![গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বল শিক্ষক-শিক্ষার্থী]( https://www.comillarkagoj.com:443/2024/05/14/CK_1715625785.jpg)
এসএসসিতে
এবার পাশের হার ও জিপিএ ৫ বেড়েছে, গতবারের তুলনায়। কুমিল্লা বোর্ডেও
দু'টোই বেড়েছে। নয়টি সাধারণ বোর্ডের সার্বিক ফলাফলে । তবে জিপিএ ৫
প্রাপ্তিতে মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের চিত্র ভিন্ন। ফলাফল ভালো হওয়ার কারণ
ইংরেজি ও গণিতে ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা। এ দু'টো কঠিন বিষয়ই সামগ্রীক
ফলাফল ভালো- খারাপের প্রধান নিয়ামক। এবার গড় পাশের হার ৮৩ দশমিক ৭৭ ভাগ।
কুমিল্লা বোর্ডে ৭৯ দশমিক ২৩ ভাগ। পাশের হারে শীর্ষে যশোর, সর্বনি¤েœ
সিলেট। কুমিল্লা বোর্ডের স্থান ৭ম। ৬ জেলা নিয়ে কুমিল্লা বোর্ড। চাঁদপুর
জেলায় পাশের হার বেশি, আর জিপিএ ৫ কুমিল্লা জেলায় বেশি। কুমিল্লা বোর্ডে
সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে কুমিল্লা মর্ডাণ হাই স্কুল।
যারা পাশ করে নি
তারা গণিতে বেশি ফেল করেছে। এরপর ইংরেজিতে। ৯টি সাধারণ বোর্ডের একই
চিত্র। তবে গণিতে সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এরপরই
কুমিল্লা বোর্ড। কেন, একটা কারণ গণিতের প্রশ্ন তুলনামূলক কঠিন হয়েছিল ঢাকা ও
কুমিল্লা বোর্ডে । এতে অন্য বোর্ডের তুলনায় কুমিল্লা বোর্ডের জিপিএ ৫ও
কমেছে। ৫ টি শিক্ষা বোর্ডে গণিতে পাশের হার ৯০ ভাগের নীচে।
শুধু এসএসসি
নয় এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গনিত ও ইংরেজি বিষয় সব সময়ই প্রভাব ফেলে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, গণিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব এবং
প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিতের দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলের প্রধান
কারণ। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে গণিতে দক্ষ শিক্ষকের খুবই অভাব। বিশেষ করে
মাধ্যমিকে যারা গণিত পড়াচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই স্নাতকে গণিত পড়েন নি। ফলে
শিক্ষার্থীদের ওপর এর একটা প্রভাব পড়ছে।
একই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ
শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যানেও। ২০২১
এর তথ্যানুযায়ী, মাধ্যমিকে গণিত পাঠদান করা শিক্ষকের ৮১ ভাগই স্নাতকে গণিত
পড়েন নি। ইংরেজির অবস্থা আরও নাজুক। ইংরেজি শিক্ষকের ৮৪ ভাগেরই সংশ্লিষ্ট
বিষয়ে ডিগ্রি নেই। তাঁরা গণিত ও ইংরেজিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন
নয়। অংক ও ইংরেজি শিক্ষকের অধিকাংশই ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রিধারী। একে ভয়াবহ
বিপর্যয় বলা যেতে পারে।
চাকরি,ব্যবসা বাণিজ্য থেকে উচ্চ শিক্ষা
সবক্ষেত্রেই ইংরেজিতে দক্ষতা জরুরি। আর বিশ্বের সব শিক্ষা ব্যবস্থায়
গুরুত্ব দেয়া হয় গণিত শিক্ষাকে। দেশের মাধ্যমিক পড়ুয়াদের বড় অংশই স্কুল
জীবন শেষ করছে এ দু'টি বিষয়ে দুর্বলতা নিয়ে।
এবার সরকারি আর বেসরকারি
কার অবস্থা কি রকম একটু দেখার চেষ্টা করি। বিষয় ডিগ্রিধারী শিক্ষকের দিক
থেকে বেসরকারির তুলনায় সরকারি স্কুলের চিত্র ভালো। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে
ইংরেজিতে ডিগ্রিধারী ইংরেজি শিক্ষক মাত্র ৩০ ভাগ। অন্যদিকে বেসরকারি
স্কুলের অবস্থা ভয়াবহ। অর্ধেক ১৫ ভাগ। সরকারিতে গণিতে ৩৫ ভাগ, বেসরকারিতে
অর্ধেক ১৮ ভাগ। আর মাধ্যমিকের অধিকাংশ স্কুলই বেসরকারি।
প্রশিক্ষণেও পিছিয়ে গণিত ও ইংরেজির শিক্ষকরা। পাঠদানে নিয়োজিত ৫৫ ভাগ শিক্ষককেরই প্রশিক্ষণ নেই।
শিক্ষকদের
যোগ্যতা ঘাটতির এ প্রভাব পড়ছে পড়ুয়াদের শিখনফলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়ারা
গণিতের তুলনায় ইংরেজিতে বেশি খারাপ, দক্ষতা বিবেচনায় । ৬১ ভাগ পড়ুয়া
ইংরেজিতে বেশিই খারাপ। যার মধ্যে ২৯ ভাগের অবস্থা খুবই খারাপ। মোটামুটি
ভালো ১৮ ভাগের মতো। আর গণিতে খুব ভালো ৫ ভাগ। ৩৩ ভাগ মোটামুটি ভালো। ৪৩ ভাগ
খারাপ। এরমধ্যে ১৩ ভাগের অবস্থা খুবই খারাপ।
অষ্টম শ্রেণি ইংরেজিতে ২৮
ভাগ মোটামুটি ভালো। ২৫ ভাগ খুবই ভালো। একই বিষয়ে দশম শ্রেণি তুলনামূলক
ভালো। সাড়ে ১২ ভাগ খারাপ। বাকিরা মোটামুটি ভালো, ভালো ও খুব ভালো। অষ্টম
শ্রেণি গণিতে ২২ ভাগ খারাপ, মোটামুটি ভালো ৩৬ ভাগ। বাকিরা ভালো ও খুবই
ভালো। একই বিষয় দশম শ্রেণিতে খুব খারাপ নেই। ৭ ভাগ খারাপ। ভালো ৩৮ ভাগ।
বাকিরা খুব ভালো।
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়াদের দক্ষতার মান ভাল নয়।
অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণি পড়ুয়াদের ইংরেজি ও গনিতে দক্ষতা মান ভালো। এর কারণ
কি। শিক্ষা ব্যবস্থা পাবলিক পরীক্ষা - মাধ্যমিকে এসএসসি নির্ভর। শিক্ষা
ব্যবস্থা বার্ষিক শ্রেণি ভিত্তিক হলেও কার্যত বোর্ডের এসএসসি ফলাফল
ভিত্তিক। তাই অষ্টম শ্রেণি থেকে গুরুত্ব পায়। তার আগে এতোটা গুরুত্ব মেলে
না। শিখনফল বিশ্লেষণে এমনটাই ওঠে আসে। এসব তথ্য মিলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ
শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ২০১৯ সালের গবেষণা প্রতিবেদনেও। তার মানে দাঁড়ায়
শিক্ষকদের যতটুকু দক্ষতা আছে তারও পুরোপুরি পায় না ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি
পড়ুয়ারা। যতটা পায় অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণি পড়ুয়ারা। সেখানে বোর্ডের বাধ্য
করার বিষয় আছে, হয়তো তাই।
এবার দেখি প্রাথমিকে বিষয় ডিগ্রিধারী
শিক্ষককের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করা এক
শিক্ষার্থীর গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্কুলে যারা গণিতে ডিগ্রিধারী
তাদের পড়ুয়ারা গণিত ভালো শিখছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই। অন্যদিকে যিনি
ম্যানেজমেন্ট পড়ে এসে গণিত পড়াচ্ছেন তার পড়ুয়াদের দক্ষতার হার ছিল সবচেয়ে
কম। তাহলে প্রাথমিকেই শিখনফল কাঙ্ক্ষিত মানে যেখানে তারা নিতে পারছেন না,
মাধ্যমিকে তো সেটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। প্রাথমিকে পুরুষের দ্বিগুণ নারী
শিক্ষক।
শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, যে সব শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নূন্যতম
গ্র্যাজুয়েশন- স্নাতক ডিগ্রি নেই, তাঁদের দিয়ে পাঠদানে কোনভাবেই কাঙ্খিত
শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। শুধু গণিত, ইংরেজি নয় বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়েও
বিষয় ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দেয়া জরুরি, নতুন নিয়োগে। মাধ্যমিক শিক্ষার
অধিকাংশ স্কুলই বেসরকারি। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া
হলেও, আগে নেয়া শিক্ষকদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষার মান মানে প্রথমত
শিক্ষককের যোগ্যতা। মানসম্মত শিক্ষা মানেই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক। অথচ
যোগ্য শিক্ষক নিয়োগসহ এই বিষয়গুলো বেশ অবহেলিত। যোগ্য শিক্ষক না পাওয়ার
মানে তাদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। শিক্ষাকে অবহেলায় রেখে কোন
উন্নয়নই টেকসই হবে না। শিক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও
তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
শিক্ষকদের ভাষ্য, গণিত তুলনামূলক
কঠিন বিষয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই গণিতে প্রাথমিক থেকে দুর্বলতা থাকে, যা
পরে কাটিয়ে উঠতে পারে না। শিক্ষার্থীদের গণিত চর্চা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা যতবেশি গণিত চর্চা করবে ততোবেশি দক্ষ হয়ে ওঠবে। দুর্বলতা দূর
করতে অবশ্যই গণিত চর্চায় জোর দিতে হবে। আর গণিত ও ইংরেজি শিক্ষার্থীদের
কাছে কঠিন লাগে। ভয় কাজ করে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও অনেকটা একই
অবস্থা। তাই শিখন পদ্ধতি গতানুগতিক না হয়ে আর্কষণীয় ও সহজ বোধগম্য হলে
রপ্ত করতে সহজ হয়, বুঝে নেয়া যায় সহজে। তার মানে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব,
শিক্ষার অভাব। শিক্ষকদের মতে, গণিতে ভয় বেশি আর ইংরেজিতে দুর্বলতা।
পাশাপাশি
পড়ুয়াদের স্মার্ট ফোন ব্যবহার নিয়ে ভাবা দরকার। স্মার্টফোন ব্যবহার
নিষিদ্ধ করে ভালো ফল পাচ্ছে আমেরিকা- মার্কিন এক হাইস্কুল। নিষেধাজ্ঞার ফলে
স্কুল পড়ুয়াদের একাডেমিক ও সামাজিক জীবন উভয়ই উন্নত হয়েছে। এটা বাস্তব
উদাহরণ মাত্র। আমাদের বাচ্চাদের ও কিশোরদের শৈশব- কৈশোর কাটছে এক ভয়ানক
আসক্তিতে। রাত ১২ টার পর ইন্টারনেট বন্ধ রাখা উচিত বলে দু'বছর আগে মন্তব্য
করেছিলেন আমাদের একজন মন্ত্রী। স্মার্টফোন আসক্তি, সামাজিক ও শারীরিক
প্রভাব নিয়ে আমাদেরও নানা পরিণতিও আলোচনা রয়েছে।
ছেলেরা কেন লেখা- পড়ায়
পিছিয়ে যাচ্ছে তাও ভেবে দেখা দরকার। মেয়েরা ভালো করছে। এবারের এসএসসি
ফলাফলেও এমনটাই দেখা গেছে। গত কয়েক বছর ধরেই এমনটা চলছে। মেয়েরা বেশি
পরীক্ষা দিচ্ছে, পাশ করছে, জিপিএ ৫ পাচ্ছে।
শিক্ষার মান ও মানোন্নয়নে
করণীয় নির্ধারণ করতে আমাদের আর কতো সময় লাগবে। শিক্ষা পদ্ধতি, কারিকুলাম,
শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, তদারকি সব লেজেগোবরে অবস্থায় আছে। উত্তরণের পথও
খুঁজতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।