রবিবাসরীয়..
|
জাদু বাস্তবতাবাদ (Magic Realism) ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকেজ (৬ মার্চ, ১৯২৭ - ১৭ এপ্রিল ২০১৪)![]() জাদু বাস্তবতার গড ফাদার মার্কেজ বলেছেন “আমরা যে বাস্তবকে দেশি তার পেছনে যে ধারনাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা।” সহজভাবে বলা যায় বাস্তব পার্থিব কাঠামোর সাথে ফ্যান্টাসির উপদান মিলে তৈরী হয় জাদুবাস্তবতা। সাহিত্যের অন্যতম উপাদান জাদুবাস্তবতার ধারনা ব্যবহার করে অনেক নাটক, উপন্যাস ও মুভি তৈরী হয়েছে। বিশ^খ্যাত কয়েকটি জাদুবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে লিখিত কয়েকটি বিশ্ববিখ্যাত মুভি সমূহ হলঃ 1. The Curious Case of Benjamin Button 2. About time 3. The Green Mile, 4. Groundhog Day 5. Edward Scissorhands, 6. Encanto 7. The Princes Bride, 8. Big fish 9. Rainbow 10. The Prophet. বিশ্বব্যাপি পঠিত ম্যাজিক রিয়ালিজম ধারনার উপর লিখিত বিখ্যাত উপন্যাস গুলোর মধ্যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেথ ইয়ারস অব সলিটিউড (১৯৬৭), সাবেল এলেনডির দ্যা হাউস অব দি স্পিরিটস (১৯৮২), সালমান রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন (১৯৮১) ও লরা ইসকুইভেল এর লাইক ওয়াটার ফর চকলেট (১৯৮৯) ও জে.কে রলিংস এর হ্যারি পটার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্যে নীল গেইম্যান, সালমান রুশদি, এলিস হফম্যান নিকোলা বার্কার এবং বাংলা সাহিত্যে নবারুন ভট্টাচার্য, জীবানন্দ দাশ, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, সহিদুল জহির ও সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ বিখ্যাত জাদুবাস্তবতাবাদ লেখক। গ্যাব্রিয়েল গাসিয়া মারকুইজ তার সৃষ্টিকর্মে সর্বদা ল্যাটিন আমেরিকার পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে লিখেছেন কিন্তু তার লেখা ফিকশন গুলোর সার্বজনীনতা ছিল বিশ^ব্যাপি সমাদৃত। তিনি বিংশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত গল্পকথক। নোবেল বিজয়ী এই লেখক ক্যারিবীয় অঞ্চলের কলম্বিয়ার দরিদ্র শিশুদের শোনা লোক কাহিনী ও ভৈৗতিক গল্পের উপর ভিত্তি করে তার সাহিত্য চর্চা করেছেন। তিনি তার জীবনের ৬০ বছর সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি মূলত লাতিন আমেরিকার আবেগ (প্যাশন) ও সামাজিক অসমতা অবলম্বনে স্প্যানিশ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন এবং তার বইগুলো বিশ^ব্যাপি সর্বাধিক বিক্রির মর্যাদা পাওয়ার পাশাপাশি সর্বজন সমাদৃত হয়েছে ও সাহিত্য অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্য সমালোচকরা তাকে “Magus of Magical Realism” উপাধিতে ভূষিত করেছেন। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারন। তার মতে বাস্তবতা হল সাধারণ মানুষের কাছে একটি পুরাতত্ত্ব। মারকুইসের লেখা মহাকাব্যিক উপন্যাস “One Hundred Years of Solitude” অগনিত পাঠক কর্তৃক উচ্চ প্রসংসিত হয়েছে। এই উপন্যাসটি ২৫টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। পাবলো নেরুদা এই উপন্যাস সম্পর্কে বলেন “এটি হল স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত” Miguel de Cerventis রচিত “Don Quixote” উপন্যাসের পরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম যা বিশ্ব ব্যাপি সমাদৃত, সর্বাধিক বিক্রিত ও প্রশংসিত হয়েছে। মারকুইজ বা গ্যাবু (বন্ধুর দেয়া ডাকনাম) ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। মারকুইজ ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ার আরাকাটাকা নগরীতে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে তার নানার বাড়ি। তার ফার্মাসিস্ট বাবা তাকে আইনশাস্ত্র পড়ার ব্যাপারে জোড় দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি তা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় আত্ম নিয়োগ করেন। তিনি তার এক সাক্ষাৎকারে এ.পি কে বলেন “I’m a journalist, I’ve always been a journalist.” তিনি বলেন সাংবাদিকতায় না এলে তিনি ভালো লেখক হতে পারতেন না কারণ তার অধিকাংশ লেখার মূল উপজীব্য বাস্তবতা থেকে সংগ্রহিত। ১৯৫৮ সালে তিনি তার শৈশবের প্রতিবেশি মারাসদিস বারকাকে বিয়ে করেন এবং তার সংসারে দুজন সন্তান ছিল। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের মত মারকুইজ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে সমালোচিত ছিলেন। বিখ্যাত হওয়ার আগ পর্যন্ত মারকুইজ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। মারকুইজ অনেকদিন পত্রিকায় লেখালেখি করার পর রোজাস পিনিলার আমলে তার পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি তার চাকরি হারান। চাকরি হারানোর পর তিনি প্যারিসে চলে যান এবং সেখানে তিনি ঝাড়–দারি ও বতল বিক্রির কাজ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। ঐ সময় তিনি দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও “In Evil Hour” নামে একটি উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেন। এই উপন্যাস লিখার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭ সালে অন্য আরেকটি উপন্যাস যথা “No one writes to the Colonel” লিখে ফেলেন যার মুল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল একজন দরিদ্র সেনা অফিসারের (তার দাদা) অপরিসীম কষ্টকর জীবন আলেখ্য যেখানে সেনা অফিসার পেনশন পাওয়ার জন্য অধির আগ্রহে সেনা সদর থেকে প্রেরিত চিঠির অপেক্ষায় দিনাতিপাত করছেন। ১৯৭৫ সালে তিনি তার পরবর্তি উপন্যাস “The Autumn of the Petriarch” প্রকাশ করেন যেখানে তিনি একজন স্বৈরাশাসকের কথা বলেছেন যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ লাতিন আমেরিকাতে শাসন করেছেন। মারকুইজের লিখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল “One hundred years of Solitude”.মূলত তার লিখা অনেকগুলো ভালো উপন্যাসের মধ্যে “Love in the time of Cholera” সর্বোকৃষ্ট। তার উল্লেখযোগ্য Romantic উপন্যাসের মধ্যে “Love in the time of Cholera” উল্লেখযোগ্য। এটি ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি তার উপন্যাসে সম্প্রতি একজন বিধবা নারীর সাথে তার ৫০ বছর আগের এক প্রেমিকের পুনরায় ভালবাসার হৃদ্যতার সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। বিশ^খ্যাত এই উপন্যাসিকের জীবন নানা যাতনায় পিষ্ট ছিল। তিনি কলম্বিয়া সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত কূটনীতিক পদ গ্রহনে অসম্মতি জানান এবং তিনি প্রায় তিন দশক ধরে আমেরিকা ভ্রমনের জন্য অনুমতি পাননি। আমেরিকা অভিবাসন তাকে ভিসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন অবশেষে ১৯৯৫ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আমন্ত্রনে তিনি সকল নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে আমেরিকা ভ্রমনে যান। তার লেখা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে প্রায় ডজন খানেক টিভি সিরিয়াল ও ফিল্ম তৈরী হয়েছে। অবশেষে বলা যায় তিনি সময়কে অতিক্রম করে মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছেন। তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা তাকে চিরস্মরনীয় করেছে। তিনি চেয়েছিলেন এক স্বপ্নিল জীবন গঠন করতে। যেখানে মানুষ সুন্দর জীবন গঠন কল্পে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। যেখানে ভালোবাসা ও সুখ মানুষকে পরিতৃপ্তির মায়াজালে আবদ্ধ করার পাশাপাশি মানুষের শতাব্দীঘেরা নিঃসঙ্গতাকে অতিক্রম করে মানুষকে সত্য, সুন্দর ও আলোর পথ দেখাবে। পরিশেষে বলা যায় ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল বিশ^ মানবতার এক প্রবাদ পুরুষ ও কলম্বিয়া তথা লাতিন আমেরিকার এক নক্ষত্র মাত্র ৮৭ বছর বয়সে মহাপ্রয়ানে চলে যান। তিনি সাধারণ পাঠকের মানসপটে চির অম্লান ও স্মরনীয় হয়ে আছেন। তিনি চেয়েচিলেন মৃত্যুর পর ও যেন তিনি বেঁচে থাকে। সত্যিই তিনি তার অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে আলোকিত সমাজে তিনি সাহিত্য প্রেমিদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। কবির ভাবনায়, “এনেছিলে সাথে করে মৃতুহীন প্রাণ মরনে তাহাই তুমি করে গেলে দান।” যদিও বাহ্যিক ভাবে এই মহা প্রবাদ পুরুষ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়াজালকে উপেক্ষা করে অসীম যাত্রায় মহা প্রয়ানে চলে গেছেন তথাপি তিনি তার অনুবদ্য সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের মানসপটে এক চিরস্থায়ী স্থান দখল করে গেছেন। এই জন্যই বোধ হয় জনৈক কবি বলেছিলেন “As long as the world exists, the name of Marquez will prevail in the hearts of the readers like glittering stars in the sky" লেখক: শিক্ষক ও গবেষক (লেখক বর্তমানে কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে সহকারি অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত।) ------------ প্রতিশোধ -------------- জয়াশিস বণিক ।। বেশ কয়েকদিন হলো নীতু খেয়াল করছে
ছেলেটা এই শীত ভোরেও টং দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।প্রচ- শীতে ও প্রতিদিন
দোকানী ঠিকই দোকান খোলে ।মনে হয় একজন আরেকজনের বন্ধু।না হয় এই সকালে কেউ
দোকান খোলে? ছেলেটা ছাড়া আর কোন কাস্টোমার ও নেই।স্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার
সময় ছেলেটা আর দোকানী এই দুইজনই থাকে।ফিরার সময় লোকজন বেড়ে যায়।অনেকই চা
দোকানে বসে আড্ডা শুরু করে ততক্ষণে।এতজনের মাঝেও ছেলেটার সাথে একবার
চোখাচোখি হবেই।নীতুর ভাবনায় রীতিমত ছেলেটা জায়গা করে নিয়েছে এই কয়দিনে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে শান্ত।পড়ালেখা শেষ করে বেকার।কয়েকটা চাকরির আবেদন করে রেখেছে কিন্তু এখনো ডাক পায় নি।কয়েকটা ভাইবা দিয়ে এসেছে সেখানেও কোন সাঁড়া নেই।শেষ যে ভাইবাটা দিয়েছিলো সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য, সেখানেও মোটা অংকের ঘুষ চেয়েছে।কর্মকর্তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করেও টাকা ছাড়া চাকরি ম্যানেজ করতে পারেনি শান্ত। এই নিয়ে বাবার সাথে কিছুটা বাকবিত-া করে শান্ত।সবকিছু তো কোয়ালিফাই করেছে, এখন টাকার জন্য তার চাকুরি হচ্ছে না।বাবা টাকাটা ম্যানেজ করে দিলেই তো পারে।কিন্তু বাবার সামর্থ ও নেই,ইচ্ছা ও নেই।তা নিয়ে খুব রাগারাগি হয় এবং শান্ত দুইদিন বাড়িও ফিরে নি।তৃতীয় দিন তার বাবার প্রচ- বুকে ব্যাথার খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে বাবাকে আর পায় নি।সেই থেকে তার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে এবং চাকরি কে দায়ী করে। সেগুনবাগিচার একটা সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে থাকে নীতু।তার বাবা-মা আর একমাত্র মেয়ে সে।বাবা সরকারি বড় চাকুরি করে।টাকা পয়সার অভাব নেই, তবে নীতুর খুব সহজ সরল জীবন।সে ভোরে উঠে রিক্সা নিয়েই স্যারের বাসায় পড়তে যায়, গাড়ি নিতে ভালো লাগে না তার।রিক্সার কারনেই প্রতিদিন চা দোকানের সামনে শান্তর সাথে দেখা হয়, কিন্তু কোন কথা হয় না প্রেমের শুরুতে মানুষ সাধারণত চোখে চোখে অনেক কথা বলে, যে ভাষা কেবল দুজনেই বুঝে আর কেউ বুঝে না।নীতু আর শান্ত দুজনের চোখে চোখে কথা হয়। প্রতিদিন একই রকমের দাঁড়িয়ে থাকা,একই রকমের চোখাচোখি আর ভালো লাগছে না নীতুর।সে এখন রীতিমত শান্তর চোখের নীল সাগরে ভেসে বেড়ায়,নীলনীল স্বপ্ন দেখে।ছেলের নির্লিপ্ততা যেন নীতুকে আরো গভীর প্রেমের আহ্বানে ডাকছে, সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। সেদিন ও রীতিমত শান্ত দাঁড়িয়ে চা দোকানের সামনে,চোখে চোখ পড়তেই অঘটন।হঠাৎ করেই একটা পাথরে ধাক্কা লেগে রিক্সা গেল উল্টে।নীতু ও পড়ে গেল।সামান্য ব্যাথা পেলেও নীতু খুব খুশি হলো,সে তো ভেবেই নিয়েছে শান্ত দৌড়ে এসে তাকে সাহায্য করবে।কিন্তু শান্ত এলো না।এই ভোরে কেউ নেই, তাই চা দোকানী দৌড়ে এসে সাহায্য করলো।শান্ত সেই আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে।রিক্সায় উঠে বাসায় যাওয়া পর্যন্ত নীতু ভেবেই পাচ্ছিলো না কোন ব্যাথাটা বেশি, রিক্সা একসিডেন্টের ব্যাথা নাকি শান্তর অবহেলার ব্যাথা।সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারে নি নীতু। পরদিন সকালে আবার একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত।রিক্সা থামিয়ে নীতু শান্তর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।শান্ত আপন মনে চা খেয়ে যাচ্ছে। নীতু দাঁড়িয়ে আছে শান্ত চা খাচ্ছে এই অদ্ভুত দৃশ্যের অবাক দর্শক চা দোকানি।কেউ কিছু বলছে না।নীরবতা ভেঙে দোকানি বললো, আফা চা দিমু? দেন- খেয়ে দেখি আপনার দোকানের চা কেমন।মানুষ সাত সকালে এসে আপনার চা খায় ক্যান একটু জানা দরকার। কি যে বলেন আফা, হাসতে হাসতে চা বানাতে লাগলো দোকানী। শান্ত ভাই আফনেরে দিমু নি আরেক কাপ। দাও। দরাজ গলায় বললো শান্ত। চা হাতে নিয়ে নীতু শান্তর পাশে বসলো। কেমন আছেন? নীতু জিজ্ঞেস করলো। ভালো, আপনি কেমন আছেন? আপনি আমাকে চেনেন? হ্যাঁ চিনিতো।প্রতিদিন সকালে এদিক দিয়ে রিক্সায় যান। শুধু এটুকুই? না,আরো জানি। আপনার নাম সুমাইয়া সুলতানা নীতু।অনার্স ফার্স্ট ইয়ার, গনিত, ইডেন কলেজ।বাসা সেগুন বাগিচা। বাহ আপনি দেখি আমার পুরো বায়োডাটা জানেন।হাসতে হাসতে বললো নীতু। আপনি প্রতিদিন এখানে বসে থাকেন কেন? চা খেতে আসি। শুধুই চা খেতে আসেন? হুম।মাঝেমাঝে আপনাকেও দেখতে ইচ্ছে করে। তখন একসাথে দুটোই হয়।আপনি রিক্সায় যান, আমি চা খেতে খেতে একনজর দেখে নেই।আপনার তো পড়ার সময় হয়ে গেছে। যাবেন না? না যাব না। আচ্ছা বসে থাকেন তাহলে। ইচ্ছে না হলে জোর করে পড়তে যাওয়ার কোন মানে হয় না। গতকাল আমার রিক্সা উল্টে যাওয়ার পর আমি আমাকে সাহায্য করতে গেলেন না কেন? ইচ্ছে করে নি তাই যাই নি। বাহ রে, একটা মেয়ে রিক্সা উল্টে পড়ে গেলো আর আপনার তাকে সাহায্য করতে ইচ্ছে করে নি? না করে নি। কেন? এমনিতেই। এটা কোন কথা হলো? আপনি আমার পুরো বায়োডাটা জানেন। মাঝেমাঝে আমায় দেখতে এখানে বসে থাকেন, অথচ আমাকে রিক্সা উল্টাতে দেখেও আপনার সাহায্য করতে ইচ্ছে হলো না? আপনি তো অদ্ভুত মানুষ। মানুষ মাত্রই অদ্ভূত জীব।অন্য সকল প্রাণীর তার গোত্রের সাথে স্বভাবে মিলবে কিন্তু একজন মানুষের স্বভাব আরেক জনের সাথে মিলবে না। এই যে দেখুন, অন্য কোন মেয়ে এভাবে এই শীতের ভোরে চা দোকানে বসে গল্প করতো না।এভাবে চা ও খেতো না। আপনিও অদ্ভূত। আমি জানি মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব তাই আমি অবাক হইনি। আপনি জানেন না তাই অবাক হয়েছেন। সাহায্য করতে তো গেলেনই না আবার দার্শনিক বাণী শুনাচ্ছেন। আপনি তো সত্যিই আজব মানুষ। আচ্ছা আপনি আমার এত তথ্য সংগ্রহ করেছেন কেন? এই ভোরে এসে চা দোকানেই বা দাঁড়িয়ে থাকেন কেন? একটু রাগী গলায় প্রশ্ন করলো নীতু। আপনার এতক্ষণে একটু ও বুঝতে বাকি নেই আমার উদ্দেশ্য কী? মুচকি হেসে উত্তর দিলো শান্ত। কিডন্যাপ করবেন নাকি? না, খুন করবো। বাহ, তাহলে আমি রাজি।কখন কিভাবে খুন করতে চান প্ল্যান করে জানাবেন। আজ তবে আসি। বাই। নীতু চলে গেলো। শান্ত চুপ করে বসে রইলো।চা দোকানে ধীরে ধীরে লোকজন আসতে শুরু করলো।লোকজনের মাঝেও নিজেকে পুরো একা ভেবে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে সে। পরদিন ভোরে আবার রিক্সা থেকে নেমে দোকানের সামনে গিয়ে বসলো নীতু।শান্ত খুব শান্ত মেজাজে চা খাচ্ছে। আফা চা দিমু? দেন এক কাপ খাই। শান্তের পাশে বসে নীরবে চা খাচ্ছে নীতু।চা শেষ করে সিগারেট ধারাতেই ওড়ানাতে মুখ চেপে নীতু খুব বিরক্তির সুরে বললো, এই গন্ধ আমার একদম সহ্য হয় না। যান তাহলে দূরে গিয়ে বসুন। আপনি নিজের ক্ষতি করছেন, অন্যের ও ক্ষতি করছেন এটা তো ঠিক না। আমি কারো ক্ষতি করছি না, চা সিগারেটের দোকানে সিগারেট খাবো না তো কি গোলাপ জল ছিটাবো? এভাবে কথা বলেন কেন? একটা সুন্দরী মেয়ে পাশে বসে থাকলে অন্য যে কেউ এই সিগারেট ধরাতো না।এখনো নাকে ওড়না ধরে আছে নীতু। আমি যে অন্যদের মত নই, তা আশাকরি বুঝে গেছেন?মেয়েদের সামনে মেয়েলি আচরণ কিংবা ন্যাকামী এসব আমি পারি না।এখন যান।আপনার ক্লাসের সময় হয়েছে। যেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে না করলে যাবেন না, তবে প্রতিদিন একই রকম ইচ্ছে হওয়া ভালো না।তাহলে ইচ্ছেরা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আচ্ছা তাহলে যাই। যাওয়ার সময় দেখা করে যাব।এই বলে নীতু উঠে গেলো। মামা আফনের কপালডা খুব ভালা।আনন্দভরা একগাল হাসি মেখে বললো দোকানী। কেন? কপালের আবার কি হলো? এত সুন্দর, বড়লোক, শিক্ষিত মাইয়া আফনের কাছে আইয়া বইয়া থাহে আর আফনে কেমুন জানি পাত্তা দেন না।বিষয়ডা বুঝলাম না। বেশি বুঝা ভালো না। চা কিভাবে আরো ভালো করে বানানো যায় সেটা বুঝলেই চলবে। মনটা খারাপ হয়ে যায় দোকানির। এভাবে নিয়মিত পাশাপাশি বসে চা খাওয়া, মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার মাঝে দুজনের গল্প এগিয়ে চললো। আপনাকে আর আপনি ডাকতে ভালো লাগে না।কেমন কেমন যেনো লাগে। ভালো না লাগলে নেই। সবসময় সবকিছু ভালো লাগতে হবে এমন কোনো কথা নেই।আমাদের সমাজে, বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে আর ভালো লাগে না। তবুও তারা মানিয়ে নিয়ে একসাথে দিব্যি সংসার করছে।তাই আপনিও আপনিতেই থাকুন। মন খারাপ হয়ে যায় নীতুর। কিছু না বলে ওঠে গিয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা বাসায় চলে যায়। পরদিন আবার যথাসময়ে উপস্থিত নীতু। কাল এভাবে অভিমান করে চলে গেলাম।একটু আটকানোর চেষ্টাও করলেন না।গম্ভীর কণ্ঠে বললো নীতু। এটা অভিমান না, ন্যাকামী।বেশিরভাগ মেয়েরাই এমন ন্যাকামী করে।ছেলেরা দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে আটকায়।এসব আমার দ্বারা হবে না। কাল কতবার আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেছে।অনেক রাগও হয়েছে।কিন্তু আপনার ফোন নম্বর নেই।তাই ফোন করতে পারিনি।আপনার ফোন নম্বর দিন। আমি ফোন ব্যবহার করি না। ওমা এই যুগে আপনি ফোন ব্যবহার করেন না!! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো নীতু।তার মানে ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপ কিছুই নেই? না নেই। আচ্ছা বলুন তো আপনি আসলে কী চান? আমি কি চাইবো? আপনিই এসে আমার পাশে বসে চা খান, গল্প করেন, অভিমান করে চলে যান।আবার ফিরেও আসেন।যা করার আপনিই তো করেন। আমি কিছু করিও না, চাইও না।কোমল কণ্ঠে জবাব দেয় শান্ত। আচ্ছা বাবা বুঝলাম। এখন চলুন। কোথায়? আপনাকে নিয়ে মার্কেটে যাবো।কিছু কেনাকাটা করবো। আপনি কেনাকাটা করবেন আমি গিয়ে কী করবো? কারন আপনার জন্য কেনাকাটা করবো। আর কোনো কথা বলবেন না।চলুন। কোনো উপায় না দেখে অগত্যা শান্তকে ওঠতে হলো। দুজনের সখ্যতা বেড়ে ওঠলেও, নীরস শান্তকে কোনো ভাবেই পরিবর্তন করতে পারলো না নীতু। অন্য কোনো যোগাযোগ নেই তাদের। একমাত্র চায়ের দোকানই দুজনের মিলনস্থল।মাঝেমাঝে রিক্সায় ঘুরতে যাওয়া কিংবা টিএসসি। একদিন সকালে নীতু খুব জোর করেই শান্তকে নিয়ে রিক্সায় ওঠলো। আচ্ছা আপনি কিছু করেন না কেনো? কি করবো? কেউ তো কোনো চাকরি দেয় না। আরে বাবা তাই বলে কিছু না কিছু তো করবেন।কোনো কিছু করার প্ল্যান তো অবশ্যই থাকবে। একটা খুন করার প্ল্যান আছে, কিন্তু টাইমিং মিলছে না।চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বললো শান্ত। হাসতে হাসতে নীতু বললো- আমি তো খুন হয়েই আছি আপনার প্রেমে। চলুন আপনাকে বাসায় নিয়ে যাই। কেনো? আব্বুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আব্বু চাইলে আপনার একটা ভালো চাকরি হয়েও যেতে পারে। শান্ত কিছু বলার আগেই রিক্সা থামলো নীতুদের বাসার সামনে। বিরাট ডুপ্লেক্স বাড়ি। সুসজ্জিত ড্রইং রুম।শান্তকে বসিয়ে রেখে উপরে গেলো নীতু। একটু পর আব্বুর হাত ধরে নীচে নেমে এলো। আব্বু এই হলো আমার একমাত্র বন্ধু শান্ত। তোমাকে পরিচিত মনে হচ্ছে।কোথায় যেনো দেখেছি, মনে পড়ছে না।নীতুর আব্বু চিন্তিত সুরে বললো। তোমরা গল্প করো আমি আসছি। এই বলে নীতু চলে গেলো। তোমাকে কোথায় দেখেছি বলতো? আমার চাকরির ভাইবা বোর্ডে আপনি প্রধান ছিলেন।টাকার জন্য আপনি আমাকে চাকরি দেননি। একটু পর ড্রইং রুমে ফিরে এসে নীতু দেখে তার বাবার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে ঝরছে রক্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় নিথর দেহটা পড়ে আছে। শান্ত নেই। শান্তকে আর কখনো কোথাও দেখা যায় নি |