শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
আসিম জাওয়াদ জীবন্ত প্রাণ, এক অঙ্কুরিত বীজ
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
প্রকাশ: রোববার, ১২ মে, ২০২৪, ১২:৪৫ এএম |

 আসিম জাওয়াদ জীবন্ত প্রাণ, এক অঙ্কুরিত বীজ

সবাই দীর্ঘায়ু চায়। কিন্তু পায় কয়জনে? আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারে অনেকেই অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু ‘দীর্ঘজীবন’ সে যেন আজও এক অজানা রহস্য। মৃত্যু বাস্তব সত্য। প্রকৃতির অঘোম নিয়মে মানুষকে জীবনের কোনও এক পর্যায়ে অন্যলোকে পাড়ি জমাতে হবে। কিন্তু কখন কে পাড়ি জমাবে তা আজও আমাদের গণিত, বিজ্ঞান কেউই বলতে পারেনি। মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্নের মতো ওই প্রশ্নেরও আজও জবাব মেলেনি।
একজন ব্যক্তির কতদিন বাঁচা উচিত এক জীবনে? বিজ্ঞানের অনুসঙ্গ পরিসংখ্যান ঘেটে মানুষের গড় আয়ুর ধারণা পাওয়া যায় বটে কিন্তু উপর্যুক্ত প্রশ্নের জবাব মেলে না বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন বা জ্ঞানের নানা শাখা-উপশাখা পত্রপল্লবে। অবশ্যই একজন ব্যক্তির কতদিন দেহধারণ করা উচিত সেই প্রশ্নের উত্তর না মিললেও ধর্ম আর ইতিহাসও মানুষের আয়ুকাল নিয়ে কিছুটা ধারণা দিয়েছে।
হজরত নূহ (আ.)-এর সময়ে মানুষের গড় আয়ু ছিল হাজার বছরের ওপরে। কুরআনের মতে, হজরত নূহ (আ.) প্রায় হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। আল কুরআন-এর ভাষায়: “আমি অবশ্যই নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে ওদের মধ্যে অবস্থান করেছিল সাড়ে নয়শত বছর।” (সূরা আলআনকাবুত, ১৪)।
নূহের পরে ধীরে ধীরে ধারাবাহিকভাবে মানুষের আয়ু কমেছে। ইসলাম ধর্মের শেষ নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময়ে মানুষের আয়ু গড়ে সত্তর বছরে ঠেকেছে। রাসুল হজরত মুহাম্মাদের (সা.) সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-এর বর্ণনা মতে, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের আয়ু ষাট থেকে সত্তর বছরের মধ্যে, কম লোকই এ বয়স অতিক্রম করবে। (জাআমিআ আততিরমিজী: ২৩৩১ ও ইবন মাজাহ: ৪২৩৬)।
২০২৪ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। উম্মতে মুহাম্মাদীর অনুসারি বাংলাদেশিরা তাই হাদিসে বর্ণিত গড় আয়ুর বেশি জীবন পাচ্ছেন। কিন্তু এই ষাট বা সত্তর বছর বেঁচে থাকাই কি জীবনের সার্থকতা?
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বেঁচে ছিলেন মাত্র একুশ বছর। তিনি ১৫ আগস্ট ১৯২৬ সালে কলকতার কালীঘাটের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটে তার মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এর ঠিক বিশ বছর পর একুশ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড অ্যান্ড কিওর হোমে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্তের একুশ বছর তাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। মানুষের দেহ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিলীন হয়। মহাৎ কাজ ও সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ হাজার বছর বেঁচে থাকে। একুশ বছর বয়সে দেহত্যাগ করা কবি সুকান্ত তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছেন। ওই মহৎ সৃষ্টিকর্মই হয়তো তাকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে।
কবি সুকান্তের মতো তার কবিতা “চরমপত্রে” অনুপ্রাণিত হয়ে যারা একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের দিনগুলোয় জেগে উঠেছে শহরে-গ্রামে, ক্ষুব্ধ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত করেছে ‘স্বাধীনতা চাই,’ তারাও অল্প বয়সে দেহত্যাগ করলেও আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আজও আমরা স্মরণ করছি। তাদের রক্তের ঋণে কেনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার নাগরিকেরা যত দিন এই রাষ্ট্র টিকে থাকবে ততদিন একাত্তরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করবে।
সাত বীরশ্রেষ্ঠের জীবনের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকও অমন মহৎ জীবনের কথা বলে। তারাও দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য একাত্তরে অল্প বয়সে প্রাণোৎসর্গ করেন। মা, মাটি, মানুষের জন্য তারা আত্মত্যাগ করে পাড়ি জমান অন্ততলোকে। বাংলার মা, মাটি ও মাতৃভূমি সবসময়ে ধন্য হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠদের মতো প্রাণোৎসর্গকারী সন্তানদের রক্ত স্নানে। তার সর্বশেষ উদাহরণ বিমান বাহিনীর অকুতোভয় বীরসেনা স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের আত্মোৎসর্গের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর যশোর সেনানিবাস দখল করে। মুক্তিবাহিনীর পরবর্তী লক্ষ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি খুলনা দখল করা। পদ্ম, পলাশ ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট পাভেল খুলনায় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর নৌ ঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ওই যাত্রায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন পলাশের সঙ্গী ছিলেন। দুর্ঘটনায় যখন পলাশ ডুবতে বসেছে তখন তিনি তার জীবনের শেষরক্তবিন্দু দিয়ে দেশের সম্পদ পলাশ রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ১৯৩৫ সালে নোয়াখালির বাঘপাঁড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দেশের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। তিনি চাইলে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরীর আদেশ মেনে নিরাপদে পলাশ ত্যাগ করে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। দেশের সম্পদ পলাশ রক্ষায় জীবনের শেষমুর্হূত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন।
বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিনের মতো বীরসেনা স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সম্পদ প্রশিক্ষণ বিমান রক্ষায় ওই বিমানকে নিরাপদে অবতরণ করার সব চেষ্টা করেছেন। এছাড়া তিনি সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায়ও চেষ্টা করেছেন। প্রশিক্ষণ বিমানে চট্টগ্রামের যে এলাকার আকাশে আগুন ধরেছিল সেই এলাকায় যদি বিমান বিধ্বস্ত হতো তাহলে অনেক সাধারণ মানুষের প্রাণ যেত। ওই এলাকা ঘনবসতি পূর্ণ হওয়ায়, বসতবাড়ি, স্কুল, কলেজ, অফিস ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় বিধ্বস্ত বিমানের আগুনে জান ও মালের অপরিসীম ক্ষতি হতো। তাই তিনি তার সহযোদ্ধাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ বিমানটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে গভীর জলে অবতরণ করান। তার ওই বিচক্ষণতা ও অসীম সাহসিকতায় বহুপ্রাণ ও সম্পদ রক্ষা পায়।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি কবিতার “কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি,” আক্ষেপও ঘুছিয়েন আত্মৎসর্গকারী বীরসেনা স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ।
১৯৯২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আসিমের কথা রাখতে তেত্রিশ বছর বয়স হবার দরকার হয়নি। বত্রিশ বছরেরই তিনি কথা রেখেছেন। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হয়েও দেশ-মাতৃকার সেবা করার স্বপ্ন অন্তরে লালন করে তিনি বিমানবাহিনীতে নাম লেখান। ‘সমরে দেহি মোরা প্রাণ’ মূলমন্ত্রে তিনি মা মাটি ও মানুষের রক্ষায় যে শপথ নেন তা অক্ষরে অক্ষরে তিনি পালন করেছেন। মাত্র ৩২ বছরে প্রাণোৎসর্গ করে তিনি দেশ মাতৃকার সেবা করার স্বপ্নপূরণ করেছেন।
দ্বিগবিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের মতো মাত্র ৩২ বছর বয়সে আসিম জাওয়াদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আলেকজান্ডারকে মৃত্যু নয়, তার দ্বিগবিজয় তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করেছে। কিন্তু আসিম জাওয়াদ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেছেন। দ্বিগবিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের চেয়েও তাই আসিম জাওয়াতের মৃত্যু মহামূল্যবান।
আলেকজান্ডারকে দ্বিগবিজয় বীরের খ্যাতি এনে দিলেও আসিম জাওয়াতের মৃত্যুই তাকে মহাবীরের মর্যাদা দিয়েছে। হাজার বছর দেহধারণ নয়, মাত্র বত্রিশ বছরে অন্যের প্রাণরক্ষায় আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে হাজার বছর বেচে থাকা যায়, জীবন পূর্ণতা পায় তা আবারও আসিম জাওয়াদ প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশ যত দিন বেঁচে থাকবে বীর সেনানী আসিম জাওয়াদকে স্মরণ করবে। তিনি প্রাণ রক্ষায় প্রাণোৎসর্গকারী মহান ব্যক্তিদের মধ্যমনি হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। এরচেয়ে মহৎ জীবন আর কী হতে পারে!
কবি সুকান্তের আগামী’র ভাষায় শহীদ স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ আমাদের কাছে ‘জড় নন, মৃত নন, নন অন্ধকারের খনিজ। তিনি তো জীবন্ত প্রাণ, তিনি এক অঙ্কুরিত বীজ।’
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়












সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft