বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪
৭ কার্তিক ১৪৩১
শচীন দেববর্মনঃ
যিনি হতে পরতেন ত্রিপুরার রাজা
রেজাউল করিম শামিম
প্রকাশ: শনিবার, ১১ মার্চ, ২০২৩, ১২:০২ এএম আপডেট: ১১.০৩.২০২৩ ১:৪৬ এএম |

যিনি হতে পরতেন ত্রিপুরার রাজা

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আমাদের কুমিল্লার গর্ব,ইতিহাস,ঐতিহ্যের ধারক শচীন দেববর্মন। তিনি ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান-উত্তরাধিকার। কিন্তু তিনি রাজ পরিবারের ‘মানিক্য বাহাদুর’ উপাধি ধারন না করে ‘শচীন কর্তা’ হিসাবেই সারাটা জীবন সঙ্গীতের মহারাজ হয়েই জীবন কাটিয়ে গেলেন। তাও আবার যার জীবনের মূল্যবান সময়টা ত্রিপুরায় না হয়ে, কুমিল্লাতেই কাটিয়েছেন। আমাদের ধন্য করে গেছেন। তার নেপথ্যে রয়েছে অনেক যন্ত্রনাদায়ক কাহিনী, যা আমাদের অনেকেরই অজানা।
আগ্রহীদের এসব বিষয়ে আদ্যপ্রান্ত জানার চাহিদা মেটানো সম্ভব একটি বই থেকে। বইটি একটু মোটাসোটা, স্বাস্থ্যবান বলা যায়। তবে গুরত্ববহ তাতে সন্দেহ নেই। ‘শচীন দেববর্মন-মর্তের রাজ্য ছেড়ে সুরের সাম্রাজ্যে’ শীর্ষক ৫৯৬ পৃষ্ঠার আলোচ্য বইটি লিখেছেন,কুমিল্লার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রখ্যাত আইনজীবী, গবেষক গোলাম ফারুক।
আমার ঘনিষ্টজন, এডভোকেট গোলাম ফারুক, ফারুক ভাইয়ের একই ব্যাপ্তির আর একটি বই হলো,‘নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ও রূপজালাল‘। বই দু‘টি সম্প্রতি আমাকে উপহার হিসাবে তুলে দিয়েছেন তিনি।
প্রথম বইটি,শচীন দেববর্মন কে নিয়ে লেখা,“মর্তের রাজ্য ছেড়ে সুরের সাম্রাজ্য”।বইটি পড়লে শচীন দেববর্মনের মতো বিশ্বজোড়া পরিচিত একজন গুণী শিল্পীর জীবনের ট্যাজেডি আর শিল্পীর উচ্চস্তরে পৌঁছে যাওয়ার কাহিনী  তো জানা যাবেই  সেই সাথে আমাদের প্রিয় কুমিল্লা এবং কুমিল্লার আদি ভূমি ত্রিপুরার রাজরাজাদরে প্রায় পাঁচশ’ বছরের রাজত্বের ইতিহাস-উত্থান-পতন, নানা ষড়যন্ত্র, মোঘল-বৃটিশের শাসনের নানা ঘটনার বিস্তৃতিও জানা হয়ে যাবে। আর সে সাথে ত্রিপুরা রাজপরিবারের সুদীর্ঘকাল জুড়ে মামলা- মোকদ্দমা সংক্রান্ত নানা ঘটনাবলি,কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্য আর আনেক গুণীব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আগ্রহীদের অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়াও সম্ভব হবে।
জনাব ফারুক ভাই বইটি রচনা করতে গিয়ে দেশবিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে,নানান বইপুস্তক ঘেটে,সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অনেকটা গভীর সমুদ্রসেচে মানিক তুলে আনার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করেছেন।এক্ষেত্রে আর্কাইভের কাজ অনেক বেশি, যা অনেক গবেষককেই কষ্ট করে করতে দেখা যায় না। প্রামান্য দলিল-দস্তাবেজ সেই সাথে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমান সংগ্রহ করার কষ্টসাধ্য কাজটি করেছেন ফারুক ভাই। আর এজন্যে কেটে গেছে তাঁর বারোটি বছর।
এই বই লেখার নেপথ্য কাহিনী বলতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেছেন। বইটি থেকে জানা যায় যে,শচীন দেবের পিতা ছিলেন মহারাজ কুমার নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মন। তাঁর পিতা ঈশানচন্দ্র রাজা থাকাকালীনই ১২৭২ ত্রিপুরাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গত কারণেই নবদ্বীপেরই রাজা হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সেসময় নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন নাবালক। পিতার মৃত্যুর পর দেখা যায় যে এক ‘রোবকারী (রাজফরমান)তে রাজা তার জীবদ্দশায় ভ্রাতা বীরচন্দ্র ঠাকুরকে যুবরাজ,জৈষ্ঠপুত্র ব্রজেন্দ্র চন্দ্রকে বড়ঠাকুর এবং নবদ্বীপ চন্দ্রকে কর্তা পদে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। আর এই ক্ষমতা বলে বীরচন্দ্র সিংহাসন দখল করে বসেন। সেসময়কার বৃটিশ সরকারও তাকে রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে শাসনকাজ চালাতে দেয়। কিন্তু,প্রয়াত রাজা ঈশান চন্দ্রের দুই রানী রাজলক্ষী দেবী ও চন্দ্রেশ্বরী দেবী এবং কথিত রাজার ভাতৃদ্বয় এই ফরমান অস্বীকার করেন। তারা  বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে মামলাও ঠুকে দেন। সেই মামলার দীর্ঘ পথ চলাসহ নবদ্বীপের প্রতি চরম অন্যায়,অত্যাচার আর অবেহেলার কাহিনী বইটির পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। এডভোকেট ফারুক, বিভিন্ন নথিপত্র সংগ্রহ করে বইটিতে তুলে ধরেছেন। শেষ পর্যন্ত নবদ্বীপচন্দ্রকে মামলায় হারানো হয়। ফলে শেষমেষ ভগ্নহৃদয় নিয়ে তিনি নৌকাযোগে কুমিল্লা চলে আসেন। আর তার থাকার ব্যবস্থা করে দেন তৎকালিন একজন জমিদার, চৌধুরী মোহাম্মদ গাজী। তিনি ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছার স্বামী।

তা যাই হোক, রাজ্যবঞ্চিত নবদ্বীপচন্দ্রের আরো অনেক ঘটনা প্রবাহ বিস্তারিত রয়েছে বইটিতি। কুমিল্লা বসবাসের সময়ই ১৯০৬ সালে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেববর্মনের জন্ম। তিনি কুমিল্লা ইউসুফ স্কুল,কুমিল্লা জেলা স্কুল এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া করেন। সেসময় তিনি কুমিল্লার শ্যামাচরনের কাছে সঙ্গীত চর্চা করেন। তিনি তাঁর দুই ভৃত্য মাধব ও আনোয়ারের কাছ থেকেও গানের অনেক কিছু সংগ্রহ করেন।বিএ পাশ করার পর শচীনদেব কলকাতা চলে যান এবং সেখানে এমএ ভর্তি হন। পরে গমন করেন মুম্বাই। সেখানেও কুমিল্লার প্রভাব তাঁর উপরে ছিলো। তিনি, কুমিল্লার সন্তান চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজামদারের আমন্ত্রনে সেখানে অবস্থান করেন। পা রাখেন চলচ্চিত্রের অঙ্গনে। শুরু করেন সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘শিকারী’। সেখানেই তিনি ঢাকার মেয়ে শিল্পী মীরা দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
এমনি অনেক তথ্যের মালা গেঁথে সুনীপুণভাবে গোলাম ফারুক, শচীন দেববর্মন এর  সুরের সাম্রাজ্যে রাজা হয়ে ওঠার কাহিনী তুলে ধরেছেন। সাথে সাথে বিভিন্ন দলিল, দূর্লভ ছবি,শচীন কর্তার রেকর্ডের তালিকা, জীবনপঞ্জি, তাঁকে নিয়ে গুণীজনের কথা, বিভিন্ন জনের সাথে কথপোকথন,গানের স্বরলিপি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। তাছাড়া কুমিল্লায় নজরুল, কুমিল্লার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের কথা, দুটি লাইব্রেরী, ব্রাহ্ম সমাজ, ব্যাংক-ট্যাঙ্ক এর বিবরণ,ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ইতিহাস,ট্যাজেডি ইত্যাদিও বইতে সংযোজিত হয়েছে,যা বইটিকে করেছে সমৃদ্ধ এবং তথ্য নির্ভর। ধরে রেখেছে সমসাময়িক ইতিহাস। শচীন কর্তার জীবনের আদ্যপ্রান্ত জানার পাশাপাশি এগুলো পাঠকের জন্যে উপরি পাওনা।এ যেনো অতীত ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে বর্তামানের এক গভীর আলিঙ্গন।
 গোলাম ফারুক, পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী। তবে ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি বরাবরই সক্রিয়ভাবে জড়িত। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি কুমিল্লার পাবলিক প্রসিকিউটার ছিলেন একাধিকবার। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের তালিকাভূক্ত আইনজীবী। পাশাপাশি তিনি আইন কলেজের অধ্যাপনাও করেন।
তাঁর বাসভবনে বইটি গোলাম ফারুক আমার হাতে তুলে দেন। আর সে সুবাদে ফারুক ভাইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সংগ্রহকৃত দলিলপত্রে সম্ভার আমার দেখার সুযোগ হয়।  দেখলাম, শোকেইসে পৃথক পৃথক শিরোনামযুক্ত বিশাল সংগ্রহ। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে কুমিল্লা জিলা স্কুল, ভিক্টোরিয়া কলেজ, নিয়ে তাঁর পরর্বতী প্রকাশনার জন্যে অনেক প্রামান্য তথ্য-দলিলপত্র। এতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, লেখক-গবেষক গোলাম ফারুক লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘আর্কাইভ্যাল’ কাজ বেশি করেন। এই কষ্টসাধ্য কাজটি অনেক লেখক-গবেষকই করেতে চান না।গোলাম ফারুক,শচীন দেববর্মনের জীবন কাহিনী গ্রন্থটির মতো আর একটি দূর্লভ গ্রন্থ ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছেন। কুমিল্লার আর একজন প্রতিথযশা ব্যক্তিত্ব, নওবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীকে নিয়ে।‘নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ও রূপজালাল’ নামের সেই গ্রন্থটিও ৬৩৯ পৃষ্ঠার ব্যপক ব্যাপ্তির তথ্য সমৃদ্ধ বই।
কুমিল্লার সমৃদ্ধ অতীত, ইতিহাস, ঐতিহ্যের তথ্য নিয়ে গোলাম ফারুকের কষ্টসাধ্য গবেষণালদ্ধ লেখা গ্রন্থটি,পাঠককে মুগ্ধ না করে পারে না। তিনি তাঁর এইসব মূল্যবান কাজের মাধ্যমেই দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
যিনি হতে পরতেন ত্রিপুরার রাজা







রেজাউল করিম শামিম












সর্বশেষ সংবাদ
নতুন বইয়ের বর্ণিল নতুন বছর
নৌকায় ভোট নিতে ভাতার কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা অধ্যক্ষ পদে অধ্যাপক ডাঃ রুহিনী কুমার দাস এর দায়িত্ব গ্রহণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত
বরুড়ায় শ্রমিকদল নেতাকে ছুরিকাঘাত
অর্ধেক দামে ফ্রিজ বিক্রি করছেন ফ্রিজ প্রতীকের প্রার্থী
বাড়ির জন্য কেনা জমিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যাওয়া একই পরিবারের ৪ জনের কবর
৫৫ কেজি সোনা চুরি, ফের রিমান্ডে দুই রাজস্ব কর্মকর্তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২