২০২৪-২৫
অর্থ বছরের খসড়া বাজেট সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির এক কঠিন
সময়ে বাজেটটি পেশ করা হয়েছে। তাই একে ঘিরে প্রবল জনমনোযোগ থাকার কথা।
বাস্তবেও তাই দেখছি। প্রচুর কথা হচ্ছে বাজেটকে ঘিরে। সরকারি ও বিরোধী দলের
নেতৃবৃন্দ ছাড়াও অন্যান্য অংশীজনরাও কথা বলছেন। অর্থনীতিবিদরা তো বলছেনই।
তাছাড়া
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চেম্বার, নানা ধরনের নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং মতামত
তৈরির প্রভাবক মহল প্রচুর কথা বলছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে নানা
মহলের এই আলাপ আলোচনা এক অর্থে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের
ভিত্তিকে বেশ জোরদারই করছে বলা চলে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম।
যদিও
সামাজিক মাধ্যমের বেশিরভাগ ব্যবহারকারী অনেকটাই যেমন খুশি তেমন বলতেই বেশি
আগ্রহী তবুও এখানেও জনগণের চাওয়ার যথেষ্ট ইঙ্গিত মেলে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চয় সব মহলের সমালোচনা ও পরামর্শের নির্যাস নোট
করছেন। যেহেতু এবারে ঈদের ছুটির কারণে খুব বেশি সময় ধরে সংসদের ভেতরে বাজেট
আলাপ হওয়ার সুযোগ নেই তাই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের এসব আলাপকে বিকল্প
সংসদীয় আলাপ মনে করে সেইগুলো সংগ্রহ করে বাজেট-প্রণেতাদের চূড়ান্ত বিবেচনার
জন্য নিশ্চয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হবে।
খুব ভালো হতো যদি সংসদের স্থায়ী
কমিটিগুলো তাদের নিজ নিজ খাতের জন্য অন্তত তিনটি করে জনগুরুত্বপূর্ণ
প্রয়োজনীয় পরামর্শ অর্থমন্ত্রীকে দিতে বলতেন মাননীয় স্পিকার। অন্তত প্রকৃত
অর্থনীতি সম্পর্কিত কমিটিগুলো (যেমন অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, শিল্প,
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু ও পরিবেশ ইত্যাদি) যদি সংসদে স্থাপিত
হেল্পডেস্কের সাহায্য নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য দু-একটি করে উপযুক্ত পরামর্শ
অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্পিকারের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারতো তাহলে তা পর্যালোচনা
করে খসড়া বাজেট অনেকটাই প্রাসঙ্গিক করার সুযোগ পাওয়া যেত।
একই সঙ্গে
বাজেটকে তরুণদের অর্থবহ করার জন্য তরুণ উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি
উদ্যোক্তাদের নানা সংগঠন (বিশেষ করে এসএমই ফাউন্ডেশন), বেসিস,
ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন, নারী চেম্বার, তৃণমূলের নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন
এবং অনলাইন ব্যবসায়ী তরুণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট বাস্তবানুগ নীতি
পরামর্শ সমগ্রহের সুযোগ রয়েছে।
ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে তাদের বাদ দেওয়া
যাবে না। তাদের ব্যাংক হিসাব ও এমএফএস হিসাব থাকলেই আর্টিফিশিয়াল
ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে কয়েক মিনিটেই ছোট আকারের ঋণ দেওয়া সম্ভব।
তাদের
অনেক ধারণা এখন ডিজিটাল স্পেসেও ভেসে বেড়াচ্ছে। উচিত হবে ধারণাগুলো পেশাগত
দৃষ্টিতে সংগ্রহ করে বাজেট প্রণেতাদের সামনে উপস্থাপন করা। সীমিত অর্থের
মধ্যেও যতটুকু গ্রহণ করা যায় ততই মঙ্গল। এতে করে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ার
সাথে জনগণের যোগাযোগ নিশ্চয় বাড়াবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে
চলমান বাজেট আলোচনাকে এভাবেই আরও সময়োপযোগী করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অর্থ
মন্ত্রণালয়ে এখন যথেষ্ট সংখ্যক তরুণ মেধাবী কর্মকর্তা আছে। তারা বাংলাদেশ
ব্যাংক, এনবিআর ও বিভিন্ন হেল্পডেস্কের প্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে আসলেই
গতানুগতিক বাজেট আলোচনাকে আরও উদ্ভাবনমূলক ও জনসম্পৃক্ত করতে সাহায্য করতে
পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এবারের বাজেটের ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে
বাজেট পেশের আগে থেকেই তুমুল আলাপ হচ্ছিল। বাজেট পেশের পরেও যথেষ্ট আলাপ ও
লেখালেখি হচ্ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটকে আরও অর্থবহ করার জন্য আমার
দিক থেকে কিছু নীতি পরামর্শ রাখতে চাই।
নীতি পরামর্শসমূহ-
এক. ঘরে ও
বাইরের নানামুখী চ্যালেঞ্জকে আমলে নিয়েই একটি প্রাসঙ্গিক বাজেট দেওয়ার
চেষ্টা করা হয়েছে। সময়ের দাবি মেনে এবং মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর সমস্যা
বিবেচনা করে মুদ্রানীতির সাথে মিল রেখে অনেকটাই সংকোচনমূলক বাজেট পেশ করা
হয়েছে। এই ধারাকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে।
দুই. উন্নয়ন বাজেটে
এখনো অনেক অপ্রয়োজনীয় এবং অগ্রাধিকারে বাইরের প্রকল্প মূলত স্থানীয়
রাজনৈতিক চাপাচাপির কারণে রয়ে গেছে। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে এগুলো হয় বাদ
কিংবা অযথা ডালপালা কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হবে—এমন একটি প্রস্তাব সংসদে
পাস করা যেতে পারে।
তিন. মূল্যস্ফীতিকে যেহেতু কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে
না তাই কৃষি, জ্বালানি বিশেষ করে সোলার শক্তি, এমএসএমই ও নারী উদ্যোক্তা,
ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের জন্য আরও প্রণোদনামূলক বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করা হোক। এই
অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক, এমআরএ, এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফকে দেওয়া হোক।
এরা
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদে পর্যাপ্ত ভর্তুকির জন্য এই
অর্থ ব্যবহার করবে। কোভিডকালে তারা এই কাজটি ভালোভাবেই করেছে। তাই নতুন করে
আর চাকা উদ্ভাবন করার দরকার নেই। তারা পারবে।
চার. সব ব্যাংককে
এমএফএসের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ন্যানো ক্রেডিট ব্যবস্থা চালু করার জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংকে বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লভ্যাংশের একটি অংশ
সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়কে না দিয়ে এই ন্যানো ক্রেডিট ব্যবহারকারী অংশের
সুদ ভর্তুকির দেওয়ার মাধ্যমে ছোটখাটো ডিজিটাল ও নারী উদ্যোক্তাদের
হ্যান্ডহোল্ড করে তুলে আনতে উদ্যোগ নেবে।
ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে তাদের
বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের ব্যাংক হিসাব ও এমএফএস হিসাব থাকলেই আর্টিফিশিয়াল
ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে কয়েক মিনিটেই ছোট আকারের ঋণ দেওয়া সম্ভব।
সিটি ব্যাংক এবং বিকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি সমর্থন নিয়ে এই কাজটি
করছে। অন্য ব্যাংকগুলোও সামাজিক দায় সম্পন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই
সহযোগিতার কাজে যুক্ত করা সময়ের দাবি। বাজেটে এজন্য আলাদা কিছু বরাদ্দ
থাকলে এই কাজে গতি আসবে।
পাঁচ. বাজেটে কৃষিসহ প্রকৃত খাতকে আরও বিনিয়োগ
সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চরে সবুজ বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারের
সুযোগ বাড়ানোর জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং এমআরএর সহযোগিতায়
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাজার উন্নয়নমূলক কিছু প্রকল্প নিশ্চয় নেওয়া
সম্ভব।
বাজেটে কৃষিসহ প্রকৃত খাতকে আরও বিনিয়োগ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ
রয়েছে। বিশেষ করে চরে সবুজ বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারের সুযোগ বাড়ানোর জন্য
গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং এমআরএর সহযোগিতায় বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাজার উন্নয়নমূলক কিছু প্রকল্প নিশ্চয় নেওয়া সম্ভব।
এমফোরসি,
ফ্রেন্ডশিপ এবং বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চরের কৃষিতে সবুজ জ্বালানির
ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। সোলার ইরিগেশন পাম্প, প্রাকৃতিক পণ্য
স্টোরেজ ব্যবস্থাসহ নানামুখী উদ্ভাবনী বীজ তারা তৈরি করছে। বগুড়ার আরডিএও
তাদের সক্রিয় অংশীদার।
ছয়. বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে অনেকগুলো
ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধ তহবিল থেকে কৃষির উদ্ভাবনে নতুন নতুন
প্রকল্পে স্থানীয় এনজিওকে যুক্ত করেছে। ভুট্টা চাষ, সোলার ইরিগেশনসহ অনেক
উৎপাদনশীল কাজে ব্যাংকগুলো অর্থ ঢেলেছে।
এই কাজটি আরও বেশি করে করার
জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজেটারি খানিকটা সহায়তা দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
বিশেষ করে চরের কৃষিবাজারকে চাঙা করার সুযোগ এই ধরনের বাজেটারি সমর্থন
খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
সাত.
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বিশেষ ইনোভেশন তহবিল
করা হোক। একটি স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ সমৃদ্ধ জুরি বোর্ডের মাধ্যমে এই অর্থ
সবুজ জ্বালানি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য ‘আর অ্যান্ড
ডি’ তহবিলের আওতায় উৎসাহী ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা
যেতে পারে।
আট. এবারের বাজেটে জলবায়ু ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে একশ কোটি
টাকার বিশেষ একটি অভিযোজন তহবিল দেওয়া হয়েছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। একই
রকমভাবে আরও একশ কোটি টাকার আরেকটি তহবিল এই মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হোক
সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রকৃতিকে রিমেল-উত্তর পুনর্বাসন ও স্থায়িত্বশীল
উন্নয়নের জন্য।
তবে শর্ত থাকুক যে এই তহবিল বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সবুজমুখী
উদ্ভাবন ও গবেষণাভিত্তিক অ্যাকশন রিসার্চে ব্যবহার করা হবে। এজন্যে একটি
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
এই রকম আরও অনেক প্রস্তাবই
আমরা দিতে পারি। তবে সংসদ যদি এমন উদ্ভাবনীমূলক জনবান্ধব বাজেটারি পরীক্ষা
নিরীক্ষাকে উৎসাহ দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব নিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের
বাজেটকে সত্যি সত্যি অংশগ্রহণমূলক করার নতুন দুয়ার খুলে দেওয়ার কৃতিত্ব
নিশ্চয় আমাদের আইনসভা নিতে পারে।
সবশেষে বলবো এবারে দারুণ এক
চ্যালেঞ্জিং সময়ে দেওয়া হয়েছে বাজেট। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যা
যা করা দরকার তা তো করবেনই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পাশাপাশি আগামী
দিনের টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করার জন্য জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ
গড়ার জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের উদ্যোগও নিতে হবে আমাদের সরকার ও রেগুলেটরি
প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকেও এসব উদ্ভাবনের
অংশীদার হতে হবে। মনে রাখা চাই রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো। তিনি বলে গেছেন যে
মানুষের জ্ঞান ও প্রকৃতির দান মিলেই তৈরি হয় সভ্যতা। আমাদের বাজেটসহ
অর্থনীতির মূল সুরটিও যেন এই সভ্যতার বিকাশে সারথি হয় সেই প্রত্যাশাই করছি।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক