প্রিয়ভাজন
ছাত্র দৈনিক কুমিল্লার কাগজের সম্পাদক মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় ফেইসবুকে
স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছে- ‘প্রমীলার জন্মস্থান মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রামে।’
আমি মন্তব্যে লিখলাম-‘প্রমীলার পিতৃপুরুষের বাড়ি মানিকগঞ্জের তেওতা। কিন্তু প্রমীলার জন্মস্থান কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়।’
তারপর
কয়েকটি মন্তব্য ফেইসবুকে এসেছে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেটি তা হচ্ছে
প্রমীলার জন্মস্থান প্রকৃত কোন স্থানে- তেওতা, না কুমিল্লার কান্দিরপাড়।
কেউ কেউ বিষয়টি প্রমাণিত তথ্য জানতে চেয়েছেন। এক বিব্রতকর অবস্থা।
গুরু-শিষ্যের মধ্যে জবাবদিহিতা।
আমি তখন অনুসন্ধানে ব্রত হলাম। বলে রাখি
নজরুল গবেষণায় এখন পর্যন্ত যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন এবং যাঁর
সিদ্ধান্ত স্বত:সিদ্ধ হিসেবে মান্য করি তিনি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক
ড. রফিকুুল ইসলাম। তিনি তাঁর ‘নজরুল-জীবনী’ (১৯৭২) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
‘ঢাকা
জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার তেওতা গ্রাম প্রমীলার পৈতৃক বাসস্থান ও
জন্মস্থান।’ তাঁর বাল্যনাম আশালতা সেনগুপ্তা, ডাকনাম দোলনাদেবী, সংক্ষেপে
‘দুলী’।
তিনি আরও লিখেছেন-
‘প্রমীলার পিতার নাম বসন্তকুমার সেনগুপ্ত,
তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েবের চাকুরী করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রমীলার
মাতা গিরিবালা দেবী শিশু প্রমীলাকে নিয়ে কুমিল্লায় বসন্তকুমার সেনগুপ্তের
ভ্রাতা, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের
কান্দিরপাড়ের বাসায় বাস করতে থাকেন।’
এখানে একটু ধারণাকৃত বিশ্লেষণমূলক
কথা উল্লেখ করতে হয়। গিরিবালা দেবী বসন্তকুমার সেনগুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের
স্ত্রী। বসন্তকুমার সেনগুপ্তের প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য কোথাও
উল্লেখ নেই। তিনি কি অকাল প্রয়াত, না অন্যকিছু তা জানা যায়নি। বসন্তকুমার
সেনগুপ্ত গিরিবালা দেবীকে অধিক বয়সে বিয়ে করেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের
পার্থক্য ছিল একটু বেশি। বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত-এ
দু’ভাই কুমিল্লায় চাকরিসূত্রে বসবাস করতেন। কান্দিরপাড়ের বাড়িটি যে একক
ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের তা নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে বসন্তকুমার সেনগুপ্ত
গিরিবালা দেবীকে নিয়ে কোথায় থাকতেন ? এ ক্ষেত্রে দু’টি ধারণা পোষণ করা যায়।
এক, তিনি স্ত্রীসহ ছোটভাই ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় থাকতেন। দুই,
স্ত্রীকে তেওতা গ্রামে রেখে তিনি কুমিল্লায় চাকরি করতেন। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি
নিয়ে ভাববার কারণ হলো- তেওতা গ্রামে বালিকাবধূ গিরিবালা দেবী কার সঙ্গে
থাকতেন ? তখন কি বসন্তকুমার সেনগুপ্ত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন ?
তেওতা গ্রামে আত্মীয়স্বজন থাকলেও দু’ভাই এর বাড়িঘর বসবাস করার মতো কতটা
উপযুক্ত ছিল তা জানা যায় না।
এক্ষেত্রে আমি গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেয়েছি।
১.
বসন্তকুমার সেনগুপ্ত পড়ন্ত বয়সে গিরিবালা দেবীকে বিয়ে করলেও তিনি তখন
চাকরিরত ছিলেন এবং ছোটভাই ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় সপরিবার থাকতেন।
২. বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর পক্ষে তাঁদের সন্তান আশালতার তখন জন্ম হয়।
৩. আশালতার জন্মের পর বসন্তকুমার সেনগুপ্ত প্রয়াত হয়।
৪.
তখন বিধবা গিরিবালা দেবী দেবরের সংসার থেকে সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি তেওতা চলে
যান। কিন্তু সেখানে তাঁর অবস্থান করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। একদিকে তিনি
যৌবনবতী বিধবা, দ্বিতীয়ত, দারিদ্রের কড়াল গ্রাস।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা’ গ্রন্থে প্রমীলা ও নজরুলের বিবাহ’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন-
‘ত্রিপুরা
রাজ্যের নায়েব বসন্তকুমার সেনগুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন
গিরিবালা দেবী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর একমাত্র সন্তান প্রমীলাকে
নিয়ে দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের নিকটে চলে আসেন। আর কোথাও তাঁর যাওয়ার
স্থান ছিল না।’
এ বক্তব্য থেকে ধারণা নেয়া যায় যে, গিরিবালা দেবী
স্বামীর মৃত্যুর আগে তেওতা গ্রামে ছিলেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর
কুমিল্লায় দেবরের সংসারে যখন প্রমীলাসহ চলে আসেন, তখন প্রমীলার বয়স কত ছিল ?
একই কথা আজহার উদ্দীন খান লিখেছেন-
‘তাঁর
পৈতৃক বাসস্থান ও জন্মস্থান ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জ মহকুমার তেওতা গ্রাম।
পিতার নাম বসন্তকুমার সেনগুপ্ত মায়ের নাম গিরিবালা সেনগুপ্ত। পিতা ত্রিপুরা
রাজ্যের নায়েব ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মা ও মেয়ে কাকা ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের বাসায় এসে উঠেন।’
তাহলে কি বসন্তকুমার সেনগুপ্তের চাকরিকালীন গিরিবালা দেবী ও প্রমীলা তেওতা ছিলেন ?
প্রায়
একই কথা ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেন- ‘প্রমীলার অপর নাম আশালতা। তাঁর
পিতা বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েবের পদে কাজ করতেন। পিতার
মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে প্রমীলা কুমিল্লা চলে আসেন। তাঁদের বাড়ি ছিল ঢাকা
জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত তেওতা গ্রামে।’
তাহলে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, বসন্তকুমার সেনগুপ্তের মৃত্যুর আগে গিরিবালা দেবী ও প্রমীলা তেওতা গ্রামে অবস্থান করেছিলেন।
আমি
প্রমীলার জন্মস্থান কুমিল্লায় বলে উল্লেখ করলেও আবুল কাশেম হৃদয়ের
স্ট্যাটাস ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও কুমিল্লার কথা উল্লেখ পাইনি।
এখানে আমার ছাত্র অত্যন্ত নির্ভার হয়েই স্ট্যাটাসটি দিয়েছে। এজন্য ধন্যবাদ ও
গর্ববোধ করছি।
নিজের অন্তর্গত বিশ্লেষণে এতদিন প্রমীলার জন্মস্থান যে
কুমিল্লা তা কেন ভেবেছিলাম ? এজন্য ভেবেছিলাম- প্রমীলার পিতা বসন্তকুমার
সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যে নায়েবের চাকরি করতেন এবং ছোট ভাই ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তও চাকরিসূত্রে কুমিল্লায় বাড়ির মালিক হয়ে কুমিল্লায় পরিবার সমেত
বাস করতেন। দু’ভাই একত্রে থাকবেন, এমনটা সহজ বিবেচনা ছিল। তবে বাড়িটির একক
মালিক ছিলেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত।
তাহলে কি প্রমীলাকে কুমিল্লার মেয়ে
হিসেবে দাবি করব না ? নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার প্রথম সাক্ষাৎ, পরিচয় এবং
প্রেম এ কুমিল্লাতেই হয়েছে। নজরুল তাঁকে কুমিল্লার মেয়ে হিসেবেই জেনেছেন,
মেনেছেন। এজন্য আমরাও সুক্ষ্ম তাত্ত্বিক বিচারে না গিয়ে প্রমীলাকে আমাদের
মেয়ে হিসেবেই জেনে এসেছি।
পরিশেষে বলতে চাই, ছাত্র আবুল কাশেম হৃদয়
গবেষণার নিরিখে প্রমাণসহ নির্ভার গবেষক। আমি অনুমান ও ধারণা পোষণে আবেগী
যুক্তিতে আলোচকমাত্র।