প্রকাশ: শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১:১১ এএম আপডেট: ২২.০৯.২০২৩ ১:২৮ এএম |
ভাবতেই পুলক জাগে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী কর্তৃক জেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি এবছর ১৫০ বছর অতিক্রান্ত করছে।এ এক অনন্য গৌরবের বিষয়। একসময় এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো মক্তব ও আশ্রম কেন্দ্রিক। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নের লক্ষে ১৮৩৫ সনে রবার্ট মেকলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের জন্যে ১৮৩৫ সনে ঢাকা কলিজিয়েট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। তার ধারাবাহিকতায় ১৮৩৭ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল স্থাপিত হয় সরকারী উদ্যোগে। ১৮৭৩ সনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটলো। সম্পুর্ন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে নবাব ফয়জুন্নেছা কুমিল্লা শহরে স্থাপন করলেন ফয়জুন্নেছা স্কুল। তাও আবার নারী শিক্ষার জন্য। পশ্চাৎপদ সেসময়ে এটি কত কঠিন কাজ ছিল তা আজকের দিনে চিন্তা করাও দুঃসাধ্য। বিগত ১৫০ বছরে এই বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীরা আলো ছড়িয়েছেন দেশে বিদেশে।তাদের গৌরব গাঁথা সৌরভ ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। আজকে আমরা যে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি তার শুরুর অন্যতম অনুসঙ্গ কিন্তু ফয়জুন্নেসা স্কুল। এটি শুধু কুমিল্লা নয় বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা যদি এই বিদ্যালয়ের ফলাফলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব প্রতি বছর ফলাফল তালিকায় অন্যতম শীর্ষ স্থান দখল করে আছে এই বিদ্যায়তন।
শুধু লেখা পড়াই নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা সর্বত্রই এই প্রতিষ্ঠানের জয় জয়কার। দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসছে বারবার। ব্রিটিশ বেনিয়ারা যখন এই জাতির উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল তখন ফয়জুন্নেসা স্কুলের শিক্ষার্থী শান্তি-সুনীতি কর্তৃক কুমিল্লার তৎকালীন ডিএম স্টিভেন্স হত্যা পুরো ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদ্যালয়ের একসময়ের ছাত্রী হেমপ্রভা মজুমদার সেসময়ের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন খোদ কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৫২ সনের মহান ভাষা আন্দোলনে এই বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা দুঃসাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেছে। স্কুলের সে সময়ের প্রধান শিক্ষক উম্মে কুলসুম গুলে নূর ছাত্রীদের সহযোগিতা করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা জাহানারা হায়দার এই জেলার প্রথম মুসলমান নারী গ্র্যাজুয়েট। বিদ্যালয়ের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দীকা রহমান তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন বোর্ডের মেধা তালিকাতেই স্থান পেয়েছেন, কোলকাতা বেতারে নিয়মিত গান গেয়েছেন দাপটের সাথে। সুধা সেনের কথা কে না জানে? অনেক গুণে গুণান্বিতা সুধা সেন রবীন্দ্রনাথকে পত্র লিখেছিলেন তাঁর “জনগণ মন অধিনায়ক হে ভারত ভাগ্যবিধাতা” গানের ব্যাখা দাবি করে। রবীন্দ্রনাথও সে চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন বৈকি। সুধা সেনের কন্যা সুনন্দা সেনও এই বিদ্যালয়েরই মেধাবী ছাত্রী। ভাষা সংগ্রামী লায়লা নূর এবং হোসনে আরা বেগম এই স্কুলেরই গর্বিত শিক্ষার্থী। আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে হাল ধরা ১৯৫৪ সনের সংসদ সদস্য আমেনা বেগমও এখানে লেখা পড়া করেছেন। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে অবদান রেখেছেন।
আজ থেকে দেড়শো বছর আগে যে মহিয়ষী নারী ফয়জুন্নেছা স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে আলোক শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন তাঁর আরো অসংখ্য কীর্তি তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দান করেছে। তিনিই প্রথম নারীদের স্বতন্ত্র চিকিৎসার জন্য ফয়জুন্নেছা জেনানা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা কুমিল্লা সদর হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ড নামে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। লাকসাম পশ্চিমগাঁয়ে নবাব ফয়জুন্নেছা প্রতিষ্ঠিত ফয়জুন্নেছা কলেজ এখনো শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তদীয় ভ্রাতা ইউসুফ আলী চৌধুরীর পুত্র খানবাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী ১৮৭৮ সনে কুমিল্লা শহরে স্থাপন করেন ইউসুফ হাই স্কুল। এমন কি ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছিলো। দেশে বিদেশে তার আরো অসংখ্য দানশীল কর্মকা- রয়েছে। ১৮০০ সনের পরে কুমিল্লা শহরের যে দ্রুত বিকাশ ঘটেছে এর জন্য জিলা স্কুল এবং ফয়জুন্নেছা স্কুলের অবদান অপরিসীম। কারণ সে সময়ে এই মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লাতো বটেই সারা দেশেই খুব কম ছিল। ফলে তখনকার জমিদাররা বা ধনিক শ্রেণীর লোকজন কুমিল্লা শহরকে তাদের আবাসস্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিল। আরো পরে যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হল তারাও তাদের আবাসস্থল হিসাবে কুমিল্লা শহরকেই তাদের পছন্দের তালিকায় রাখলো। এর অন্যতম প্রধান কারণ এখানে ফয়জুন্নেছা স্কুল, জিলা স্কুল, ভিক্টোরিয়া কলেজের মতো মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি।
তাহলে আমরা একথা বলতেই পারি শহর কুমিল্লার বিকাশেও ফয়জুন্নেছা স্কুলের অবদান অপরিসীম। এতসব অবদান রাখার পরেও নবাব ফয়জুন্নেছা ইতিহাসে একরকম অবহেলিতই ছিলেন। গবেষক আবদুল কুদ্দুস সাহেব যখন লন্ডন থেকে "রুপ জালাল" বইটি নিয়ে আসলেন এবং এটি বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন তখন তিনি আবারো প্রবল আলোচনায় আসলেন। ফয়জুন্নেছা স্কুলের নামের আগে নবাব শব্দটি ছিলোনা। এর বড় কারণ তিনি যখন ১৮৭৩ সনে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি নবাব নন। নবাব উপাধি পেয়েছেন আরো পরে। বিদ্যালয়ের নামের পূর্বে নবাব শব্দটি যুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন ডা. যোবায়দা হান্নান। কুমিল্লা সদর হাসপাতালের পুরাতন ভবন ভেঙ্গে যখন এর আধুনিকায়ন করা হলো তখন ফয়জুন্নেছা জেনানা ওয়ার্ডের নাম যেন বহাল থাকে সেজন্যেও ডা. যোবায়দা হান্নান “ফয়জুন্নেছা মেমোরিয়াল ট্রাস্টের” ব্যানারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকার পূনরায় এর নামকরণ করে নবাব ফয়জুন্নেছা ফিমেল ওয়ার্ড। আজকের এই দিনে আবদুল কুদ্দুস এবং ডা. যোবায়দা হান্নান কেও স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে।
কালের স্বাভাবিক নিয়মে আমরা হারিয়ে যাবো একসময় কিন্তু নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুল কুমিল্লার বাতিঘর হয়ে বাংলাদেশের আলোক শিখা হয়ে টিকে থাকবে আরো শত শত বছর। সেদিনের প্রজন্ম হয়তো আজকের প্রজন্মকে স্মরণ করবে একইভাবে। রবি ঠাকুরের ভাষায়-
"আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠিয়ে দিলাম তাঁর করে
আমার বসন্ত গান, তোমার বসন্ত দিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমর গুঞ্জনে নব
পল্লব মর্মরে
আজি হতে শত বর্ষ পরে"
লেখক পরিচিতি:ইতিহাস ঐতিহ্য লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক