নিজের
শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন নোয়াখালীর ইউসুফ।
অন্তত পাঁচ মাস আগে রিক্রুটিং এজেন্সিকে পুরো টাকা শোধ করলেও শেষ পর্যন্ত
যেতে পারেননি মালয়েশিয়ায়। গত দুই দিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে শেষমেষ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছেন। এই টাকা
কীভাবে উদ্ধার করবেন, তা নিয়ে এখন তিনি দুশ্চিন্তায় পার করছেন দিন।
ইউসুফের
মতো এরকম স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। তবে তাদের
প্রকৃত সংখ্যা এখনও কেউ নিরূপণ করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে কর্মীদের
মালয়েশিয়া পাঠাতে শুক্রবার (৩১ মে) পরিচালনা করা হয়েছে ১২টি ফ্লাইট। এসব
ফ্লাইটে অন্তত ২ হাজার কর্মী সেদেশে গেছেন বলে জানিয়েছে বিমানবন্দরের
প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক।
শুক্রবার (৩১ মে) দুপুরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এয়ালাইন্স অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন এক নোটিশে জানায়—
৩১ মে রাত ১২টার মধ্যে ফ্লাইট ছাড়লে ১ জুন মালয়েশিয়া পৌঁছালেও সেই
কর্মীদের প্রবেশ করতে দেবে দেশটি। তবে তারিখ অনুযায়ী, ১ জুন অর্থাৎ
শুক্রবার রাত ১২টা পার হয়ে গেলে, সেই ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটের কর্মীদের গ্রহণ
করবে না মালয়েশিয়া সরকার।
শুক্রবার বিমানবন্দরে বিভিন্ন এজেন্সির ইস্যু
করা ভুয়া টিকিট নিয়ে হাজির হয়েছেন অনেক কর্মী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা
যায়, মালয়েশিয়া যেতে এজেন্সিকে ৫-৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে অন্তত ৬-৭ মাস
আগে। এতদিনেও এজেন্সি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে ভুয়া
টিকিট ইস্যু করে তাদেরকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে গিয়ে
তারা জানতে পারে টিকিটগুলো ভুয়া।
ভুয়া টিকিটের কারণে মালয়েশিয়া যেতে পারছেন না অনেক কর্মীভুয়া টিকিটের কারণে মালয়েশিয়া যেতে পারছেন না অনেক কর্মী
বিমানবন্দরে
অবস্থারত কর্মী মিনহাজ জানান, আমার কাছ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে
এজেন্সি। এরপর গত পাঁচ দিন ধরে ভোগান্তিতে পড়েছি এয়ারপোর্টে এসে।
অপর এক
কর্মী রাইসুল জানান, ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা এজেন্সিকে দিয়ে আসছি। এরপর একবার
হেড অফিস, একবার এয়ারপোর্ট, আরেকবার টিকিটের অফিসে যাওয়া-আসা করতেছি। তারা
অনলাইনে টিকিট পাঠিয়ে দিলো। কাউন্টারে গিয়ে জানলাম, এই টিকিট ভুয়া। এ রকম
হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি
কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার
অনুমোদন দেয়। ২১ মে’র পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও, মন্ত্রণালয় আরও
১ হাজার ১১২ জনকে অনুমোদন দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪
হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন।
বিএমইটি’র
তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন ১২টি ফ্লাইটে
মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়ার কথা। ওপরের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ৩১ হাজার ৭০১
জনের মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। তবে প্রকৃতপক্ষে কতজন কর্মী
মালয়েশিয়া যেতে পারেনি, তার সঠিক হিসাবও কেউ জানেন না। রিক্রুটিং
এজেন্সিদের সংগঠন বায়রা’র সভাপতি মো. আবুল বাশার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ
সংখ্যা হয়তো ৪-৫ হাজার হতে পারে। প্রকৃত সংখ্যা জানতে আগামীকাল রবিবার (২
জুন) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
টাকা দেওয়ার পরও কর্মীরা কেন মালয়েশিয়া
যেতে পারেনি তা তদন্ত করে দেখবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়। শনিবার (১ জুন) দুপুরে সাংবাদিকদের একথা জানান প্রবাসী কল্যাণ ও
বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। এ সময় তিনি
রিক্রুটিং এজেন্সির গাফিলতিকে দুষেছেন।
তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের
অনুমোদিত কোটা অনুযায়ী, কর্মী পাঠাতে আমরা বায়রার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের
সঙ্গে বারবার বসে আমরা আলোচনা করে কর্মীর তালিকা চেয়েছি। মে মাসের ১৫
তারিখে আমি মিটিং করে তাদেরকে বলেছি- ফাইনাল লিস্ট করার জন্য। ভিসা পাওয়ার
পর কতজন যাওয়া বাকি, কত জনের ভিসা আসা বাকি, এগুলো আমরা ফাইনাল তালিকা দিতে
বলেছি। কিন্তু তারা সেগুলো তৈরি করেনি এবং আমাদেরকে দেয়নি। তারা শেষ সময়ে
আমাদের জানায়- কর্মীরা রেডি আছে। কিন্তু ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখন
বিমানমন্ত্রী, বিমানের এমডি, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এরপর
২২-২৩ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর বাইরে শিডিউল ফ্লাইট তো আছেই্।’
প্রতিমন্ত্রী
আরও বলেন, ‘এত ফ্লাইট দেওয়ার পরও কর্মী যাওয়া শেষ হয়নি। এই ভোগান্তির
সৃষ্টি যাদের কারণে হয়েছে, আমরা তদন্ত কমিটি করবো। তদন্তে যারা দোষী
প্রমাণিত হবে, তাদের আইনানুগ শাস্তির আওতায় আনা হবে। যারা টাকা দিয়েছেন,
কিন্তু যেতে পারেনি, তারা আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে, দায়ীদের বিরুদ্ধে
আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার
শ্রমবাজার, আট বছর পর তা চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে
ফের ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ২০২১
সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময়
লেগেছিল তিন বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া
শুরু হয়।
মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ জুন থেকে বাংলাদেশসহ
বিদেশিকর্মীদের দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ থাকবে। নতুন নিয়মে কর্মী পাঠাতে হলে
আবারও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। গত জানুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার
মন্ত্রিপরিষদ ১৫টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি আবার রিভিউ করার অনুমোদন
দিয়েছে। দেশটি বর্তমানে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস,
ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, তুর্কমেনিস্তান,
উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রমিক নিয়ে থাকে।