ভারত বিদ্বেষকে উস্কে দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভারততোষণেও কি দলটি কম যায়? বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিএনপির দুই সিনিয়র নেতার দুটি বক্তব্য প্রকাশের পর। ১৯ মার্চ, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের সহযোগিতা চাইলেন।
তাদের দলীয় এক নেতার বাসায় গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভারতের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন। ভারত বিরোধী দল হিসেবে আলোচিত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যের মুখ থেকে এমন ভারতবন্দনা শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই চোখ বড় করে তাকাতে হয়েছে। প্রশ্ন এসেছে-বিএনপি কি তাহলে ঘুরতে শুরু করেছে?
কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না যেতেই এবাউট টার্ন করে দিলেন দলের আরেক প্রবীণ নেতা ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ৬৩ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশকালে কেউ কিছু বোঝার আগেই নিজের গায়ের কাশ্মিরি শালটি ছুরে মারেন। সবার সামনেই সেই শালে আগুন জ্বালানো হয়।
বিপ্লবী ঘোষণা এলো নয়া পল্টনের বিএনপি অফিস ভবন থেকে। তিনি যেমন ভারত থেকে আনা কাশ্মিরি শালটি পুড়িয়ে দিয়েছেন,তেমনি সবাই যেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করে। ঘোষণা দিলেন ভারত খেদাও আন্দোলনের। শীত কেটে যাওয়ার পর শাল পোড়ানোর এই ঘটনা নিয়ে চায়ের টেবিলে হাস্যরস যতই হোক না কেন, দলটির পরস্পর অবস্থানের কারণে রাজনীতির লেখক/গবেষকদের নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে না পেরে এই মুহূর্তে ভারত বিরোধিতা এবং ভারতের পক্ষে বলার মাধ্যমে আলোচনায় আসাটা কৌতূহল জাগানো বটে। সিনিয়র দুই নেতার দ্বিমুখী বক্তব্য এবং কর্মকা- দেখে মনে হতেই পারে আসলে তারা দলীয় সিদ্ধান্ত বিষয়ে কোনো মৌলিক নীতি-রীতির ধার ধারেন না।
ড. মঈন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং যথেষ্ট জ্ঞানী মানুষ। তিনি যখন গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য ভারতের সহযোগিতা চান তিনিও মাত্র কয়েক মাস আগে তাদের দলীয় অবস্থানের কথা ভুলে যান। প্রকাশ্যে তার দলটি অভিযোগ করেছিলো বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করছে বলে।
নির্বাচন হয়ে গেছে। তারা অভিযোগ করেছে- নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ভোটার উপস্থিত হয়নি ইত্যাদি। কিন্তু তাদের পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ দেওয়া সম্ভব হয়নি, ভারত কোন কোন স্থানে এবং কিভাবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে।
জনাব মঈন খানের সর্বশেষ বক্তব্য থেকে ধরে নেয়া যায়-তিনি উপলব্ধি করেছেন ভারত আসলে গণতন্ত্র কায়েমে সহযোগিতা করে এবং সেই জন্যই তিনিও তাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরের একটি উদৃতি এই ঘটনাসূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন,‘বিএনপির আন্তর্জাতিক-কূটনৈতিক পলিসি নিয়ে কোনও রকম দ্বিমতের অবকাশ নেই। দলের কা-ারি তারেক রহমান পরিষ্কার করেই বারবার বলেছেন, বাংলাদেশ সবার বন্ধু। বিএনপি ও বাংলাদেশ সবার সমান বন্ধু।’
ড. মঈন খানের ভারত বিষয়ক ইতিবাচক মন্তব্যে এর প্রতিফলন দেখা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একই নেতার বক্তব্যের শেষের অংশ ছিলো ‘বিএনপি দেশের স্বার্থের পরিপন্থি যেকোনও কিছুর বিরুদ্ধে। এখন দেশের গণতন্ত্র ব্যাহত করতে যদি কেউ এই সরকারকে সহযোগিতা করে থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিএনপিরও তাকে বন্ধু মনে করাটা খুব সহজ বা স্বাভাবিক নয়।’ তাঁর এই বক্তব্যের শেষাংশের প্রতিফলন কি জনাব রিজভীর শাল পোড়ানোর ঘটনায় ঘটেছে? অর্থাৎ জনাব মঈন খান ভারতকে বন্ধু মনে করেছেন । অন্যদিকে রিজভী সাহেব মনে করেছেন, ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্র ব্যাহত করতে ভূমিকা রেখেছে তাই তিনি এবং বিএনপি ভারতকে বন্ধু ভাবতে পারছে না।
আসলে বিএনপি ভারত সম্পর্কে কোন দৃষ্টিভঙ্গীকে ধারণ করে? শুধু মঈন খানের এই বক্তব্যই নয় তাদের দলের আরও সিনিয়র নেতাও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় চেষ্টা করেছেন। এমনকি নির্বাচন এলে মুখে তারা ভারত বিরোধিতা করলেও তলে তলে ভারতের সহযোগিতাও চেয়েছে।
এটা শুধু সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগেই নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও দেখা গেছে। ওই সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির দিল্লী সফর করেছিলেন। তখন বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়েছিলো ভারতীয় সহযোগিতা চাইতেই তারা দিল্লী সফর করেছেন।
দ্বাদশ নির্বাচনের আগেও বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা ভারতীয় হাই কমিশনে গিয়ে দেন-দরবার করেছেন। হাই কমিশনে গিয়ে দাওয়াতও খেয়েছেন। ঠিক খাওয়া শেষে আবার ভারত বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণও হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ রিজভী আহমেদের ভারত হটাও আন্দোলনের পর বলতে হয়, বিএনপি আগে যেসব চেষ্টা তদবির করেছে তা ছিলো তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। এখন তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে ভারতকে তার জবাব দিতে চান।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা বলতে একটা কথা আছে। তিনি যখন নিজের কাশ্মিরি শালে আগুন জ্বালিয়ে ভারত হটাও আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন,সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজার ১২০টাকা থেকে কমে ৬০টাকা হয়েছে। আলাদীনের চেরাগের বদৌলতে নয়-ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির ফল এটা।
যে মুহূর্তে ভারতের পেঁয়াজ আসা বন্ধ হয়- ধাই ধাই করে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। যে মুহূর্তে চিনি, আদা,মরিচ,হলুদ আসা বন্ধ কিংবা স্থগিত হয়ে যায়, তখনই বাজার চড়া হয় অকল্পনীয়ভাবে। এগুলো হচ্ছে সাদামাটা হিসাব। এমন অসংখ্য পণ্য আছে যা ভারত থেকে না এলে আমাদের বাজার ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। সেই অবস্থায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক রিজভী সাহেবের রাজনৈতিক অর্জনে কতটা সহায়ক হবে?
রিজভী সাহেবের শাল পোড়ানোর সংবাদ প্রচার হওয়ার সঙ্গে একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে-শীত পেরিয়ে গেছে তাই তিনি শাল পুড়িয়েছেন। কিন্তু অসংখ্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা কি শেষ হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের মানুষ পেঁয়াজ রসুন আদা মরিচকে পুড়িয়ে দেবে?
রিজভী সাহেবের শাল পোড়ানো কর্মসূচি বিষয়ে বিএনপির ভিতরেই ভিন্ন সুর শোনা যায়। ৬৩টি রাজনৈতিক দলের প্রতি সংহতি জানাতে বিএনপির এই নেতা কাশ্মিরি শাল বাসা থেকে আনিয়েছেন। অর্থাৎ পরিকল্পনা করেই তিনি এই কাজটি করেছেন। কিন্তু দলের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য হচ্ছে এই বিষয়ে দলীয় সিনিয়র নেতারা অবহিত নন। তার মানে হচ্ছে- ৬৩টি দলের সঙ্গে তিনি যে সংহতি প্রকাশ করলেন সেখানেও খাদ রয়ে গেছে। আসলে বিএনপির লক্ষ্য কি এমন প্রশ্নই আবার সামনে আসছে। তারা কি আন্তর্জতাকি বিষয়েও তাদের নীতিমালা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্থ।
অকালে শাল পুড়িয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ তৈরি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সফল হয়েছেন বলা যায়। কিন্তু কাশ্মিরি শালে আগুন লেগে ধোঁয়া এবং গন্ধও যে তৈরি হয়েছে। সেই ধোঁয়াতেই আচ্ছন্ন হচ্ছে বিএনপির বৈদেশিক নীতি। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়-তারা নিজেরাও যেন জানে না তারা কি চান।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।