ব্যাংকে
আবারও ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকে ও ব্যাংকের বাইরে কোথাও
নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কাছে মার্কিন ডলার এখন
অনেকটাই ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো।
আর ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার কেনার
খরচ বেড়েছে, এ কারণে বিক্রিও হচ্ছে বেশি দামে। এতে নির্ধারিত দামে এলসির
দেনা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১২২ থেকে ১২৩ টাকা
দরে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায়
নির্ধারণ করে দেওয়ার নির্দেশনা মানছে না কেউ। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) খোলা
বাজারে এক ডলার কিনতে গ্রাহককে গুনতে হয়েছে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা। এর কমে ডলার
পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে খোলাবাজারে প্রতি ডলার
১১৮-১১৯ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হতো। নগদ ডলারের দাম কয়েক মাস ধরে এরকমই ছিল।
তবে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনের পর গত সোমবার (২৯ জুলাই) তা বেড়ে ১২২
টাকায় ওঠে, যা এখন ১২৫ টাকা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পণ্য আমদানিকারক ও আলভীনা
টেক্সটাইলের মালিক এস এম ওবায়দুল্লাহ বলেন, ডলারের দাম এখন ‘পাগলা ঘোড়া’।
নির্ধারিত দামে অনেকেই ডলার পাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার এলসির দেনা নিষ্পত্তিতে
তিনি ব্যাংককে দিয়েছেন ১২২ টাকা দরে। এতে ডলার কেনায় নতুন করে তার খরচ
বেড়ে গেছে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার কোনও কোনও ব্যবসায়ীকে এলসির দেনা
নিষ্পত্তিতে ডলারপ্রতি ১২৩ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
এদিকে গত জুন মাসের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত জুলাইয়ে প্রবাসী আয় কমেছে ২৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৯০ কোটি ডলার। যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ।
অর্থাৎ
জুলাইয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৬ কোটি ১২ লাখ ডলার করে। এটি আগের
মাস জুনের চেয়ে দৈনিক কম এসেছে অন্তত ২ কোটি ডলার। জুন মাসে এসেছিল মোট ২৫৪
কোটি ডলার। ওই মাসে গড়ে প্রতিদিন প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলার
করে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় মাত্র চার দিনের ব্যবধানে খোলাবাজারে
(কার্ব মার্কেট) অন্তত ৪ টাকা বেড়েছে ডলারের দাম।
দাম বেঁধে দেওয়ার পর
রাজধানীর মানিচেঞ্জারগুলো প্রায় ডলারশূন্য হয়ে পড়েছে। বুধবার (৩১ জুলাই)
প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার
রাজধানীর মানিচেঞ্জারগুলোতে এই দামে কোনও ডলার বিক্রি হচ্ছে না। নির্ধারিত
দামে বিক্রি করতে না পারায় তারা ডলারের আনুষ্ঠানিক বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে বিভিন্ন অলিগলিতে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা দামে। বুধবার (৩১ জুলাই)
মানিচেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমসিএবি) পক্ষ থেকে সব
মানিচেঞ্জারকে চিঠি দিয়ে ডলারের দাম ১১৯ টাকা বেঁধে দেওয়ার তথ্য জানানো হয়।
এরপর আজ এই চিত্র দেখা গেলো।
এ প্রসঙ্গে মানিচেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনে
সভাপতি এম এস জামান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে চিঠি দিয়েছি।
এছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের সরবরাহ নেই। ফলে
মানিচেঞ্জারে ডলার মিলছে না। এটাই বাস্তবতা।’ একাধিক মানিচেঞ্জারের
বিক্রেতারা জানান, ১১৯ টাকায় বিক্রি করার মতো ডলার কারোর কাছে নেই।
তবে
লাইসেন্স নিয়ে যারা ব্যবসা করেন, তাদের কাছে নির্ধারিত দামে ডলার না পাওয়া
গেলেও গুলশান বা মতিঝিলের অলিগলির খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে। তবে এই
খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে আগেই ১২৫ টাকায় উঠে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত খোলা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
খোলা
বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ফেরার সময় প্রবাসীরা নিজেদের সঙ্গে করে যে
ডলার নিয়ে আসেন, সাধারণত সেগুলো খোলা বাজারে বিক্রি হয়। কিন্তু এখন বিদেশ
থেকে মানুষ আসা কমে যাওয়ায় নগদ ডলারের সরবরাহ কমেছে।
ডলারের বাজার
অস্থির হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে
অভিযান চালাচ্ছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগেও ডলারের বাজারে অস্থিরতা
তৈরি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালিয়েছিল।
সে সময় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠান সিলগালাও
করা হয়।
অবশ্য ডলার সংকট সমাধানে এবারও ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সের ডলার
কেনার ক্ষেত্রে ১১৮ টাকার বেশি দাম না দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্স কেনার মৌখিক
নির্দেশ দেওয়ার দুদিন পর বুধবার আবারও আগের নির্ধারিত রেটেই রেমিট্যান্স
সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নির্দেশনা লঙ্ঘন
করলে কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বলে সতর্ক
করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে গত রবিবার
ব্যাংকগুলোকে ফোন করে রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলারের রেট বেশি দেওয়ার জন্য
বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের
সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রবিবার পর্যন্ত রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ছিল
সর্বোচ্চ ১১৮ দশমিক ৬০ টাকা। তবে ওইদিন ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে
রেমিট্যান্স কেনার নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকেই ডলারের দাম বেড়ে গেছে।
এ
প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ
হাতেম বলেন, ‘ডলারের দাম সামনে আরও বাড়বে। রিজার্ভ আরও কমবে। সমস্যা আরও
ঘনীভূত হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণেই ডলারের
দাম বাড়বে। কারণ, পোশাক রফতানি খাতকে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি-নির্ভর করে
দিয়েছে। মোহাম্মদ হাতেম জানান, আগে নিট পোশাক রফতানিতে ভ্যালু অ্যাডেড হতো
৮০ শতাংশের মতো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে
এখন নিট পোশাক রফতানিতে ভ্যালু অ্যাডেড হবে ৪০ শতাংশের মতো। এতে আমদানির
পেছনে প্রচুর ডলার চলে যাবে, ডলারের সংকট তৈরি হবে, ডলারের দাম বেড়ে যাবে।
ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাবে।