বন্যায়
বিপর্যস্ত পুরো কুমিল্লা। বানের পানিতে ডুবেছে ঘরবাড়ি, ভেসে গেছে মূল্যবান
সামগ্রী। অসহায় মানুষদের অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে।
দুর্বিসহ অবস্থায় কাটছে রাতদিন। কিন্তু এর মধ্যেই জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে
ডাকাত আতঙ্ক। রাত বাড়লেই বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতরা হানা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ
পাওয়া যাচ্ছে। ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেতে নির্ঘুম রাত কাটছে বন্যা কবলিত
এলাকায়। রাতের বেলায় অনেক এলাকা থেকেই মসজিদের মাইক থেকে এলাকাবাসীকে
সতর্ক থাকার আহবান জানানো হচ্ছে।
এদিকে ডাকাত আঙ্কের কারণে অনেক জায়গায়
ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজে আসে স্বেচ্ছাসেবীরা পড়ছেন প্রতিবন্ধকতার মুখে।
রাতের বেলায় ত্রাণ দিতে গিয়ে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে তাদের। আর
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অনেক স্থানে রাতের বেলায় ডাকাতের দল ত্রাণ দেওয়ার কথা
বলে ঘরে ঢুকে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে পুলিশ বলছে, বন্যা
প্লাবিত দুর্গম এলাকাগুলোতে অনেক দুর্বৃত্তই এই সুযোগ ডাকাতির মতো অপরাধ
সংঘটিত করছে। পুলিশ সতর্ক আছে, তবে পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও সামাজিকভাবে
প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
জানা গেছে, গেলো প্রায় এক সপ্তাহ যাবত
কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ডাকাতের আতঙ্ক বেড়ে যায়। বিশেষ করে গত
বৃহস্পতিবার গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্লাবিত এলাকাগুলোতে
ডাকাতের দল হানা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে বন্যাকবলিত জেলার
অন্যান্য উপজেলাগুলো থেকেও ডাকাত আতঙ্কের তথ্য আসতে থাকে। বিশেষ করে
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জরইন, পূর্ণমতি, বাকশিমুল, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার
সাহেবাবাদ, টাকই, জিরুইনসহ আশপাশের গ্রাম থেকে ডাকাত আতঙ্কের খবর আসছে। এসব
এলাকার লোকজন ডাকাতের ভয়ে রাতের বেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন।
ব্রাহ্মণপাড়া
উপজেলার জিরুইন গ্রামের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক আতিকুর রহমান জানান, গত ৩
দিন ধরে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাতের বেলায় প্রহরা দিচ্ছি। শুনছি আশপাশের
এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে। তাই বাড়তি সতর্কতা হিসেবেই এ কাজ করছি। রবিবার দিবাগত
রাত ২টার দিকে খবর পাই আমাদের পাশের এলাকা দিয়ে একদল লোক আমাদের এলাকার
দিকে আসছে- খবর পেয়ে আমরা জোট বেঁধে আমরা রাস্তায় নেমে আসি। মসজিদের মাইকে
সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়। প্রতিরাতেই বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, মসজিদের মাইক থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ আসে। এলাকাবাসী
আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছে। ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে নাকি ডাকাতের দল সর্বস্ব লুট
করে নিয়ে যায়।
বুড়িচং উপজেলার বাকশিমূল গ্রামের গৃহবধূ শারিমন সুলতানা
বলেন, একদিন আগে আমার চাচা শ^শুরের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। বন্যায় আমাদের
বাড়িতে কোমর সমান পানি উঠলেও আমরা বাড়ি ছেড়ে যাইনি। এখন ভয়ে আছি- ডাকাত দল
যদি আবার হানা দেয়।
ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম
চালাতে আসা স্বেচ্ছাসেব শিহাব বলেন, ডাকাত আতঙ্কের কারণে অনেক স্থানে
আমাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গত রাতে আমরা ত্রাণ
বিতরণ কার্যক্রম শেষ করতে প্রায় ১১টা বেজে যায়। স্পীডবোটে করে দুর্গম এলাকা
থেকে ফিরছিলাম। আলো না থাকার কারণে আমাদের কিছুটা ভয় করছিল। এমন সামনে
একটা বোট দেখে আমরা ভয়ে থেমে যাই, তারাও আমাদের দেখে ভয় পেয়ে যায়। এভাবে
কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর সাহস নিয়ে তাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বুঝতে পারি
তারাও আমাদের মতো স্বেচ্ছাসেবী। পরে জানলাম, তারাও আমাদেরকে দেখে ডাকাত
ভেবে ভয়েছিলো।
এদিকে ডাকাত আতঙ্কের বিষয়টি নিয়ে গতকাল সোমবার কুমিল্লায়
বন্যার্ত এলাকা পরিদর্শনে আসা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল
(অব)জাহাঙ্গীর আলমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এরকম মহাবিপদের সময়ে যদি
এরকম ঘটনা ঘটে থাকে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। যেহেতু পুরো এলাকা বন্যাকবলিত। সব
জায়গায় সহজে যাওয়া যায় না। পুলিশ জানলেও যেতে অনেক সময় লাগে, তাই পুলিশের
পাশাপাশি জনগণকেও ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিরোধ করতে হবে।
একই কথা বলেছেন
কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোঃ সাইদুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
বিভিন্ন জায়গা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এরকম খবর আমরা পাচ্ছি। পুরো এলাকা বন্যা
কবলিত। আমি দুদিন আগে নৌযান নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে দেখেছি অনেক এলাকাই
অত্যন্ত দুর্গম। এসব এলাকায় দিনের আলোতেই যাওয়া যায় না। রাতের বেলায় যদি
এরকম দুর্গম এলাকায় ডাকাতের আতঙ্কের কথা শুনা যায়, তাহলে তো সেখানে দ্রুত
পৌঁছানো সম্ভব না। এখন যদি এরকম অবস্থায় যদি কোথাও এধরণের ঘটনা ঘটে তাহলে
পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, কিছু সুযোগ
সন্ধানী মানুষ আছে। তারা যে যখন সুযোগ পায় তখনই সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়।
এখন যারা দুষ্টু লোক, যারা অপরাধের সাথে জড়িত, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত;
তারা দেখা গেলো বানের পানির কারণে মাদক ব্যবসা করতে পারছে না, তারা হয়তো
এখন মানুষের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। কিন্তু আমরা যেখান
থেকেই খবর পাচ্ছি, সেখানেই পুলিশ পাঠাচ্ছি। তবে অধিকাংশ জায়গাতেই এর
সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে গিয়ে জানা যাচ্ছে- ঘটনা আসলে ভিন্ন। তবে
সবই যে মিথ্যা তা বলছি না। কিছু কিছু এলাকায় হয়তো আছে। এতো বড় এলাকা, কোথায়
কি হচ্ছে তা সব সময় আমাদের নজরেও আসাও কঠিন। তাই পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও
ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।