্ভোগ চরমে
সড়কের পাশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যাচ্ছে খাদ্য সহায়তা, প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর বন্যাপীড়িত মানুষজন হচ্ছেন বঞ্চিত!
মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসাম
প্রকাশ: বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৪, ১২:৪২ এএম |





কুমিল্লার লাকসামে বন্যায় দুর্ভোগ চরমে। বাড়ি থেকে পানি এখনও নামছে না। রাস্তাঘাটগুলো পানির নিচে। শুকনো জায়গা মিলছে না। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। পঁচা পানির ওপর বসবাস। গবাদি পশুসহ বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্য সংকট। বীজতলা করতে পারছে না কৃষক, ভাদ্র মাস চলছে। জেলা ও উপজেলা সদরের কাছা কাছি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় কেবলমাত্র সড়কের পাশে অবস্থিত বন্যার্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলো সবকিছু যাচ্ছে। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানিবন্দী গ্রামগুলোর অসহায় মানুষের কাছে কোনো সহায়তা ঠিকভাবে পৌঁছছে না। সবচেয়ে বেকয়দাদা পড়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তাঁরা লজ্জায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। বাড়ি-ঘরে পানিবন্দী হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে অত্যন্ত মানবেতর দিনাতিপাত করছেন।
বন্যায় আক্রান্তদের দাবি সড়কের পাশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষের প্রতি সহায়তা প্রদান করা। কারণ সেখানে খাবার কম পৌঁছে।
উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের বেতিহাটি, লক্ষীপূর, গোবিন্দপুর. কান্দিরপাড় গ্রামের প্রায় একশত পরিবার ওঠেছে গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গোবিন্দপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে। অনেক পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে জায়গা না পেয়ে নিরূপায় হয়ে আবার বাড়ি ফিরে গেছেন। তাঁরা এখন বাড়িতে পানিবন্দী হয়ে আছেন। পানিবন্দী ওইসব পরিবারগুলো খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন না।
উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের বেতিহাটি গ্রামের বাসিন্দা মো. মোরশেদ আলম। তিনি জানান, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা এলাকায় ছোট-খাটো একটি ব্যবসা করতেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়ি চলে আসেন। তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মারিয়া আক্তার। বিয়ে হয়েছিলো পাশের মনোহরগঞ্জ উপজেলার বচইড় গ্রামে। স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতণের শিকার হয়ে ২০২১ সালের ১০ আগষ্ট মারা যায়। মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চালাতে গিয়ে ধার-দেনা করে এখন অনেকটা নি:স্ব।স্ত্রী, অপর ছেলে-মেয়েসহ এখন গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
তিনি জানান, হঠাৎ টানা বর্ষণ ও উজানের পানি তাঁর ঘরে ঢুকুছে। বাড়িতে কোন শুকনো জায়গা নেই। দ্রুত তিনি পাশের বাড়ি গিয়ে একটি ঘরে স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু কেউ খবর রাখছে না। সেখানে খাবার পৌঁছে না। শরমে কিছু বলতে পারছেন না। লজ্জায় আশ্রয়কেন্দ্রেও যাননি।
ওই ইউনিয়নের গাজিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা মাদরাসা শিক্ষক ও আইনজীবী শাফায়াত হোসেন কৃষিবিদ বলেন, তাঁর গ্রামের কয়েকটি বাড়ি-ঘর ছাড়া প্রতিটি বাড়ি ঘরে পানি থইথই করছে। এই গ্রামের পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। এখানে পৌঁছেনি কোনো খাদ্য সহায়তা। একই অবস্থা
উপজেলার কান্দিরপাড় ইউনিয়ন পানিতে নিমজ্জিত। শিংজোড়, হামিরাবাগ, সাতবাড়িয়া অশ্বতলা, চুনাতি এলাকায় ডাকাতিয়া নদীর পানি আশপাশের বাড়িতে ঢুকেছে। ওই ইউনিয়নের ভাকড্যা, কামড্যা, রায়পুর, আউশপাড়া, সালেপুর গ্রামের বন্যাপীড়িত মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ওই ইউনিয়নের সালেপুর গ্রামের বন্যাপীড়িত দেলোয়ার হোসেন বলেন, যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন তাঁরা কিছু সাহায্য সহায়তা পেলেও আমাদের মতো অনেকেই বাড়িতে পানিবন্দী হয়ে আছি। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ার এখনে কেউ সহায়তা দিতে আসেন না।
উপজেলার মুদাফরগঞ্জ (দক্ষিণ) ইউনিয়নের সবগুলো গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় সেখানের মানুষ খাদ্য সহায়তা তেমন পাচ্ছেন না।
উপজেলার উত্তরদা ইউনিয়নের মনপাল, দিগধাইর, বরইমুড়ি, শেরপুর, নাড়িদিয়া, ষোলদোনা, ঠেঙ্গারপাড়, রামারবাগ, মামিশ্বরসহ অনেক গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে।
ওই ইউনিয়নের ঠেঙ্গারপাড় গ্রামের সত্তরোর্ধ মনোয়ারা বেগম জানান, তিনি ও তাঁর স্বামী রবিউল হোসেন বয়োবৃদ্ধ এবং অসুস্থ। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁর ঘরে পানি ঢুকে কোমর সমান। কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার শক্তি সামর্থ নেই। পাশের বাড়ির একটি পরিবার তাঁদের ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্ত কোনো রকম খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন না। অনাহারে অর্ধাহারে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
ওই ইউনিয়নের বরইমুড়ি গ্রামের মুন্নি আক্তার জানান, টানা বৃষ্টি শুরু হলে বৃহস্পতিবার রাতে হু হু করে ঘরে পানি ঢুকে যায়। কোমর সমান পানিতে ঘরে রক্ষিত চাল-ডালসহ সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। সারা রাত শিশু সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে কোনোমতে রাত কাটিয়ে সকালে অনেক কষ্টে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে একটি গিয়ে আশ্রয় নেন। এ সময় তাঁর দিনমজুর স্বামী বাড়ি ছিলেন না। দেশের ভয়াবহ বন্যা কবলিত এলাকা ফেণীতে আটকা পড়েন। দুইদিন পর বাড়ি আসলেও কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন নি। এখন এলাকার একটি বাড়িতে আশ্রিত। রয়েছেন চরম খাদ্য সংকটে। কিন্ত পাচ্ছেন না কোনো খাদ্য সহায়তা।
উপজেলার আজগরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর, কালিয়াচৌঁ, চরবাড়িয়া, বাতাবাড়িয়াসহ বহু গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এখানে চরম খাদ্য সংকটে বন্যাপীড়িত মানুষ।
কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুম আলম অনিক জানায়, তাঁদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে কখনো এরকম বন্যা পরিস্থিতি দেখেনি। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার মানুষজন অনেক কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। এলাকার বিত্তবান ও কিছু সামাজিক স্বেচ্ছাসেবক বন্যাপীড়িতদের খাদ্য সহায়তা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তিনি বলেন, মূল সড়ক থেকে গ্রামের অবস্থান অনেক ভিতরে হওয়ার সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা সাহায্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে একটু মানবিক সহায়তার আবেদন জানান তিনি।
কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণ ও উজানের পানিত সৃষ্ট বন্যায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠও পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার এখন ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠাঁই হয়েছে বন্যা কবলিত মানুষের। আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোর সামনের মাঠে পানি থৈ থৈ করছে। ফলে ওইসব আশ্রয় কেন্দ্রে ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকগণ।
লাকসাম পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, লাকসাম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দৌলতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নবাব ফয়েজুন্নেসা ও বদরুন্নেসা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়, গাজিমুড়া কামিল মাদ্রাসা, গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোবিন্দপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, গুন্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আল আমিন ইনস্টিটিউট, উত্তরদা উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এ মালেক ইন্সটিটিউশান (রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়), নশরতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৭টি আশ্রয়কন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা কবলিত মানুষ।
এদিকে লাকসাম পৌরসভার বহু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। বিশেষ করে গাজিমুড়া, ধামৈচা, সাতবাড়িয়া, উত্তরকূল, গুন্তি, গোপালপুর, কুন্দ্রা, বাইনচাটিয়া, বিনয়ই, কোমারডোগা, গন্ডামারা, রাজঘাট, আমুদা, উত্তর পশ্চিমগাঁঁও, বাতাখালীসহ কয়েকটি এলাকায় ঘরের ভিতর পানি প্রবেশ করেছে।নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ওইসব এলাকার মানুষজন।
গতকাল রাত থেকে বৃষ্টি না হলেও ক্রমশ: পানি বেড়েই চলছে। ফলে জনজীবনে দুর্ভোগের সীমা নেই। শত শত পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন তাঁরা। অনেক পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে জায়গা না পেয়ে নিরূপায় হয়ে আবার বাড়ি ফিরে গেছেন। কিছু কিছু সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওইসব আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোতে শুকনো খাবার, খাওয়ার স্যালাইন দিলেও তা ছিলো অত্যন্ত অপ্রতুল।
বন্যায় আক্রান্তদের দাবি সড়কের পাশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষের প্রতি সহায়তা প্রদান করা। সেখানে খাবার কম পৌঁছে।
এ ব্যাপারে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আব্দুল হাই সিদ্দিকী কালের কন্ঠকে জানান, আমরা বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষকে সাধ্যমত সহায়তার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। রিমোট এরিয়াগুলোতে কিভাবে সহায়তা প্রদান করা যায। তাছাড়া, কেউ খুব বেশি অসুবিধা থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমার মুঠোফোন নম্বর দিয়ে রেখেছি।
তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে একটু সমন্বয়ের মাধ্যমে সহায়তা প্রদানে বিত্তবান ও সামাজিক সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবীদের অনুরোধ জানিয়েছেন। সমন্বয়ের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা দিলে সকলে পাবেন। কেউ বঞ্চিত হবেন না।























সর্বশেষ সংবাদ
এক বছরে সাড়ে ৩ শ ধর্ষণের অভিযোগ কুমিল্লায়
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পেলে ধারনা করা যাবে নির্বাচন কবে হবে: সিইসি
আজ কুমিল্লায় আসছেন সিইসি
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
এক বছরে ৯৬ বেওয়ারিশ লাশ দাফন কুমিল্লায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা ইকরা মডার্ণ স্কুলের বার্ষিক ফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা
জিয়া সাইবার ফোর্স- কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটি অনুমোদন
কুমিল্লায় বিজিবি অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজা জব্দ
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয়’
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২