গত ৮ই
মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের তিন নেতাকে স্থানীয়
ছাত্রদল নেতা ও বহিরাগতদের দিয়ে বেধড়ক মারধর করিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের
আরেকটি পক্ষ।
মারধরকারীরা হলেন- কুমিল্লা মহানগর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের
যুবদল নেতা রনি মজুমদার এবং কুবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা খালেদ
সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃত আসামি ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব চন্দ্র
দাস, সাবেক শিক্ষার্থী ফয়সাল, ইকবাল এবং কাওসার হোসেনসহ ১০ থেক ১২ জন
ছাত্রদল-ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন, এ ঘটনায় সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী।
ছাত্রলীগের
নেতাদের দাবী, রেজা-ইএলাহী সমর্থিত অভিযুক্ত বিপ্লব চন্দ্র দাস, স্বজন বরণ
বিশ্বাস, ইকবাল খান ও অন্যান্য নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত
প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী রানা সমর্থিত। এমনকি স্বয়ং রেজা ই এলাহী, খুনের
আসামী বিপ্লব চন্দ্র দাস এবং ইকবাল খান সরাসরি ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের
উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা
অভিযোগ তুলেছেন, ছাত্রলীগের ইতোপূর্বের প্রতিটি ঘটনা এবং সর্বশেষ কমিটি
বিলুপ্তির ঘটনায় সরাসরি জড়িত রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর। কাজী ওমর
সিদ্দিকীর বিভিন্ন উদযাপন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ওয়ালে বিভিন্ন
স্ট্যাটাসকে ঘিরে এসকল বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে।
জানা যায়, গত ৬ মার্চ
ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি হয় বিকাল ৫ টায়। একইদিনে ভোর ৭টা ৩৫ মিনিটে একটি
পোস্ট করেন। যেখানে তিনি বলেন, 'আজকের সকালের আবহাওয়াটা কি সুন্দর ও
রহস্যময়। শুভ সকাল।' আবার বিকেল ৫টা ১১ মিনিটে তার টাইমলইনে আরেকটি পোস্টে
লিখে 'আজকে সূর্যস্তা কয়টায়?' শিক্ষার্থীদের দাবী, প্রক্টর বিষয়টি আগে
থেকেই জানতেন এমনকি কমিটি বিলুপ্তির বিষয়ে তিনি জোরালো ভূমিকা রেখেছেন।
গত
৯ মার্চ শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ঘটনার
ধারাবাহিকতায় প্রমাণ করে প্রক্টর সম্পূর্ণ বিষয়টি পূর্বে থেকে জানতেন।
এমনকি বিভিন্ন সময়ে কমিটি ভাঙতে প্রক্টর অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ঢাকায়
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাদের কাছে গিয়েছেন। এমনকি কুমিল্লার গোমতী
নদীর পাড়ে জেলা যুবলীগের এক নেতার সাথে হাস পার্টি এবং নিজ বিভাগের কক্ষে
বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করেছেন।
এছাড়া গত ৩০ জানুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের ২০১৭
সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী চিহ্নিত এসকল সন্ত্রাসী ও
সাবেক শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ‘অবৈধভাবে’ উঠতে গেলে
তাঁদেরকে বাধা দেন তৎকালীন সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সমর্থিতরা। এতে প্রক্টর
সেখানে বহিরাগতের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং বহিরাগতদের হলে প্রবেশে
বাধা প্রদান করায় সহকারী প্রক্টর অমিত দত্তের সঙ্গে ইলিয়াস সমর্থিত এনায়েত
ও সালমানের বাগবিতণ্ডা ঘটে এবং উভয়পক্ষকেই উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়।
তবে
ঘটনার দুই মাস পন ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির পরের দিন ৭ই মার্চ
প্রক্টরিয়াল বডির কর্তব্য পালনে বাধা, শিক্ষককে হেনস্থা এবং
বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতা এনায়েত
উল্লাহ এবং সালমান চৌধুরীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
যদিও বহিষ্কারের এ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট
শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া হঠাৎই ঘটনার ২ মাস পর
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিধি এবং তদন্ত ছাড়া ‘উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী’
বহিষ্কার করায় এ ব্যবস্থার পদ্ধতি ও ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা।
বহিস্কারের পরের দিন ৭ মার্চ রাতে
রেজা-ই-এলাহি নেতৃত্বে হলে তালা ভেঙ্গে রুমে প্রবেশ করলে পরবর্তীতে হল
প্রভোস্ট এসে রুমটি সিলগালা করে দেয়। এসময় তারা হলের বিভিন্ন নেতাকর্মীকে
ভয়-ভীতি দেখান বলে অভিযোগ রয়েছে।
নজরুল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পলাশ
মাহমুদ জানান, এ ঘটনায় প্রক্টর সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন। খুনি বিপ্লব ও
ছাত্রদলের লোকজন কীভাবে একজন হল ছাত্রলীগের সেক্রেটারিকে মারধর করে?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পূর্বের ঘটনায়ও দেখেছি
প্রক্টর তার ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ছাত্রলীগের মাঝে বিভেদ তৈরি এবং যখন
পদক্ষেপ নেয়ার দরকার তখন নিরব ভূমিকা পালন করেছেন।
এর আগে গত বছর ১
অক্টোবর শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে একপক্ষের
নেতা রেজা-ই-এলাহি সমর্থিত নেতাকর্মী এবং বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে মাটরবাইক
শোডাউন, ককটেল বিস্ফোরণ, ফাঁকাগুলি ছুড়ে। ঘটনার দিন দুপুর ৩টায় প্রক্টরিয়াল
টিম সামনে উপস্থিত থাকলেও প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রক্টর। এমনকি
তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন এবং সে অনুযায়ী মামলার কথা কথা জানালে পরবর্তীতে
সেটিও বাস্তবায়ন করেনি।
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কাজী নজরুল ইসলাম হলের
ছাত্রলীগের সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনায় প্রক্টর উপস্থিত
থাকলেও কোন পদক্ষেপ কিংবা পুলিশ মোতায়েনের ব্যববস্থা না করায় প্রক্টরের
ইন্ধনের অভিযোগ তুলে ছাত্রলীগের নেত-কর্মীরা বলেন ছাত্রলীগের কমিটি
বিলুপ্তি করার জন্য একপক্ষকে উসকে দিয়েছিলো। কিন্তু দফায় দফায় সংঘর্ষের
ঘটনা ঘটলেও কেন পুলিশ মোতায়েন হয়নি এবং প্রক্টর টিমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
তোলেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে সেসময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে এ ঘটনার কোন সুরাহা কিংবা দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়নি
প্রক্টর।
মূলত প্রতিটি ঘটনায় কখনও নিরবতা, কখনও অপরাধের সাথে সরাসরি
যোগসাজশ এবং ছাত্রলীগের একপক্ষের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্নভাবে উদযাপনের
কারনে মূলত সরাসরি ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
তুলছেন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এছাড়াও কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি বাণিজ্যের সঙ্গে ও জড়িত
রয়েছে। অধিগ্রহণের বিভিন্ন নথি থেকে পাওয়া যায়, প্রক্টর ভূমি অধিগ্রহণের
আগে ৬১১৩ ও ৬১১৪ নম্বর দাগে নিজের নামে জমি কিনে রাখেন। যেসকল দাগে
অভিযুক্ত ছাত্রলীগের পক্ষের নেতাকর্মীরা জড়িত রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু হল
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন বলেন, ৮ মার্চ সকাল
১০টার দিকে যখন আমি নাস্তা করতে যাই হল গেইটে জুনিয়র ও সিনিয়রদের সামনে
খুনি বিপ্লব আমাকে হুমকি দেয়। তোরা কি হল থেকে বের হতে পারবি কুমিল্লার
ডিসি, ভিসি, রানা স্যার ও প্রশাসান আমাদের। তোদের তো গুলি করে মেরে ফেলবো।
তোরা কোথায় থেকে এসে এখানে রাজনীতি করছ? এরপর হলের সবার সামনে কাউসার এসে
আমার গলায় হাত দিয়ে বলে ছুরি দিয়ে পোঁচ মারবো। বিপ্লব বলে তুই হলে সবাইকে
নিয়ে মিটিং করবি আমরা আসবো। আর না হয় শুধু মাইর চলবে। এর দুইঘন্টা পরে
তাজান্না কনফেকশনারির সামনে তারা বহিরাগতদের নিয়ে হলের তিন নেতাকে মারধর
করে।
আন্দোলনের মুখপাত্র রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম বলেন,
সব থেকে বড় অভিযোগ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যত
বিশৃঙ্খলা ঘটেছে সব ঘটনার পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। কখনো
তাদের হলে ঢুকিয়েছেন, বা তাদের পরামর্শে হল সিলগালা করেছেন। এসব ঘটনায়
ব্যবস্থা না নিয়ে তিনি ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। অভিযোগপত্র দিতে গেলে তিনি
অভিযোগপত্র গ্রহণ করেননি, উল্টো উপাচার্য স্যারের নাম বিক্রি বলেছেন উচ্চ
পর্যায়ের প্রশাসনের অনুমতি ব্যতিরেকে তিনি অভিযোগপত্র গ্রহণ করবেন না। আর
কি প্রমাণ লাগে এতসব কিছুর পরেও! বিপ্লবের মতো আসামীদের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে
দেওয়া। অছাত্র, বহিরাগতদের সাথে নিজের বিভাগে, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে,
বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেওয়া!
শিক্ষার্থীদের এতসব অভিযোগের বিষয়ে
জানতে চাইলে প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ফেইসবুক হল আমার
ব্যক্তিগত বিষয়। এটা নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলবো না। এটা নিয়ে কি আপনি
আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন? অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশ্ন করা হয়েছে বলার পর বলেন
তাহলে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। ৭ই মার্চে যারা ফুল দিয়েছে তারা উইকেন্ড
কোর্সের ছাত্র। তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারে না? ভূমি বাণিজ্যের সাথে
রাজে-ই-এলাহির সাথে সম্পৃক্তার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন আমি আমার
রাষ্ট্রের যে কোন জায়গাতে জমি কিনতে পারি সমস্যা কোথায়?
পরে প্রতিবেদকের
সাথে উত্তেজিত হয়ে বলেন, আপনি তদন্ত করবেন না আপনার কি বিবেক বু্দ্িধ নাই?
আমি আমার টাকা দিয়ে জমি কিনছি সমস্যা কোথায়? আমার বিরুদ্ধে স্পেসেফিক কোন
অভিযোগ নাই সবই বানোয়াট কথা বার্তা, যদি সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে তাহলে
সেটা তাদের কে বলতে বলেন।