নিজস্ব
প্রতিবেদক: তাসকিন আহমেদের লেংথ ডেলিভারি মিড অনের দিকে ঠেলে দ্রুত দুই
রান নিলেন তাওহিদ হৃদয়। ক্রিজে পৌঁছেই তার কণ্ঠে শোনা গেল গর্জন। পরে
লাফিয়ে ছুঁতে চাইলেন যেন আকাশ। উঁচিয়ে ধরলেন ব্যাট। তখনও ম্যাচ জেতেনি
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তবে তার মন মাতানো সেঞ্চুরিতে জয় তখন কেবল সময়ের
ব্যাপার। একটু পরে ম্যাচ জিতিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আরেক দফায় উদযাপনে মেতে
উঠলেন তরুণ ব্যাটসম্যান।
এমন উচ্ছ্বাস তার প্রাপ্যই। ম্যাচটিই যেন
হৃদয়ময়! টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরিতে ১০৮ রানের অপরাজিত ইনিংস
খেললেন তিনি। তার ৫৭ বলের ইনিংসেই দুর্দান্ত ঢাকাকে ৪ উইকেট হারাল
কুমিল্লা।
এবারের বিপিএলের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হৃদয়। সব আসর মিলিয়ে সেঞ্চুরি করা বাংলাদেশের ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান তিনি।
মিরপুর
শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুক্রবার চলতি আসরে প্রথমবার দেড়শ
পেরোয় ঢাকা। তবে তাদের ১৭৫ রানের স্কোর এক বল বাকি থাকতেই পেরিয়ে যায়
বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।
কুমিল্লাকে হারিয়ে যাত্রা শুরু করা ঢাকা এই নিয়ে
হারল টানা সাত ম্যাচ। বিপিএলের ইতিহাসে টানা পরাজয়ের রেকর্ড স্পর্শ করল
তারা। ২০১২ সালে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে টানা সাত ম্যাচ হেরেছিল সিলেট
রয়্যালস।
রান তাড়ায় কুমিল্লার ওপেনাররা ব্যর্থ হলে দায়িত্ব নেন তিন
নম্বরে নামা হৃদয়। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলা তরুণ ব্যাটসম্যান চলতি আসরে
নিজের প্রথম পঞ্চাশ পূর্ণ করেন ৩২ বলে।
সেখান থেকে একশতে যেতে তার লাগে স্রেফ ২১ বল। নান্দনিক ব্যাটিংয়ে ৮ চারের সঙ্গে ৭টি ছক্কা মারেন তিনি।
প্রতিপক্ষের
দুই সেরা বোলার তাসকিন ও শরিফুল ইসলামকেই নিশানা বানান হৃদয়। টানা দ্বিতীয়
ম্যাচে ঢাকাকে নেতৃত্ব দেওয়া তাসকিনের ১১ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কাসহ ২৯ রান
নেন তিনি।
শরিফুলের ৭ বল থেকে তিনি করেন ১৫ রান।
তবে রান তাড়ার পথে
দলকে বড় এক ধাপ এগিয়ে নেন তিনি সাইফ হাসানের এক ওভারে। ৬ ওভারে যখন প্রয়োজন
৬৮ রান, সাইফের অফ স্পিনে তিনি মারেন ৩টি ছক্কা।
গত আসরে দারুণ
ব্যাটিং করা হৃদয়ের এবারের শুরুটা হয় ৪৭ রানের ইনিংসে। এরপর দুই ম্যাচে
ব্যর্থ হন তিনি। পরের তিন ম্যাচে দুটিতে খেলেন ত্রিশ ছোঁয়া ইনিংস। এবার
আগের সবকিছু ছাপিয়ে স্মরণীয় এক সেঞ্চুরি করলেন ২৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
১৭৬
রানের লক্ষ্যে শুরুটা বেশ নড়বড়ে ছিল কুমিল্লার। প্রথম বলে ছক্কা মেরে
ইনিংস শুরু করলেও বেশি দূর যেতে পারেননি লিটন দাস (৫)। আগের ম্যাচে রানে
ফেরার আভাস দেওয়া ওপেনার এদিন শরিফুলের ভেতরে ঢোকা বলে হন এলবিডব্লিউ।
পরের
ওভারে প্রায় অসম্ভব দুই রান নিতে গিয়ে রান আউটে কাটা পড়েন উইল জ্যাকস।
শরিফুলের পরের ওভারে কট বিহাইন্ড হন তিন ম্যাচ পর ফেরা ইমরুল কায়েস। স্রেফ
২৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে কুমিল্লা।
সেই চাপের মধ্যেও পাল্টা
আক্রমণের পথ বেছে নেন হৃদয়। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন বিপিএলে প্রথম ম্যাচ খেলতে
নামা ব্রুক গেস্ট। চতুর্থ ওভারে আরাফাত সানির প্রথম বলে চার মারেন ইংলিশ
কিপার-ব্যাটসম্যান। শেষ বলটি দৃষ্টিনন্দন স্লগ সুইপে ছক্কায় ওড়ান হৃদয়।
পাওয়ার
প্লেতে টানা তৃতীয় ওভার করা শরিফুলকে দুটি চার মারেন গেস্ট। পরের ওভারে
আরাফাতের বলে চারের পর ছক্কা মারেন হৃদয়। এরপর খোলসে ঢুকে যান গেস্ট। তবে
হৃদয় এগোতে থাকেন একই গতিতে। দ্বাদশ ওভারে পূর্ণ হয় তার ফিফটি।
পরের
ওভারেই সাইফকে তুলাধুনা করে সমীকরণ পক্ষে আনেন হৃদয়। এরপর রেমন রিফার
ড্রেসিং রুমের পথ ধরলে চাপ বাড়ে হৃদয়ের ওপর। তবে সেটি একদমই বুঝতে দেননি
তিনি।
জাকের আলির সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ২৪ বলে ৪২ রানের জুটি গড়েন হৃদয়। সেখানে তার অবদােই ১৪ বলে ৩৬ রান।
উনিশতম
ওভারে সেঞ্চুরি পূরণের পরের বলে তাসকিনকে ছক্কায় ওড়ান হৃদয়। ম্যাচ চলে আসে
কুমিল্লার হাতের মুঠোয়। শেষ ওভারে হৃদয়ই খেলেন ম্যাচ জেতানো শট।
টস
জিতে ব্যাটিং নিয়ে দ্রুত রান তোলার আশায় চাতুরাঙ্গা ডি সিলভাকে ওপেনিংয়ে
নামায় ঢাকা। ম্যাথু ফোর্ডের প্রথম ওভারে দুটি চার মেরে তেমনই আভাস দেন
শ্রীলঙ্কান অলরাউন্ডার। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি।
চতুর্থ ওভারে
আলিস আল ইসলামের প্রথম বলে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান চাতুরাঙ্গা। পরের বলে মিড
অফে প্রায় একই জায়গায় একই ফিল্ডার গেস্টের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ৩ চারে ১৪
রান করতে খেলেন ১৩ বল।
দ্বিতীয় উইকেটে জুটি গড়েন মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও
সাইফ হাসান। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানের বলে ঝড় তোলেন
দুজন। প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে নাঈমকে স্ট্রাইক দেন সাইফ। ডিপ মিড উইকেট
দিয়ে ছক্কায় শুরু করেন নাঈম। পরের তিন বলে তিনি মারেন আরও দুটি চার।
ওই
ওভার থেকে ২২ রানের সৌজন্যে পাওয়ার প্লেতে ঢাকা পায় ৫৫ রান। এরপর আলিস ও
তানভির ইসলামের স্পিনে দেখেশুনে খেলেন দুজন। আলিসের স্পেলের শেষ বলে ছক্কা
মেরে ১৮ বলের বাউন্ডারি খরা কাটান সাইফ।
পরে তানভিরের বলে দুই চার মারেন নাঈম। দ্বাদশ ওভারে একশ পূর্ণ করে ঢাকা। একই ছন্দে চলতে থাকে নাঈম-সাইফের রানের ফোয়ারা।
চলতি বিপিএলে নিজের দ্বিতীয় পঞ্চাশ ছুঁতে নাঈম খেলেন ৩১ বল। বিপিএলে সব মিলিয়েই নিজের প্রথম ফিফটির স্বাদ পেতে সাইফের লাগে ৩৯ বল।
ষোড়শ
ওভারে বড় ধাক্কা লাগে ঢাকার ইনিংসে। ফোর্ডকে ছক্কা মেরে ওভারটি শুরু করেন
সাইফ। তবে পরের বলে স্লোয়ার ডেলিভারি আবারও উড়িয়ে মারার চেষ্টায় মিড অফে
লিটনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন তিনি।
সাইফের বিদায়ে ভাঙে ৭৮ বলে ১১৯ রানের জুটি। ৪২ বলের ইনিংসে ৪ চারের সঙ্গে ৩টি ছক্কা মারেন ২৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
পঞ্চম
বলে স্লোয়ার বাউন্সারে রিভার্স স্কুপের মতো করেন নাঈম। ব্যাটের নিচের দিকে
লেগে বল যায় থার্ড ম্যানের দিকে। তবে ফলো থ্রুতে স্ট্যাম্পে আঘাত করে বসেন
বাঁহাতি ওপেনার। হিট উইকেট হয়ে নাঈমের ৯ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ৪৫ বলের
ইনিংস।
৮ ম্যাচে ২৫৬ রান নিয়ে টুর্নামেন্টের রান সংগ্রহের তালিকায়
শীর্ষে উঠে গেছেন নাঈম। ওই ওভারের শেষ বলে রান আউট হন প্রথম ম্যাচ খেলতে
নামা আন্দ্রে ম্যাকার্থি।
শেষ দিকে অ্যালেক্স রস ও এসএম মেহরবের ১৮ বলে
৩২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে চলতি আসরে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোরে পৌঁছায়
ঢাকা। ১১ বলে ২১ রান করেন রস। মেহরবের ব্যাট থেকে আসে ৮ বলে ১১ রান।
টুর্নামেন্টে
এখনও নিজের সেরা ছন্দের খোঁজে থাকা মুস্তাফিজকে পুরো ৪ ওভার করাতে
পারেননি লিটন। ২ ওভারে ৩৩ রান খরচ করেন বাঁহাতি তারকা পেসার।
ঢাকার সেই পুঁজিকে বেশ লড়িয়েই মনে হচ্ছিল। কিন্তু হৃদয়ের সামনে উড়ে গেল সব চ্যালেঞ্জ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দুর্দান্ত
ঢাকা: ২০ ওভারে ১৭৫/৪ (চাতুরাঙ্গা ১৪, নাঈম ৬৪, সাইফ ৫৭, রস ২১*,
ম্যাকার্থি ০, মেহেরব ১১*; ফোর্ড ৪-০-৩৫-৩, আলিস ৪-০-২৯-১, জ্যাকস
৪-০-২৪-০, মুস্তাফিজ ২-০-৩৩-০, তানভির ২-০-১৪-০, রিফার ৪-০-৩৭-০)
কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়ান্স: ১৯.৫ ওভারে ১৭৬/৬ (জ্যাকস ৯, লিটন ৮, হৃদয় ১০৮*, ইমরুল ১,
গেস্ট ৩৪, রিফার ৬, জাকের ৬, ফোর্ড ১*; শরিফুল ৪-০-৩২-২, তাসকিন ৪-০-৪৫-০,
আরাফাত ৪-০-৩৩-১, ইরফান ২.৫-০-২৪-১, চাতুরাঙ্গা ৪-০-২১-১, সাইফ ১-০-২০-০)
ফল: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ৪ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: তাওহিদ হৃদয়