জাতীয়
শিক্ষানীতির আলোকে দীর্ঘদিন পর আবারও প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণি
পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা বিভাগ। এর অংশ
হিসেবে প্রথমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হচ্ছে। এ জন্য
আপাতত শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে তাদের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক বা নামকাওয়াস্তে বেতনে পড়ার
ব্যবস্থা করবে।
তিন বছর ধরে প্রস্তুতির পর সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রাথমিক ও
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সরকারের এমন
সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে।
বর্তমানে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম
শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর
অষ্টম শ্রেণি ও মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা
আছে। ছয় বছর পর ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার
ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকার সেটি বাস্তবায়ন করেনি।
বিষয়টি ৫ মে
আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় নতুন করে আলোচনায় আসে। সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের
কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা
মন্ত্রণালয় অবৈতনিক পাঠদান কার্যক্রম ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
বিস্তৃত করবে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নি¤œমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাব্যয় কমিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার
সুযোগ করে দিতে কাজ করবে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী
বলেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শিক্ষাকে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
অবৈতনিক করা, যাতে শিক্ষার্থী ঝরে না পড়ে। এই লক্ষ্যে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়
তাদের বিদ্যালয়গুলো পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যায়ে উন্নীত করবে। তারা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় নি¤œমাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
শিক্ষার্থীদের বেতন কমানোর কাজ করবে।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রে
জানা গেছে, এরই মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনগুলোতে ষষ্ঠ, সপ্তম ও
অষ্টম শ্রেণি চালু করা যায়-এমন বিদ্যালয়ের তথ্য দিতে বিভাগীয় ও জেলা
পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
জানতে
চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতির
আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত আছে। সে জন্য
প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আলোচনা হয়েছে তিন বছর প্রস্তুতি শেষে একপর্যায়ে
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার ঘোষণা দেওয়া
হবে।
দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) প্রাথমিক
বিদ্যালয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অবশ্য
জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ৬৯৬টি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু আছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট
ব্যক্তি ও শিক্ষকেরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করে
অবৈতনিক করার সিদ্ধান্তটি ভালো। ২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে এটি করার
কথা বলা আছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার (এসডিজি) বিবেচনায় রাষ্ট্রীয়
খরচে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষার পথে এক ধাপ এগিয়ে থাকা। এটি
একদিকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে কাজে দেবে। অন্যদিকে যেখানে বর্তমানে
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে তেমন কাজে আসে না, সেখানে অষ্টম
শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কোনো শিক্ষার্থী
চাইলে অষ্টম শ্রেণি শেষে কারিগরি শিক্ষার সুযোগও নিতে পারবে।
তবে এর
সুফল পেতে বিদ্যালয়গুলোতে প্রাথমিকের সঙ্গে নি¤œ মাধ্যমিক স্তর (ষষ্ঠ থেকে
অষ্টম) পর্যন্ত চালুর আগেই শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষসহ পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে ও
পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। না হয় সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা আছে।
জাতীয়
শিক্ষানীতির আলোকে কয়েক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে যে ৬৯৬টি সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়েছে, তার মধ্যে দুটি
বিদ্যালয়ে গিয়ে অভিন্ন কিছু সমস্যার কথা জানা গেছে। বড় সমস্যা হলো মাধ্যমিক
পর্যায়ে পড়ানোর জন্য আলাদা শিক্ষক নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য
নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাই পড়াচ্ছেন। অথচ মাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগ হয়
বিষয়ভিত্তিক। এ ছাড়া তদারকি ও যথাযথ নির্দেশনার অভাবও আরেক সমস্যা। কেননা
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন
আর ষষ্ঠ থেকে শুরু হওয়া মাধ্যমিক শিক্ষা চলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা
অধিদপ্তরের অধীন।
ওই দুই বিদ্যালয়ের একটি পুরান ঢাকার গণকটুলী সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫ মে এই বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, এখানে সব মিলিয়ে
শিক্ষার্থী ৬২৮ জন। তাদের মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে প্রায়
আড়াই শ। যদিও এসব শ্রেণির জন্য আলাদা শিক্ষক নেই। বর্তমানে শিক্ষকের ১৫টি
পদের মধ্যে আছেন ১৪ জন। শিক্ষকসংকটের কথাও জানালেন একাধিক শিক্ষক।
জানা গেল, মূলত মাধ্যমিক স্তরে পড়ানোর জন্য আলাদা করে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি।
প্রায়
একই চিত্র মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অবশ্য এখানে অবকাঠামো ভালো। ১
হাজার ১৫৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ৪১৫ জন। মোট
শিক্ষক ২৫ জন।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু হলেও তদারকি ও নির্দেশনার যথেষ্ট অভাব আছে।
মতিঝিল
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদা প্রথম আলোকে
বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করার উদ্যোগ ভালো।
একই সঙ্গে শিক্ষকসংকটও দূর করতে হবে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশের প্রাথমিক
বিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে। আবার শিক্ষক নিয়োগও হয়েছে সেভাবে। এ অবস্থায় এসব
বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি
দরকার।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, সারা দেশে
সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালুর প্রয়োজন
হবে না। যেগুলোতে সুবিধা আছে এবং যেখানে প্রয়োজন, সেখানে কেবল তা করা হবে।
এখন আলাদা করে শিক্ষকের পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
দরকার ‘সর্বজনীন বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম’:
অষ্টম
শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে তাঁদের চাওয়া, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
(এসডিজি) অনুযায়ী ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে
সর্বজনীন শিক্ষা চালু করা হোক।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস
অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করার চিন্তাটি বেশ
আগের; এখন বরং এসডিজিসির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি
পর্যন্ত সর্বজনীনভাবে অবৈতনিক শিক্ষা করা উচিত। আর এ জন্য ‘সর্বজনীন
বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম’ শুরু করা দরকার।
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে
দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন,
‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই। এটি
এসডিজি অনুযায়ী দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে সর্বজনীন শিক্ষার
পথে এক ধাপ অগ্রগতি। তবে ব্যবস্থাপনাগত যে গলদ আছে, সেগুলোও দূর করতে
হবে।’