আমাদের
বন্ধু আবুল কাশেম অর্থাৎ খবরের কাশেম অনেকটা নিরবেই চির বিদায় নিল গত ৪
জানুয়ারি। সাংবাদিক ফিরোজ ফেইজ বুকে কাশেমের মৃত্যুর সংবাদটি না দিলে তাঁর
চলে যাওয়ার সংবাদটি অনেক দিন হয়তো অজানাই থেকে যেতো আমাদের কাছে। কোন দিন
হয়তো শুনতাম কাশেম মারা গেছে।
আশির দশক থেকে কাশেমের সাথে পথচলা। কাশেম
তখন “সাপ্তাহিক আমোদ”র সাথে জড়িত। দৈনিক খবরে ও সংবাদ পাঠায়। তখন রেজাউল
করিম শামীম ভাইও দৈনিক খবরের কুমিল্লা সংবাদ দাতা হিসেবে কাজ করতেন। তাদের
মাঝে অনেকটা সংবাদ প্রেরণের প্রতিযোগিতা চলতো। এতে দৈনিক খবরে কুমিল্লার
কোন সংবাদই মিস হতো না। আশির দশকের মাঝামাঝিতে আমি তখন দেলোয়ার জাহিদ
সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাজ কন্ঠের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। অন্যান্য
স্থানীয় পত্রিকায়ও লেখালেখি করি। দেলোয়ার ভাই কুমিল্লা প্রেসক্লাবের
তৎকালীন কমিটির সাথে মত দ্বৈততার কারণে সরে এসে প্রথমে ‘কুমিল্লা এসোসিয়েট
প্রেস ক্লাব’ গঠন করেন। পরে সমান্তরাল কুমিল্লা প্রেস ক্লাব গঠন করে সভাপতি
হিসেবে আমাদেরকে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। অস্থায়ী কার্যালয় টমছম
ব্রীজস্থ দেলোয়ার ভাইয়ের সমাজকন্ঠ অফিস। তখন থেকে আবুল কাশেম নজরুল ইসলাম
বাবুল প্রয়াত বদিউল আমিন দুলাল, সহিদ উল্লাহ, আলী আকবর মাসুম, ফিরোজ মিঞা,
প্রয়াত এম, জি মাহফুজ, রমিজ খান, অধ্যাপক আবদুস সামাদদের সাথে চলা ও
গনিষ্ঠতা। ১৯৮৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পরিবেশ রিপোর্টিং প্রশিক্ষণ ও বাৎসকির
বনভোজনে কক্সবাজার গেলে কাশেমের সাথে তোলা গ্রুপ ছবি গুলো আমার কাছে এখনও
স্মৃতি হয়ে আছে। এখন ভাবি কাশেম একটু খ্যাতি আর সম্মানের নেশায় যৌবনের
সোনালী সময়গুলো সংবাদের পেছনে দৌড়িয়ে পার করে দিল। শেষে কি পেল? সেই সদর
দক্ষিণ কুমিল্লার মাটিয়ারা গ্রাম থেকে শহরে এসে সংবাদ সংগ্রহ ও পত্রিকা
অফিসে প্রেরণ করে প্রায়ই গভীর রাতে বাড়ি ফিরতো। খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলে
বলতো “সকালে গরম ভাত খাইয়া আইছি।” কখনো কখনো সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কর্মশালা
থাকলে দুপুরের খাবার হয়ে যেতো। এ ভাবেই যৌবন পার করে দিল বিয়ের কথা চিন্তা
করেনি। ইসলামের ইতিহাসে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েও অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত
হয়নি বা হওয়ার চেষ্টাও করেনি।
যখন বিয়ের জন্য আগ্রহী হলো তখন জীবন থেকে
অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বিয়ে করবেই বা কি করে তখনকার পরিচ্ছন্ন সাংবাদিকতা
ছিল অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা।
হাতে গোনা ক’জন জাতীয় পত্রিকার প্রতিনিধি রিটেইনার, লাইনেজ আর ছবির বিল
পেত। তা দিয়েতো পকেট খরচই চলে না সংসার চালানো তো দূরের কথা। কাশেম দৈনিক
খবর আর আমোদ থেকে তেমন কিছু আর্থিক সুবিধা পেত বলে আমার জানা নেই। একটা
পরিচয়পত্র, প্যাড, কলম পেয়েই মহা খুশি। যতটুকু মনের পড়ে আমোদ একবার কাশেমকে
শ্রেষ্ঠ সংবাদ দাতা হিসেবে সম্মানিত করেছিল।
আশির দশকে চৌয়ারা
শুয়াগাজী সড়কের দুই পার্শ্বে সড়ক বনায়ন কর্মসূচীর আওতায় বৃক্ষরোপন করলে
চারাগুলো অযতœ অবহেলা আর গরু ছাগলের অত্যাচারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়।
তখন কাশেম গাছের চারাগুলো রক্ষার জন্য আমোদে এ বিষয়ে একটা নিউজ করে, এতে
কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং সাথে সাথে চারাগুলোর চার দিকে বাঁশের বেষ্টনী দিয়ে
গরু ছাগলের কবল থেকে রক্ষা করে। সেই চারাগুলোই আজ বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে
চৌয়ারা শুয়াগাজী সড়কটিতে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এই নিউজটির কারণেই কাশেম
কে আমোদ পুরস্কৃত করেছিল। এ বিষয়ে আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বি, অভিভাদন
সম্পাদক আবুল হাসানাত বাবুল ভাই সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।
কাশেমের শহরে
আড্ডার স্থল ছিল নিউমার্কেটের “সহিদ আর্ট” আর আমাদের মোগলটুলীর চিশতিয়া
ষ্টোরে। দু’টো প্রতিষ্ঠানই এখন আর নেই। আমাদের দোকান চিশতিয়া ষ্টোরেই তাঁর
সকল চিঠিপত্র, পত্রিকার সৌজন্য কপি আসতো। মাঝে মাঝে আমাদের দোকানের
টেলিফোনেও সংবাদ সংগ্রহ করতো। আমার বড় ভাই আবুল খালেক আজাদের সাথে ও তার
বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল।
দু এক বছর আগেও কাশেম ঘন ঘন মোবাইলে যোগাযোগ করতো
তার বিয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু সহযোগিতা করতে পারিনি। বলা
যায় কিছুটা অবহেলাও ছিল আমাদের। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে কোন এক কাজে
চৌয়ারা বাজারে গেলে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। ভেবে ছিলাম
যোগাযোগ হলে তাকে দেখতে যাবো। কিন্তু যোগাযোগ হয়নি বলে তার সাথে শেষ দেখাও
আর হলো না। দেখা হলে সবসময় বলতো “তোমরা আমার জন্য কিছু করলা না।” শেষে
সমাজের প্রতি একটা চাপা অভিমান নিয়েই চিরতরে চলে গেলো কাশেম। সঠিক সময়ে
তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাইনি বলে তার জানাজায়ও অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্যও হলো না।
দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসীব করেন।
লেখক:
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।