কুমিল্লার চানপুর ও কাঠালিয়ায় গোমতির পাড় চুইয়ে বের হচ্ছে পানি
জহির শান্ত
|
কুমিল্লার গোমতি নদীর পানি এখন পাড় সমান। কোন কোন স্থান দিয়ে পাড় ছিদ্র হয়ে বের হচ্ছে পানি। স্থানীয় লোকজন সেগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করলে পানি বের হচ্ছে। এর মধ্যে কুমিল্লার শহরের চানপুর ব্রিজের কাছে ও কুমিল্লার বুডিচংয়ের ময়নামতি ইউনিয়নের কাঠালিয়া এলাকায় পাড় ছিদ্র হয়ে পানি বের হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ তথ্য স্থানীয়দের সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কুমিল্লার গোমতির নদীর পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই, ট্রেন চলাচল বন্ধ, মহাসড়কও বন্ধ হওয়ার উপক্রম কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। গোমতির নদীর পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই অবস্থায় আছে, বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচল। সেই সাথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাজারে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যে এ সব জানা গেছে। এ দিকে কুমিল্লার গোমতি নদীর পাড় থেকে সকল মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে ও আশ্রয় কেন্দ্রে সরে যেতে অনুরোধ জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। কুমিল্লায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা ভারী বষর্ণে পানিবন্ধী হয়ে ঘরছাড়া জেলার কয়েকটি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। বানের স্রোতে ভেসে গেছে ঘরবাড়ির মূল্যবান আসবাবপত্র। আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ ছুটছে উঁচু স্থান ও আশ্রয় কেন্দ্রে। বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বন্যার্ত মানুষেরা। বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়ের জন্য কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ৫৪টি, বরুড়ায় ৫১টি, চৌদ্দগ্রামে ২৮টি এবং সদর উপজেলায় ৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ এসব আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন। জানা গেছে, জেলার চৌদ্দগ্রামেই অন্তত ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া নাঙ্গলকোট উপজেলায় অতিবৃষ্টি ও বন্যায় অন্তত ৪০ হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েন। অপরদিকে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। ফলে নদীর চরের সকল অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়েছে চার শতাধিক পরিবার। সব মিলিয়ে কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনীতির দিকে যাচ্ছে। সূত্র বলছে, টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানি খালগুলো দিয়ে ঠিকমতো নিস্কাশন হতে না পারায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। যার কারণে চৌদ্দগ্রাম পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ। বন্যার পানি প্রবেশ করেছে উপজেলা পরিষদ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যার কারণে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। ভেসে গেছে বিভিন্ন মাছের প্রজেক্ট, দীঘি ও পুকুর। এতে কয়েক কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। মরে গেছে বেশ কয়েকটি পোল্ট্রি ফার্মের বিপুল পরিমাণ মোরগ। চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রহমত উল্লাহ বলেন, চৌদ্দগ্রামে ২৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এয়াড়াও উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বানভাসী মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হবে। অপরদিকে বন্য ও বানভাসী মানুষের একই চিত্র দেখা গেছে জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলায়ও। টানা বর্ষণ ও উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। পানি উঠেছে বাসা বাড়িসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায়। এতে করে পানিবন্দী হয়ে পড়ে এ উপজেলার জেলার ৮ থেকে ১০ হাজার পরিবারের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া আক্তার লাকী জানান, এ উপজেলার বানভাসী মানুষের আশ্রয়ের জন্য আমরা ৫৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছি। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বন্যার্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, টানা বর্ষণের কারণে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। আরো ত্রাণের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। এদিকে বুধবার ভোরে আকস্মিক পানিতে তলিয়ে যায় গোমতী নদীর চরের গ্রামগুলো। সকালের পর থেকে নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রবাহ শুরু হয়। বিকেল চারটার দিকে ১২ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ হতে দেখা গেছে। নদীর বিপৎসীমসা ১১ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা চলছে। এর ফলে গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ডম্বুরা লেকের বাঁধ খুলে দেওয়ায় ত্রিপুরার বন্যার পানি নেমে আসছে কুমিল্লার দিকে গোমতী নদী দিয়ে। তবে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে গোমতীর বাঁধের কোথাও কোনো সমস্যার খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে গোমতীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদীর চরের সকল অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়েছে চার শতাধিক পরিবার। জেলার আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর, চাঁনপুর, ডুমুরিয়া চাঁনপুর, কামারখারা, বানাশুয়া, বাবুর বাজার, পালপাড়াসহ নদীর গহ্বরে বসতি গড়া সকল পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সেসব পরিবারের মানুষেরা। চাঁনপুর এলাকার বানভাসি শাহিদা আক্তার বলেন, গতকাল রাতেও পানি অনেক কম ছিল। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এমন হবে। ভোর হওয়ার কিছুটা আগে থেকে দেখি পানি ঘরে প্রবেশ করছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঘরে পানি ঢুকে দুপুরের দিকে ঘরের অর্ধেক তলিয়ে গেছে। বুধবার বিকেল চারটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার কাজে সহায়তা করছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতারা। এছাড়াও বানভাসি মানুষদের মাঝে রান্না করা খাবারও বিতরণ করতে দেখা গেছে তাদের। কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মনির হোসেন পারভেজ বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা এখানে বানভাসি মানুষের সহায়তায় এসেছি। গোমতী নদীকে শেষ করে দিয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা একশ্রেণীর ভূমিখেকো। ভূমি খেকো সেসব দানবের কারণে এ নদী আজ হুমকির মুখে। আমি সারা কুমিল্লার মানুষকে অনুরোধ করব বানভাসি মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য। অপরদিকে পানিবন্দী এসব মানুষের জন্য সদর উপজেলায় তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে একশোর মতো পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া আশপাশের উঁচু অঞ্চলের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসাগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রশাসন থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে পানিবন্দী পরিবারের অনেকে নিকটাত্মীয়ের বাসার দিকে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোমেন রায় বলেন, আমরা তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছি। বানভাসি মানুষের খাদ্য সহায়তা চলমান রয়েছে। কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, পানি নদীর বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গোমতীর বাঁধ অক্ষত আছে। আশা করছি বাঁধে তেমন সমস্যা হবে না। গোমতীর গহ্বরে অবৈধভাবে বসতি গড়া পরিবারগুলোই আক্রান্ত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসসহ আমাদের বেশ কয়েকটি টিম নদীর তীরে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত আছে। প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেওয়া হবে। |