বুধবার ৪ অক্টোবর ২০২৩
১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:১৮ এএম |

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা
সরকারি চাকরি করেছিলাম। সরকারি কলেজে পড়িয়েছি। ক্ষমতা ছিল না, বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। কিন্তু ভালোবাসা ছিল, সম্মান ছিল, ছিল মান্যতা। চাকরির পরও মাঝে মাঝে ভালোবাসার উষ্ণতা লাভ করি, সম্মান-মান্যতা দৃশ্যত উপভোগ করি। যারা ক্ষমতা বা দাপটে চাকরি করেছেন, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন অর্থাৎ সরকারি বাড়িতে থেকেছেন, সরকারি গাড়ি চড়েছেন, পিয়ন-চাপরাশি বেষ্টিত ছিলেন, চাকরির পরমুহূর্তে তা হাওয়া হয়ে গেছে। যারা বুদ্ধিমান তারা এঘর ওঘর করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন নামে-বেনামে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, চাকরি করেছেন স্বামী, অঢেল ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন স্ত্রী। খোঁজ নিলে সহজ উত্তর-বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া। বাবা কি করতেন? লা জবাব। যেহেতু ক্ষমতাধরের সংখ্যা অধিক, এ রাজ্যে প্রবেশাধিকার কারো নেই। সরকারি কলেজে চাকরি করলে কি বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া যায় না? অবশ্যই হওয়া যায়। তাদের বাড়ি ঘরের চেহারা দেখলেই বুঝা যায়। তবে যারা এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান হওয়ার সুযোগ পান-অধ্যক্ষ, প্রেষণে অধিদপ্তর-শিক্ষাবোর্ড-অথবা অন্য কোনো অর্থকরী সংস্থায়, তাদের বাড়ি-গাড়ির কোনো দীনতা নেই। এটাই বাস্তবতা। যেহেতু শিক্ষা বিভাগে কেবলমাত্র পাঠদান করার মধ্যেই চাকরিটা সীমিত রেখেছি বা থেকেছে, সেজন্যই উঁচু গলায় এতসব কথা বললাম, সুযোগ পেলে আমিও গড্ডলিকার ¯্রােতে যে ভেসে বেড়াতাম না তা কে বলতে পারে? যারা কৃচ্ছ সাধনায় ব্যতিক্রম তাঁদেরকে কুর্নিশ করি।
সরকারি চাকরি বহুমাত্রিক। সব সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা একরূপ নয়। সেজন্য আজকাল সরকারি চাকরি পেতে হলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সোনার হরিণটি ধরতে হয়। যারা কমিশনের মাধ্যমে চাকরির জন্য আবেদনপত্র পেশ করে, তাদেরকে নিজেদের পছন্দের চাকরিক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লিখে দিতে হয়। দেখা গেছে-যে সকল চাকরিতে ক্ষমতা-অর্থ-বাড়তি সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য তাই পর্যায়ক্রমে লিখে দেয়। আমার চাকরির শেষের দিকে কলেজে সহকর্মী হিসেবে যারা যোগদান করতেন, তাদের মধ্যে হতাশা ভাবটি ছিল প্রকট। হয়ত চাকরি প্রার্থনায় শিক্ষকতার জন্য ক্রমনম্বর ছিল ৫/৬/৭, প্রথম দিকের লোভনীয় পদ না পেয়ে একধরনের আহাজারি তাদের মধ্যে দেখেছি। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো কলেজে শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যেহেতু সন্তুষ্ট নয়, তারা পাঠদানে আগ্রহী হতে চাচ্ছে না। অনিচ্ছুক ঘোড়া চালিয়ে আনন্দ পাওয়া বৃথা।
চাকরি সরকারি, কিন্তু বলা হয় পাবলিক সার্ভেণ্ট। কিন্তু চাকরিজীবীরা ভাবে তারা সরকারের সার্ভেণ্ট। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সরকার হলো জনগণ। তারা কোথায় থাকে তা তারা জানেন না, আমরাও জানি না। সংবিধানে যদিও বলা আছে-‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ (২১/২ধারা)। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই বলা যায়-কোনো সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তা ‘পাবলিক সার্ভেণ্ট’-এর দর্শনে বিশ্বাসী নন। তারা ২৪ ঘণ্টা সরকারি চাকুরে বা সরকারের সার্ভেণ্ট। সরকার যা নির্দেশ করে, বাস্তবায়নে এটাই স্বত:সিদ্ধভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে, এই সরকারের বাইরে কোনো সাধারণ নাগরিক যদি কোনো বলতে চায়, তা ক্ষমতার দাপটে নাকচ হয়ে যায়। সেজন্য সরকারি অফিস-আদালতে কোনো কৃষক-শ্রমিক-গরিব-এর ঠাঁই নেই। এমন কি কোনো সরকারি বড়কর্তা তাদের কাছে গিয়ে সামিল হয়েছেন, তা কল্পনাও করা যায় না। কারণ সরকারের সার্ভেণ্ট অর্থাৎ তিনিই সরকার, তিনিই ক্ষমতাবান। কারণ, তিনি ক্ষমতার সিংহাসনে বসে আছেন-এ সিংহাসন যার বা যাদের অর্থে তৈরি তাদেরকে সকলেই ভুলে যায়। যার সিংহাসনটি যত বড়, তিনি তত ক্ষমতাবান। আমাদের চিনতে ভুল হয় না। শুধু চেয়ে থাকি, বোবা বা অন্ধ বলে কথা।
অপর দিকে জনগণের ভোটে যাঁরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাঁরা আর প্রতিনিধি থাকেন না, তাঁরা হয়ে যান জননেতা। তিনি আরো বড় সিংহাসনে বসে থাকেন, তিনি বাহিনী কর্তৃক পরিবেষ্টিত থাকেন, তিনি হাসলে বাহিনী হাসে, তিনি বেজার হলে বাহিনী চঞ্চল হয়ে পড়ে, তিনি আর ভোটারদের চিনেন না, বর্তমানে ভোটারের দরকারও পড়ে না। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার রাজবাড়িতে নিষিদ্ধ না হলেও অপেক্ষার সময়টি ঘণ্টা-দিন-সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে যায়। এই অবস্থা যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলেন, তখনই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। যে মহান ব্যক্তিটি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে সংবিধানে চারটি স্তম্ভের প্রতিষ্ঠা দিলেন, কেন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের বাস্তবায়নের জন্য এক দলীয় শাসনের পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলেন? অনেকে বলেন- সেদিনই আদর্শিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ঘটেছে। যদি প্রশ্ন করা যায়-১৯৭৪ সালের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের পর ভঙ্গুর অর্থনীতি যখন লুটেরেরা গ্রাস করতে চলেছে, তখন দেশের স্বার্থে-একটি বিপ্লব দরকার ছিল কি? বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন-
‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বান কি কেউ উপলব্ধি করেছিল? তিনি যখন ঘোষণা দিলেন-‘বাংলাদেশের সম্পদ এ দেশের মানুষের সম্পদ।’ কিন্তু দেখা গেলো-ক্ষমতালোভীরা দেশের মানুষের সম্পদ নিজেদের সম্পদ ভাবতে শুরু করেছে, তারাই দেশের সম্পদের মালিক বনে যেতে চাইল।
দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করতে তথাকথিত অনেক বুদ্ধিজীবীকে সোচ্চার হতে দেখি। তারা বুঝেন, কিন্তু বলেন না। বঙ্গবন্ধু তো ২৬ মার্চ ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসন্মুখে বলেছেন-
‘কেন সিসটেম পরিবর্তন করলাম? সিসটেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিসটেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য, কথা হলো, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অফিসে গিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যায়। সাইন করিয়ে নেয়। ফ্রি স্টাইল। ফ্যাক্টরিতে যেয়ে কাজ না করে টাকা দাবি করে, সাইন করিয়ে নেয়, যেন দেশে সরকার নাই। আবার স্লোগান হলো, বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। বঙ্গবন্ধু কঠোর হবে। কঠোর ছিল, কঠোর আছে। কিন্তু দেখলাম, চেষ্টা করলাম। এত রক্ত, এত ব্যথা, এত দুঃখ, তার মধ্যে ভাবলাম, দেখি, কী হয়, কিছু করতে পারি কি-না। আবদার করলাম, আবেদন করলাম, অনুরোধ করলাম, কামনা করলাম। কিন্তু কেউ কথা শোনে না। চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী।’
দ্বিতীয় বিপ্লবকে অনেকে মনে করেছেন, বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে একচ্ছত্র ক্ষমতাবান হলেন। তিনি তো সবসময়ই কেন্দ্রীয় শক্তিতে শক্তিমান, ক্ষমতাবান। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন-
‘আমি বিশ্বাস করি না, ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে ‘বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও, বঙ্গবন্ধু তারপর একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করবার জন্য।’
তিনি বলেছেন-
‘সত্য কথা বলবার অভ্যাস আমার আছে। মিথ্যা বলবার অভ্যাস আমার নাই। কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় কথা বলব।
বন্যা হলো। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম। পাঁচ হাজার সাত-শো লঙ্গরখানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সাহায্য নিয়েছি মানুষকে বাঁচাবার জন্য। আমি চেয়েছিলাম-স্বাধীনতা। কী স্বাধীনতা?
----------------------
আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়, সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। যে হোর্ড করে, সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। আমি কেন ডাক দিয়েছি?
বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন-‘পাকিস্তানিরা সব ধনসম্পদ ও ভালো জিনিস লুট করে নিয়ে গেছে, আর আমার জন্য রেখে গেছে সব চোর।’ কতটা মনে কষ্ট পেয়ে এ কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন-‘আমরা শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক?’ তিনি বলেন যে সত্যিকার অর্থে শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন-
‘আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাকমার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেণ্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত।’
প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য ছিলেন ধুরন্ধর অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেছিলেন-‘জলের ভিতর মাছ থাকে, মাছ জল খায় কি না জানি না। সরকারি চাকুরেরা ঘুষ খায় কি না তাও বুঝি না।’ বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নে কৌটিল্যের বার্তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, তা অস্বীকার করার জো নেই। তিনি কত বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণে বলেছিলেন-
‘একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে, আমরা বলব, ‘এই বেটা, কোত্থেকে আইছিস, বাইরে বয় বাইরে বয়।’ একজন শ্রমিক যদি আসে, বলি ‘ঐখানে দাঁড়া।’ ‘এই রিকশাওয়ালা, ঐভাবে চলিস না।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের সাথে কথা বলেন। তাদের তুচ্ছ করেন। ... আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’
তখনই প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। প্রথম বিপ্লব ছিল ৬-দফার মাধ্যমে স্বাধিকারের জন্য প্রস্তুতি এবং এই স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি ১৯৭০-এর নির্বাচন ও গণরায় এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। প্রথম বিপ্লব আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছে। যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, তা কোনো নতুন আহ্বান নয়। তিনি ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেছিলেন-
‘দেশে যদি বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সে বিপ্লবের ডাক আমিই দিব: আমি কম বিপ্লবী নই।’
আরও বলেছিলেন-
‘বিপ্লবের উদ্ভব ঘটে দেশের মাটি হইতে এবং বিপ্লব উন্মেষের একটা নির্ধারিত কালও আছে।’
তাই যখন বিপ্লবের সময় পরিপক্ক হলো, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ বিপ্লবের মূলমন্ত্র উচ্চারণ করলেন-
    ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
    এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
                    জয় বাংলা।
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বক্তৃতায় বললেন-
    ‘বাংলার মানুষ চায় তারা যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে।’
তাই দেখি, পুলিশ যখন রাত্রে জেগে থাকে, জনগণ তখন শান্তিতে ঘুমায়।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের পক্ষে দীর্ঘ সমাপনী ভাষণ দেন এবং তার প্রাসঙ্গিকতার তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। অধিবেশনে চতুর্থ সংশোধনী বিল ১৯৭৫ পাস হয়। পক্ষে ২৯৪ ভোট বিপক্ষে শূন্য ভোট।
১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ কাগমারি, টাঙ্গাইল মওলানা মোহাম্মদ আলী সরকারি কলেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বললেন-
‘আমি তিন বছর আবেদন করেছি। বাবা, সোনা, ভাই বলে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তারা বাংলাদেশের উপর নানা ভাবে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তারা সম্পদ লুট করেছে, পাচার করেছে। বিদেশ থেকে যে খাবার এনেছি তা চুরি করেছে। ... সকল ধরনের দুর্নীতিবাজকে দেশ থেকে উৎখাত করতে হবে। আগাছা-পরগাছাদের বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে।...’
টাঙ্গাইলে সে সময় মওলানা ভাসানীও বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
আজীবন গণতন্ত্রসেবী বঙ্গবন্ধু জাতি ও দেশের স্বার্থে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলেন। কেন?
১.      তখনকার প্রেক্ষাপটে বহুদলের রাজনীতি থাকলেও তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এক অবস্থানে জড় হওয়ার সুযোগ পেত। জাসদ-বামপন্থী-সর্বহারা পার্টি-যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে দেশকে রসাতলের দিকে নিতে চেয়েছিল।
২.      বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন গণতন্ত্রী মানসিকতায় যদি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে শোষণহীন সমাজ গঠন করা যায়, তাহলে দেশের আপামর জনসাধারণ স্বস্তিতে থাকবে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হলে খেয়ে পরে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে।
আমার উপলব্ধি, উন্নত বিশ্বে কোন দেশ একদলীয় নয়? আমেরিকা শাসন করছে দুটি রাজনৈতিক দল, ব্রিটেন শাসিত হচ্ছে দু’দলের পালাবদলে, চীন-রাশিয়া একদলীয় শাসন, গোটা আরব বিশ্ব তো একদল-একব্যক্তির শাসন, কোরিয়াসহ আরও, অনেক দেশ। সে সকল দেশই তো আজ উন্নত বিশ্বের অধিকর্তা। বঙ্গবন্ধু একটি দরিদ্র নিঃস্ব দেশের শাসনকর্তা হয়ে ভালবাসার আপন ঔদার্যে চেয়েছিলেন সকলকে নিয়ে দেশটিকে গড়তে, ভঙ্গুর দেশটিকে সোনার বাংলা করতে, তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাকের মাধ্যমে। আমরা অপেক্ষা করিনি, তাঁকে হত্যা করলাম। যিনি বাংলাদেশের একমাত্র স্থপতি, একমাত্র প্রাণপুরুষ, জাতির পিতা, তাঁকে আমরা বাঁচতে দিলাম না। কত বড় পাপ। পরের কথা আগে বলছি। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকান-মৌলিক কোনো পার্থক্য নজরে পড়ে কি? আমরা বিন্দুমাত্র পাল্টাইনি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই আছেন, শুধুমাত্র সময়ের দাবিতে বিচক্ষণতার সাথে দেশ পরিচালনায় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের এবং অতি অল্পসময়ের মধ্যে উন্নত দেশে পৌঁছে যাওয়ার পথ সুগম করেছেন। অবাক হই-
১.     সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুন করা হলো, যেন তারা সৎভাবে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু স্বভাব পরিবর্তন হলো না। ক্ষুধা আরো বেড়ে গেলো।
২.     ব্যাংক-বীমা অঢেল হলো, টাকা পাচার করে বিদেশে পাঠানো হলো, হচ্ছে। ব্যাংক-বীমার সরকারি অনুদান লাভের পর নিজের টাকা তুলে ঋণ খেলাপি হলো। অর্থনীতিকে ধ্বংস করার কতই না কারিশমা।
৩.     দেশে যাতায়াতের কত সুবিধা-এক লাইনের রাস্তা এখন চারলাইন-আট লাইন, ফ্লাইওভার, ব্রীজ-তারপরও দুর্ঘটনায় নিত্য মানুষ মরে, মানুষ মারে।
তারপরও বাংলাদেশের উন্নতি অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনার সরকার দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যারা দড়ি ধরে টানছে, দড়ি ছিড়ে যাচ্ছে। যে দেশে বিরোধীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়- পদ্মাসেতু ভেঙ্গে পড়বে, সরকারে গুপ্তিমেরে বসে বলে- রানা প্লাজা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে- এদেশে বহুদলের রাজনীতির প্রয়োজন আছে কি?
বঙ্গবন্ধু যেভাবে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তা ভুল কি শুদ্ধ জানি না। কিন্তু তিনি শক্র-মিত্র চিনতে পারেননি। তাঁর প্রজন্ম সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ভুল করছেন না, ভুল করবেন না, ভুল করতে পারেন না। এতটা বিশ্বাস রাখছি তাঁর বিচক্ষণতা দেখে এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তে নির্ভুল পদক্ষেপের জন্য।
পরিশেষে বলতে চাই-বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ভুল ছিল না। তিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করেননি। বরং গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে নবায়ন করতে চেয়েছিলেন। বহুভাষণে তিনি বলেছেন-
১.     এই দারিদ্র্যের নাগপাশ হইতে মানবতাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় সমাজতন্ত্র।
আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার ৭ কোটি মানুষ অন্য কোন অর্থনীতিতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। ...
গণভিত্তিক অর্থনীতি না হইলে মানুষ অনন্যোপায় হইয়া যে কোন পন্থা গ্রহণ করিতে পারে। আর সেই জন্যই দেশে দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা হয়।
(২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, ঢাকা)

২.     আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। [৪ নভেম্বর ১৯৭২, বাংলাদেশ গণপরিষদ, ঢাকা]
৩.     শোষক শ্রেণিকে দমন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা দেশবাসীর আছে। সমাজতন্ত্র রাতারাতি হয় না-দীর্ঘদিনের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রক্তপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা দেশকে ঐক্য, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে চাই। ... শক্তির উৎস আমার জনগণ।
[১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের প্রশ্নের জবাবে]
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক ও একদলীয় শাসনব্যবস্থা সময়ের দাবিতে ভুল ছিল না। তিনি যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়ন করতে পারতেন, আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত বিশ্বের অন্যতম দেশের কাতারে সামিল হতে পারতো। বঙ্গবন্ধু তো বলতেন-‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’ প্রশ্ন আমরা কি সোনার মানুষ হতে পেরেছি? অন্য অর্থে ‘মানুষ’ হতে পেরেছি? পারিনি বলেই আমরা পিতৃহন্তারক, আদর্শকেও হত্যা করেছি, দৈহিকভাবে মহামানবকেও হত্যা করেছি। কিন্তু বাংলাদেশ এখন আর পিছিয়ে থাকছে না, থাকবে না। এ ইতিহাস অন্যরকম, ব্যতিক্রম তো অবশ্যই। শেখ হাসিনার উন্নয়নের চাবিকাঠি, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের হালখাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় বিপ্লবের খাতাখানা যারা পড়বেন, তারা অভাজনের মতো উপলব্ধি করতে পারবেন, বঙ্গবন্ধু জাতির জন্য, দেশের জন্য, সর্বোপরি আপামর জনগণের জন্য কী ভেবে নবযাত্রায় পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। তা ছিল নির্ভুল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও জাতির স্বার্থে রক্ষাকবচ।
    কত আনন্দে কতটা তৃষায় কেটেছে দিবস-নিশি
    বদলেছে কাল-মানুষ দেখেছে জীবনের উঠাপড়া
    এই বাংলায় পদ্মা-মেঘনা নেই আর বহমান
    তবুও মধুর বাঙালি জীবন হাজার বছর পর
    কীর্তি তোমার বঙ্গবন্ধু আজও ভাস্কর-আজও অবিনশ^র ॥












সর্বশেষ সংবাদ
নোবেল জয়ের কল পেয়ে অধ্যাপক অ্যানি বললেন ‘আমি ব্যস্ত, ক্লাস নিচ্ছি’!
ঢাকাসহ ১৭ অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী
দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে ঘুমন্ত দুই শিশুর মৃত্যু
আত্মঘাতী গোলে জয় নিয়ে ফিরলো রিয়াল মাদ্রিদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রেমিকাকে নিয়ে সুখে থাকতে মামার বুক খালি করলেন তরুণ
অভিযানের খবরে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছে সবাই!
কাল শুরু ওয়ানডে বিশ্বকাপ, আজ থাকছে যেসব অনুষ্ঠান
দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে ঘুমন্ত দুই শিশুর মৃত্যু
বিয়ের পরদিন বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল পুলিশ কর্মকর্তার
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft