শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা
মেজর আবদুল গণির আজ জন্মদিন
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন
প্রকাশ: শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:০১ এএম |

মেজর আবদুল গণির আজ জন্মদিন
আজ ১ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসৈনিক এবং জাতির গর্ব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাষা আন্দোলনের সূচনা সৈনিক সাবেক প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য জাতীয় বীর মেজর আবদুল গণির জন্মদিন। বাঙালী জাতির অস্তিত্ব নির্মাণে, মেজর আবদুল গণির কীর্তি ও অবদান অবিস্মরণীয়। মেজর আবদুল গণি ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রয়াত সারাফত আলী, মাতা প্রয়াত জোবেদা খাতুন। মেজর গণির স্ত্রী প্রয়াত বেগম আছিয়া গণি। তাঁর দুই ছেলে কর্নেল (অব.) তাজুল গনি ও লে. কর্ণেল (অব.) খালেদ গণি, তিন কন্যা মাহমুদা বেগম, হাসিনা বেগম ও প্রয়াত সাজেদা বেগম। তিনি শিদলাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে চট্টগ্রাম ইসলামিয়া হাই মাদ্রাসা ও চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে পড়ালেখা করে পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪০ সালে ¯œাতক পাস করার পর কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে প্রথম বাঙ্গালি অফিসার পদে নিয়োগ পান।
মেজর আবদুল গণি শৈশব কৈশোর জীবনে খেলাধুলা, সমাজ সেবা ও শিক্ষার প্রতি আসক্ত ও অনুরাগী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশ লাভ করেছিল। ছাত্র থাকাকালে ‘সবুজ কোর্তা’ নামে একটি তরুণ বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনী সমাজের কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করে। জনসেবামূলক কাজে এই বাহিনীর পদচারণ তখন সকল মহলের প্রশংসনীয় ছিল। ১৯৪১ সালে মেজর আবদুল গণি ব্রিটিশ ভারতীয় পাইওনিয়র কোরে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালের শেষ দিকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন হন। ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর মেজর পদে পদোন্নতি পান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাঙ্গালী সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে মেজর গণি তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মেসারভিকে এক আবেদনপত্রে বাঙ্গালী মুসলমানদের নিয়ে একটি আলাদা রেজিমেন্ট গঠনের দাবি উপস্থাপন করেন। তাঁর এই যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে সে সময় মেসারভি মেজর গণির এ দাবি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছেও মেজর গণি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ১৯৪৮ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর অগ্রযাত্রা মেজর আবদুল গণির হাত ধরে। তিনি শুধু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, তাঁর চিন্তা চেতনা ছিল দেশ ও জাতির কল্যানের দিকে, সাম্য ও আদর্শের দিকে, ন্যায়-বিচার ও মহত্বের দিকে, উন্নয়ন ও উন্নতির দিকে, মাটি ও মানুষের রোজগারের দিকে সুশাসন ও শুভবুদ্ধির দিকে এবং সত্য ও সুন্দরের দিকে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমেই মেজর গণি মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে ছিলেন। তিনি ছিলেন বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে মেজর গণি ইস্ট পাকিস্তান রিক্রটিং অফিসে সহকারী রিক্রটিং অফিসার এবং ১৯৫১ সালে রিক্রটিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। রিক্রটিং দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সারাদেশ ভ্রমণ করেন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য বাঙালি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানরা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে এবং একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রামে অবিস্মরণীয় বীরত্বের পরিচয় দেন। মেজর আবদুল গণির প্রতিষ্ঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ কুর্মিটোলায় পাকিস্তানের কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর সম্মানে এক অভাবনীয় সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। যা দেখে তিনি এতই মুগ্ধ ও অভিভূত হন যে, আবেগাপ্লুত হয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘এত অল্প সময়ের মধ্যে তোমরা যে পরিমাণ উন্নতি করেছ, তা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি।

এই উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তোমরা যদি কাজ করে চলো আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সৈনিক হিসেবে তোমরা অদ্বিতীয় হবে। মনে রেখ এখন এটা তোমাদেরই দেশ, তোমাদেরই রাষ্ট্র। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা এখন তোমাদেরই হাতে।’’ জিন্নাহ সাহেবের যে দৃঢ় বিশ্বাসের প্রমাণ রেখেছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে। ঐ যুদ্ধে একটি মাত্র ব্যাটালিয়ান ভারতের একটি ডিভিশনের আক্রমণ প্রতিহত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল ইউনিটের চেয়ে সর্বাধিক সাহসিকতা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ও উদাহরণ সৃষ্টি করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তাঁর সংগ্রামী জীবনের শুরু হয়েছিল সবুজ কোর্তা-র মতো স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠন দিয়ে এবং শেষ হয়েছিল জার্মানীতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠার পর তিনি যে স্বস্তি পেয়েছিলেন তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ পাকিস্তানী শাসকরা তাকে পদোন্নতি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখে। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। সামরিক বাহিনীতে চাকুরিকালে মেজর গণি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, সাতার ও বিলিয়ার্ড খেলতেন। বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ চালু করার বিষয়েও মেজর গণি বিশেষ অবদান রাখেন।
মেজর আবদুল গণির আজ জন্মদিন সামরিক চাকুরী ছেড়ে মেজর গণি রাজনীতিও জনসেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজ জেলা কুমিল্লার বুড়িচং নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বতন্ত্র সদস্য হয়েও মেজর গণি ব্যতিক্রমী মেধা মননের জন্য আইন পরিষদে সবার নজর কাড়েন। সংসদে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি এলাকা ও দেশের উন্নয়নের জন্য তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মেজর আবদুল গণি অকালে পরপারে পারি জমান। ১৯৫৭ সালে জার্মানী সফর কালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইহকাল ছেড়ে যান এই সাহসী ও সংগ্রামী সৈনিক।
এই বীর সৈনিকের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মেজর গণি পরিষদ ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাসে তাঁর সমাধি সৌধে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানান। এ বছর কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজের মেজর আবদুল গণি পাঠাগারের আয়োজনে কলেজ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মেজর আবদুল গণির জীবনী নিয়ে রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করবে। প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের মাঝে তিতাস চৌধুরীর লেখা মেজর আবদুল গণি জীবন ও কর্ম বইটি উপহার দেওয়া হবে। এছাড়াও মেজর আবদুল গণি মুক্ত স্কাউট গ্রুপের আয়োজনে আলোচনা ও মিলাদ দোয়ার আয়োজন করা হবে। মেজর আবদুল গণি মুক্ত স্কাউট গ্রুপের সভাপতি ও বাংলাদেশ স্কাউটসের পরিচালক প্রশিক্ষণ ফারুক আহাম্মদ এর সভাপতিত্বে দোয়া ও আলোচনা সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করবেন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক  মেজর আবদুল গণি মুক্ত স্কাউট গ্রুপ।














সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft