বুধবার ২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২
বায়ুদূষণে গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর আট মাস
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:০১ এএম |

 বায়ুদূষণে গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর আট মাস
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় বায়ুদূষণের কারণে বিশে^র কোন দেশের অধিবাসীদের গড় আয়ু কি পরিমাণ কমেছে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে গেছে। বর্তমানে বিশে^র সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সনের তুলনায় বায়ুদূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে ২০২০ ও ২০২১ সনের তুলনায় ২.২ শতাংশ কমেছে।
বায়ুদূষণ বিশ^বাসীর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। বিশ্বের ছয়টি দেশে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, চীন, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। সামাগ্রিকভাবে দূষিত বায়ু মানুষের আয়ু কমিয়ে দিয়েছে। ধূমপানে মৃত্যুর চেয়ে তিনগুণ, সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর চেয়ে পাঁচগুণ মানুষ বায়ুদূষণের মারা যায়। বায়ুদূষণে বিশে^র বিভিন্ন দেশে মানুষের গড় আয়ু কি পরিমাণ কমেছে তা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বায়ুর মান অনুযায়ী বিশে^র বিভিন্ন দেশের মানুষের আয়ু ১ বছর থেকে ছয় মাস কমে যাচ্ছে। গত ১ যুগে বিশে^ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। দূষণরোধে তাদের নেয়া পদক্ষেপসমূহ দেশটির বায়ুর মানে ৪২ শতাংশ উন্নতি হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লক্ষ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে। যাহা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্রবস্তু কণা ৫ মাইক্রগ্রামের চেয়ে বেশী। তবে বাংলাদেশের একেক এলাকায় বায়ুর অবস্থা একেক রকম। বড় শহরগুলোর তুলনায় গ্রামের বায়ুর মান ভালো। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মল বায়ুর নগরী সিলেটেও বায়ুদূষণ আন্তর্জাতিক মানের ১০ গুণ। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হল গাজীপুর। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে কাছের শিল্প এলাকা গাজীপুরের মানুষের আয়ু আটবছর তিন মাস কমে গেছে। আর বাংলাদেশে গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর আটমাস।
বায়ুর মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে ইউরোপের দেশগুলো। সেখানকার অধিবাসীরা ১৯৯৮ সনের তুলনায় ২৩.৫ শতাংশ ভাল বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। সেখানকার বেশির ভাগ দেশ এয়ার কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক ডিরেক্টরি তৈরি করেছে। ঐ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্য্যায়ে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনো সেখানকার ৯৮.৪ শতাংশ মানুষ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বায়ুর মধ্যে বাস করছে। তারা ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুর মান ওই মানমাত্রার মধ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে বুরুন্ডি, কঙ্গো, রুয়ান্ডা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় পেরু, বলিভিয়া ও গুয়েতেমালার বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ। যুক্তরাষ্ট্র নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুর মানের উন্নতি করেছে। দেশটি ১৯৭০ সনের তুলনায় বায়ুর মান ৬৫ শতাংশ উন্নতি করেছে। তবে আন্তর্জাতিক গড়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা এক বছর চারমাস বেশি বাঁচে। এর কারণ দেশটি নির্মল বায়ু আইন করেছে। রাষ্টীয়ভাবে ঐ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলছে। চীনের উদাহরণ টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈনিক বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে দেশটি যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ ক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। তারা ২০১৩ সালের তুলনায় ৪২.৩ শতাংশ বায়ুদূষণ কমিয়েছে। এতে তাদের নাগরিকদের গড় আয়ু দুই বছর দুই মাস বেড়েছে। তবে এখনো চীনের বায়ুর মান বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুর মানের তুলনায় ছয়গুণ বেশী। একই সঙ্গে এদের গড় আয়ু আড়াই বছর কমে যাচ্ছে। সামাগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৯৯.৯ শতাংশ বাতাস মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বা দূষিত।
বিশ্বে অন্য যেসব কারণে সামগ্রিকভাবে গড় আয়ু কমে তার সঙ্গে বায়ুদূষণের তুলনা করা হয়েছে। সবচেয়ে গড় আয়ু বেশি কমেছে হৃদরোগ ও রক্ত প্রবাহের সমস্যার কারণে। এতে বাংলাদেশের প্রত্যেক অধিবাসীর গড় আয়ু ছয় বৎসর ৮ মাস কমে গেছে। এরপরই রয়েছে বায়ুদূষণ। ধূমপানের কারণে কমেছে দুই বছর এক মাস, শিশু ও মাতৃত্বকালীন অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে কমেছে ১ বছর ৪ মাস। বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোর বায়ুর মান গ্রামের তুলনায় বেশ খারাপ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত বড় বড় শহরে ৭ কোটি ৪৭ লাখ লোক বসবাস করে। এসব শহরের মানুষের গড় আয়ু সাত বছর ছয় মাস কমে যাচ্ছে। তবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসরণ করে বায়ুর মান ঠিক করা গেলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়তে পারে। ঢাকায় এভাবে গড় আয়ু ৮০ বছর ১ মাস বাড়ানো সম্ভব। আর চট্টগ্রামে তা বাড়তে পারে ৬ বছর ৯ মাস। আর সারা দেশে গড় আয়ু বাড়তে পারে ৫ বছর ৮ মাস।
প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বায়ু। যা সহজেই দূষিত হয়ে যায় এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই দূষণমুক্ত বায়ুতে শ^াস নেয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণে ২০১৯ সনে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মারা যায়, যা ২০১৭ সনের তুলনায় ৫০ হাজার বেশী। বিশে^ ২০২২ সনে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় বাংলাদেশের নাম পঞ্চমে উঠে এসেছে। তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে অবনতি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যও। বাড়ছে উদ্বেগ ও অবসাদ। ময়লা, ধূলাবালি, কালো ধোঁয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদান কেন্দ্র, নির্মানাধীন ভবন বা স্থাপনা থেকে তৈরি হওয়া বায়ুদূষণ আমাদের জনজীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। বাড়ছে শ^াসকষ্টসহ নানা জটিল রোগ ও মানসিক সমস্যা। জ¦ালানি থেকে অতিরিক্ত নির্গত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। এসব বিষাক্ত গ্যাসের কণা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে যায়। এসব কারণে হতে পারে ঘাতকব্যাধি ক্যান্সার, হাঁপানি ও স্ট্রোক (মস্তিস্কের রক্তক্ষরণ)। বিশেষভাবে শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও দরিদ্রে জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণে বেশী আক্রান্ত হন।
যানবাহন থেকে নির্গত বায়ুদূষণ যেমনÑ কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। একটি নতুন ইঞ্জিন ৫ থেকে ১০ বৎসর এ সমস্ত বিষাক্ত গ্যাস কম নির্গমন করে। আর ১০ থেকে ২০ বৎসর পর্যন্ত কালো ধোঁয়া নির্গমনের সঙ্গে এ সকল বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন করে। কিন্তু বাস মালিকরা ২০ বছরের পরেও রাস্তায় গাড়ী চালানোর পারমিশন চায় যাহা কোনক্রমেই ১০ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। ঢাকা শহুরে প্রতিদিন কয়েক লাখ যানবাহন চলে যেখানে বিকট শব্দের সঙ্গে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণকে বাড়িয়ে তুলছে। গবেষণায় দেখা গেছে সিএনজি চালিত যান কম দূষণ ঘটায়। তাই সিএনজি চালিত যান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কলকারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে নির্গমন নল ও চিমনি থেকে বাস্তুকণা পৃথক করার জন্য ছাকুনি বা অন্য কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। বায়ুর স্তর সংরক্ষণে প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে জীবাশ্ম জ¦ালানির পরিমাণ কমিয়ে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিভিন্ন পরিত্যক্ত বর্জ্য না পুড়িয়ে রিসাইকলিং ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যেতে পারে। কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প উপায়ে শস্যের রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। হাটবাজার, বসতবাড়ি থেকে পচনশীল দ্রব্য দ্রুত অপসরণ করতে হবে। শহরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে রাখা ডাস্টবিনের ময়লা দ্রুত শোধনাগারে পাঠাতে হবে। সর্বোপরি বৃক্ষরোপনের গতানুগতিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। কেননা উদ্ভিদ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সর্বোচ্চ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ













সর্বশেষ সংবাদ
নতুন বইয়ের বর্ণিল নতুন বছর
নৌকায় ভোট নিতে ভাতার কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা অধ্যক্ষ পদে অধ্যাপক ডাঃ রুহিনী কুমার দাস এর দায়িত্ব গ্রহণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত
বরুড়ায় শ্রমিকদল নেতাকে ছুরিকাঘাত
অর্ধেক দামে ফ্রিজ বিক্রি করছেন ফ্রিজ প্রতীকের প্রার্থী
বাড়ির জন্য কেনা জমিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যাওয়া একই পরিবারের ৪ জনের কবর
৫৫ কেজি সোনা চুরি, ফের রিমান্ডে দুই রাজস্ব কর্মকর্তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২