
প্রকৃতির
নিয়মে প্রতিদিনের ন্যায় ভোরের সূর্য উঁকি দেয় ‘বসুর মার’ ঘরেও। সূর্য উঠার
আগেই সংসারের কাজের তারনায় ঘুম ভাঙ্গে ‘বসুর মার’। অন্যান্য পরিবারের
নারীরা যখন ভোর থেকে সংসারের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি স্বামী-সন্তানদের খাবার
তৈরি, কাজের জন্য বের করে দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তখন ‘বসুর মার’ কাজও
কম নয়। তবে তাঁর কাজের ধারা অনেক ভিন্ন।
এক ডজন সন্তানের মধ্যে ৬টি
খোয়ানোর পর ছোট-বড় বাকি ৬ সন্তান নিয়েই তাঁর সংসার। এর মধ্যে পরিবারের
সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তানের ভেঙ্গে গেছে দুই পা। কোলে নিয়েই চড়ে বেড়ান সারাদিন।
বাকি পাঁচের এদিক সেদিক ছুটে চলায় দারুন যন্ত্রনা ভোগের মধ্য দিয়েই সারা
দিনের কর্ম ব্যস্ততা তাঁর।
‘বসুর মা’ কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার
প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। নিজ গর্ভের কোন সন্তান না থাকলেও এলাকায় ‘বসুর
মা’ হিসেবেই বেশ পরিচিত। প্রকৃত নাম রেনু বালা দত্ত। প্রায় ৫৫ বছর আগে
চান্দিনা উপজেলার কংগাই গ্রামের বাসিন্দা ক্ষিতিশ চন্দ্র দত্তের সাথে বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দাম্পত্য জীবনে তাঁর কোন সন্তান না থাকায় ‘মা’ ডাক
শোনার ভাগ্য জুটেনি তাঁর। স্বামী ক্ষিতিশ চন্দ্র দত্ত মারা গেছেন বহু আগে।
অভাব অনটনে থাকা রেনু বালা প্রায় ২৫ বছর আগে একটি ছাগল কিনে সন্তান স্নেহে
পালন করার পাশাপাশি তার নাম রাখেন ‘বসু’। আর সেই থেকে এলাকাবাসী ‘বসুর মা’
নামে ডাকতে শুরু করায় এখন তাঁর ‘রেনু বালা’ নাম বাড়ির মানুষ ছাড়া আর কেউ
জানেন না।
‘বসু’ নামের ওই ছাগল থেকে বংশ বিস্তার করা ওইসব ছাগলের
লালন-পালনে সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততা তাঁর। সরেজমিনে কংগাই গ্রামের ‘বসুর
মার’ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তাঁর মানবেতর জীবন যাত্রার দৃশ্য। তাৎক্ষনিক মনে
পড়ে যায় পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সেই ‘আসমানী’ কবিতার কথা।
‘আসমানীরে
দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও/ বাড়ি তো নয়
পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি / একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি’
ফরিদপুরের রসুলপুর গ্রামের অসহায় দরিদ্র ‘আসমানী’কে নিয়ে পল্লী কবি জসিম
উদ্দিন কবিতা সর্ব মহলে সমাদৃত।
ওই আসমানীর চেয়ে অসহায়ত্বে কোন অংশেই
কম নয় ‘বসুর মা’। পল্লী কবি জসিম উদ্দিন বেঁচে থেকে যদি ‘বসুর মা’কে দেখতেন
হয়তো লিখতেন, ‘বসুর মাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ রেনু বালার ছোট্ট বাড়ি
কংগাই গ্রামে যাও’।
স্বামীর ৬ শতাংশ ভিটির এক পাশে জরাজীর্ণ একটি ঘর।
ভাঙ্গাচুরা ঘরের চালা কোন দিকে থেকে খুলে ঝুলে আছে। আবার কোনটি ফাঁকা হয়ে
আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের বেড়ায় শত জোড়া তালি। দরজায় নেই চৌকাঠ। উপরের অর্ধক
জুড়ে টিনের ঝাপা, জ্বানালার মতো করে রাখা দরজায় টিন ও কাঠের টুকরো আর
বস্তার ছেড়া অংশ দিয়ে আটকানো। ঘরের ভিটিতে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক গর্ত।
স্বামীর আমলের কাঠের চৌকি ভেঙ্গে গেছে বহু আগে। অবশিষ্ট্য কাঠের ২টি তক্তাই
‘বসুর মার’ শয্যার একমাত্র ভরসা।
অর্ধাহারে-অনাহারে পেট যেন মিশে গেছে
পিঠের সাথে। প্রায় ৭০ বছর বয়সী রোগাক্রান্ত রেনু বালার চিবিয়ে খাওয়ার একটি
দাঁতও নেই। সন্তানদের যত্ন নিতে গিয়ে ভুলে গেছেন কবে যে মাথায় চিরুনি
গুজেছেন। জটাকার মাথার চুল যেন পাখির বাসা। নিজের শরীরের যত্ন না নিলেও
সকাল-সন্ধ্যা জরাজীর্ণ ঘরের ভিতর পরিস্কার ও দরজায় কাঁদা-পানির লেপনীতে যেন
ভুল করেন না তিনি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘বসুর মা’র বাড়িতে গিয়ে দেখা
যায়, ভাঙ্গাচুরা জরাজীর্ণ ঘরের দরজায় কাঁদা মাটি ও পানিতে লেপুনি দিচ্ছেন
তিনি। ঘরের ভিতরে ছোট-বড় ছয়টি ছাগল। মানুষ দেখেই যেন তিনি অনেকটা অস্বস্তি
বোধ করছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে হওয়ায় সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার খুব
তাড়া তাঁর। কাউকে কিছু না বলেই ছাগল গুলো ঘর থেকে বের করে দরজাহীন ঘরের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছেঁড়া রেক্সিনের বস্তা বাঁধেন। সামনের দুই পা
ভাঙ্গা ছাগল ছানাকে কোলে নিয়ে বাকি পাঁচটিকে কোনটিকে ‘বকুল’ কোনটিকে ‘শোভা’
ইত্যাদি নামে ডেকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য বাহিরে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কোনটি কথা
না শুনে দিক বেদিক ছুটলে গালমন্দ করে ‘এডির যন্ত্রণায় আর ভালা লাগেনা’ বলে
রাগান্বিত হতেও দেখা গেছে। মনে হচ্ছে যেন সন্তানদেরই ডেকে খুঁজে শাসন করে
চলছেন তিনি।
বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করার পর বলে উঠেন, ‘ছাগলডি
তারা চুরি কইরা লইয়া গেছে।’ বলেই কাপড়ের আঁচল টেনে চোখ মুছতে থাকেন
স্বামী-সন্তানহীন রেনু বালা।
প্রতিবেশি লিপি রাণী দত্ত জানান, সকাল
থেকে সারা দিন ছাগল নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি। কেউ কোন খাবার দিলে সেগুলো
ছাগলকেও খাওয়ায় আবার নিজেও খান। ঘরের ভিতরের গর্তগুলোতেই ছাগল থাকে। আর
ছাগলের পাশেই ২টি কাঠের তক্তা বিছিয়ে ঘুমান তিনি। প্রায় সময়ই ঘর থেকে ছাগল
চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। এমনকি মানুষের দেওয়া দানের টাকাও নিয়ে যায় তারা।
গত কয়েকদিন আগেও নিয়ে গেছে ৬টি ছাগল। এমন মানবেতর জীবন-যাপন এ সমাজে আর
কেউ করে বলে আমার মনে হয়না।
গল্লাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীর
মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম দর্জি জানান, ‘বসুর মার’ ছাগল ছিল ২০-২৫টি। আমরা
বেশ কয়েকটি বিক্রি করে টাকাও দিয়েছি। মহিলাটি খুবই অসহায়। মানুষের সাহায্যে
বেঁচে আছে। সম্ভবত তাঁর এনআইডি কার্ডও নেই. যে কারণে কোন ভাতা পাচ্ছে না।
আমি শীঘ্রই প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে এনআইডি কার্ড করে বিভিন্ন ভাতার
আওতায় আনার ব্যবস্থা করবো।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)
তাপস শীল জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। যেহেতু এখন জেনেছি, খুব শীঘ্রই খোঁজ
নিয়ে তাঁকে পুনর্বাসনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।