
অন্নদাশঙ্কর
 রায়ের মৃত্যুর পরেও যে অল্প কয়েকজন মনীষীর সান্নিধ্য বাংলার রেনেসাঁসকে 
আমার চেতনায় প্রত্যক্ষ করে তুলেছিল অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁদের একজন। তাঁর 
প্রজ্ঞার প্রমিতি এবং আচরণের বিদগ্ধতা, তাঁর অনাক্রম্য যুক্তিনিষ্ঠা এবং 
অনুভবের সৌকুমার্য, তাঁর জিজ্ঞাসার ব্যাপ্তি এক সরস বৈদগ্ধ্য, তাঁর নৈতিক 
দার্ঢ্য এবং সুবেদী রূপবোধ, তাঁর বিশ্বনাগরিকতা এবং ঐতিহ্য চেতনা-সব মিলিয়ে
 তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব আমাকে নিয়ত ভরসা জোগাত যে বাংলার রেনেসাঁস কোনো 
কেতাবী বিতন্ডার বিষয় অথবা বিগত স্মৃতি মাত্র নয়, আমার সমকালেও তা জীবন্ত, 
জাগ্রত ও ফলপ্রসূ।
আমার ধারনা যে অল্প কয়েকজন লেখক বাংলা এবং ইংরেজি দুই
 ভাষাতেই প্রায় সব্যসাচী কবীর চৌধুরী তাদের মধ্যে প্রধান। ইংরেজিতে তাঁর 
দখল অসামান্য। ইংরেজি সূত্রে তিনি গোড়া থেকেই শুধু পশ্চিমের সাহিত্য থেকে 
প্রয়োজন মত উপাদান সংগ্রহ করেননি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজি ভাষা গঠনগত যে 
বিশেষ শক্তি বিদ্যমান তাকেও বাংলা গদ্যে আনবার জন্য ব্রতী হন। এই  সাধনায় 
তিনি সহজে সিদ্দি অর্জন করেননি। বাংলা বাক্যগঠনের বৈশিষ্ট্য তা সরল এবং 
সংক্ষিপ্ত। পরস্পরের অম্বয় বোধক যে পদসমষ্টি দিয়ে বাক্য রচিত হয় বাংলায় 
তাতে একটি বাক্যের বুনটে বেশ কিছু অনুবাক্যকে বোনা কঠিন। অথচ কোনও জটিল বা 
শর্তসাপেক্ষ ভাবনাকে রূপ দিতে হলে পদসমষ্টির যৌগিক গঠন স্বভাবতই অপরিহার্য।
 অনুবাক্যের বয়নে যা একই সঙ্গে গাঢ় এবং গতিশীল, যৌগিক এবং স্বচ্ছন্দ।
এই
 নতুন বাংলাকে আয়ত্তে আনতে কবীর চৌধুরীর সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত 
তাকে তিনি শুধু আয়ত্তে আনেননি, তাঁর সম্প্রসারণ এবং ঋদ্ধি ঘটিয়েছেন। 
তন্নিষ্ঠ সাধনায় তিনি তাঁর গদ্যে একই সঙ্গে সুক্ষ বা জটিল চিন্তা এবং আবেগ 
সঞ্চারি স্পন্দনময়তার মিলন ঘটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রবন্ধ যেখানে যুক্তির 
বিণ্যাস, বিশ্লেষনের তীক্ষèতা ও যাথার্থ, এবং বক্তব্যের স্পষ্টতা প্রাধাণ্য
 পেয়ে থাকে-সেখানেও গদ্যে এই স্পন্দনময়তার সঞ্চার ঘটানো খুবই সাধনা 
সাপেক্ষ। এক্ষেত্রেও কবীর চৌধুরীর কৃতি প্রায় অপ্রতিম।
কবীর চৌধুরীর 
সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় হয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। তাঁর আগে থেকেই আমি 
তাঁর একজন অনুরক্ত পাঠক। আমার আনন্দ মেলা পুর®কৃত কিশোর উপন্যাস “ইলাডিং 
বিলাডিং” তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। কবীর চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ
 ঘটে কয়েক বছর পরে। বিশ্বসাহিত্যের গবেষণা ও অনুবাদ চর্চার সূত্রে। আমার 
গবেষণা গ্রস্থ “নোবেল বিজয়ী সাহিত্য, বিশ্বের বরেন্য সাহিত্য প্রস্তুতিতে 
এবং নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ দশটি উপন্যাস, নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, 
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি উপন্যাস, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ 
গল্প, অনুবাদে কবীর চৌধুরীর ভূমিকা অবিস্বরণীয়। 
কবীর চৌধুরীর মতো 
স্নিগ্ধ সৌজন্য স্বদেশে বিদেশে আমি খুব কম ভাবুক ও চিন্তাবিদের ভিতরে 
দেখেছি। তাঁর রূপ অসামান্য, কিন্তু তাঁর চাইতেও আকর্ষনীয় তাঁর মনের 
প্রসন্নতা ও আভিজাত্য। কবীর চৌধুরীর অনুবাদে ক্লাসিক আভিজাত্যের পরিচয় আছে।
 কিন্তু তাঁর প্রকশিত রচনা থেকে তাঁর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সম্ভবত ধরা 
যায় না সেটি হলো তাঁর চিত্তের অনিঃশেষ কান্তি। তার গভীর আর্তি প্রকাশ 
পেয়েছে তাঁর রচনায়। কিন্তু তাঁর আচরন সর্বদাই প্রফুল্ল ও সুরসিক সদাশয়তা। 
আমি কবীর চৌধুরীকে বহুবার বহু অবস্থায় দেখেছি কিন্তু কখনও তাঁকে ক্রদ্ধ বা 
বিরক্ত হতে বা অশালীন আচরন করতে দেখিনি। অমায়িকতা তাঁর প্রকৃতিগত। অল্প 
পরিচিত, অপরিচিত জনও তাঁর সান্নিধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। স্মিত হাসি 
এবং উচ্চরোল হাসি দুয়েতেই তাঁর মনের স্বভাবসিদ্ধ সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
আমি
 দেখেছি প্রতিভাধর মানুষের একটা অদৃশ্য আবরন থাকে। তাঁদের ঘনিষ্ঠ 
সান্নিধ্যে এলেও ওই আবরনের ব্যবধান ঘোচে না। কবীর চৌধুরী পূর্বতন উচ্চ 
পদমর্যাদা এবং বহুখ্যাত প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু তাঁর সান্নিধ্যে এসে কোনো
 ব্যবধান অনুভব করা গেল না। এটাই ছিল আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয়। অচিরেই 
বোঝা গেল তাঁর চিন্তায় বচনে ও আচরনে কোনো ব্যবধান থাকে না, আর এমন লোকের 
পক্ষেই মানবতন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুনীতির অনুরাগী হওয়া স্বাভাবিক। তাঁর অতি 
সান্নিধ্যে গিয়েও যে কোনো ব্যবধান অনুভব করা গেল না, সে রহস্যের ব্যাখ্যা 
পেলাম এখানেই।
আর একটা বিস্ময় তখনও ছিল আড়ালে। আমি দেখেছি আমাদের দেশে 
যখন দু-জনের মধ্যে কোনো বিষয়ে আলোচনা হয় তখন প্রায়শঃই একজনের চিন্তা ও 
বক্তব্য অন্যজনের চিন্তা ও বক্তব্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, কোনো সমাপ্তি ঘটে 
না। কবীর চৌধুরী পরের বক্তব্য মন দিয়ে শোনেন, পরে নিজের সুচিন্তিত ও 
তথ্যযুক্তিসিদ্ধ মতামত জানান অল্প কথায়। এ রকম আলোচনা ব্যর্থ বাক্যব্যয়ে 
পরিনত হয় না। তাতে শুধু যে মনস্বী সুলভ মনোবৃত্তি প্রকাশ পায় তা নয়, তাতে 
তাঁর মার্জিত রুচি এবং শান্ত অথচ শানিত বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশ পায়। তাঁর এই
 মনন প্রকৃতিই প্রতিফলিত হয় তাঁর প্রবন্ধ রচনায়। তাঁর মুখের ভাষা ও লেখার 
ভাষায় ব্যবধান খুবই কম। আমি একমাত্র অন্নদাশংকর রায় ছাড়া আর কারও মুখের কথা
 ও লেখার ভাষায় এমন সামীপ্য অনুভব করি না।
কবীর চৌধুরীর লেখা পড়ে 
ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের ফলে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আহরিত তথ্যাদি থেকে মনে হয়
 কিশোরকাল থেকেই তাঁর চরিত্রের কতগুলো প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। শক্তিমান এবং 
বিত্তবানের কাছে নত হওয়া যেমন তাঁর স্বভাবে ছিল না তেমনি তিনি ছিলেন অসহায় 
এবং বঞ্চিতের সেবায় আকৈশোর নিবেদিত। অন্যায়ের বিরোধিতা, দুঃস্থের সেবা, 
নির্ভিকতা, স্বাধীন চিত্ততা ছাড়াও তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিক অল্প বয়সে 
ব্যক্ত হয়। অজানাকে জানা, পরিচয়ের অভ্যস্ত আশ্রয় ছেড়ে অপরিচয়ের জগতে 
অনুসন্ধান, অতিকথা এবং রহস্যের আড়াল ভেদ করে সত্য আবিষ্কারে অদম্য আগ্রহ 
এবং বিপদের আশঙ্কাকে অগ্রাহ্য করে নতুন দিগন্তের উদঘাটন, অতীত এবং 
বর্তমানের গন্ডিতে চেতনাকে আবদ্ধ না রেখে অনাগত শ্রেয় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা 
এবং তারই রূপায়নে আত্মনিয়োগ-তাঁর এই আবাল্য আভিমুখ্যের কথা তাঁর কৈশোর 
যৌবনের সহকর্মীদের মুখে শুনেছি। দেশের এবং কালের খুব কম দিকই আছে যা নিয়ে 
কবীর চৌধুরী ভাবেননি অথবা লেখেননি-যে ঘটনা বা সমস্যা সমকালীক বা আপাত 
দৃষ্টিতে গরকায়েম তাদেরও তিনি তাত্বিকতার আলোয় অনেকটা উদ্ভাসিত করেছেন। 
তাঁর বিচারবুদ্ধি উন্মুক্ত, সদাজাগ্রত এবং ক্ষিপ্র। সংখ্যাগুরুতার এবং 
প্রাচীনতার প্রাধিকারকে ব্যঙ্গ করতে তাঁর বাধে না, কিন্তু যথার্থ 
পূর্বসূরীদের উপলব্ধিকে যেমন তিনি আত্নস্থ করেছেন তেমনি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে
 পূর্ণমূল্য দিলেও প্রাজাতিক দায়িত্ব বিষয়ে তিনি নিযত সচেতন। এবং ভাষার 
তিনি কারিগর। এক তাল মাটি ছেনে যেমন মৃৎশিল্পী মানসপ্রতিমাকে রূপ দেন, 
শব্দের উপদানে তেমনি তিনি আকার দেন তাঁর ভাবনাকে, হাত কাঁপে না, অপচয় ঘটে 
না, অতিরেকমুক্ত, নির্ব্যূঢ়, প্রতিসম তাঁর রূপায়ন। এই ধরনের মন নিয়ে 
সাহিত্যে সমালোচনায় এসেছেন কবীর চৌধুরী। অনুশীলনের দ্বারা সে মনকে যেমন 
সমৃদ্ধতর করেছেন তার উপযোগী বাক্যবিন্যাসের রীতিও গড়ে তুলেছেন। তাঁর আযৌবন 
সাহিত্য সাধানা রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের কীর্তিনীয় সম্পন্নতা সাধন 
করেছে।
স্বভাবতই এই মন এবং এই রীতি অন্ধকারে, অনচ্ছতায় অথবা নির্বেদে 
আকৃষ্ট হয় না। চিকিৎসকের মত ব্যাধির নিদাননির্ণয় এবং দূরীকরণকে কর্তব্য বলে
 মনে করে বটে, কিন্তু তমিস্রাজাত নির্বিণ্নতার সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা বোধ করে
 না। অথচ এই পাতালিক অন্ধকার,  অবচেতনে অবরুদ্ধ প্রক্ষোভের এই যে দুঃস্থিত,
 অন্তলোর্কের এই যে নিরুপাখ্য গূঢ়ৈষা এবং উত্তরণহীন আর্তি, গত প্রায়  দেড়শো
 বছর ধরে পশ্চিমে বহু প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিক এরি দ্বারা আক্রান্ত, 
এরি আতঙ্কিত অপরোক্ষ অনুভব থেকে উৎসারিত তাঁদের অগ্নিগর্ভ অতিকথাবলী, এরি 
মর্তুকাম প্রচন্ড পেষণে ব্যঞ্জিতরূপে ধারণ করবার জন্য নিরাশ্বাস তাঁদের 
নির্বন্ধ। বোদলেয়ার থেকে এলিয়ট, ডস্টয়েভস্কি থেকে কাফকা ও কামু, ও’নীল থেকে
 স্যামুয়েল বেকেট-এই পাতালিক জগতের এঁরা অধিবাসী, নাবিক ও মানচিত্রকর, 
অন্ততঃ অংশতঃ।
এজ্রা পাউন্ড সম্বন্ধে এলিয়ট একদা লিখেছিলেন যে পাউন্ডের 
নরক অন্য মানুষদের নরক, সেটি তাঁর নিজের নরক নয়, তাই সেই নরকের বৃত্তান্ত 
আমাদের উদ্বেল করে না। পাতালিক অন্ধকারের কথা রবীন্দ্রনাথ জানতেন, কবীর 
চৌধুরীও জানেন। কিন্তু তাঁদের বাস আলোকের জগতে। প্রকৃতিপ্রেমী, জীবনপ্রেমী,
 মানবপ্রেমী, চৈতন্যের, মঙ্গলের, সুন্দরের সাধক এই শিল্পী ভাবুকরা পাতালিক 
অন্ধকারকে দেখেছেন প্রায় সব সময়ই বাইরে থেকে। তাঁরা প্রেমে, প্রজ্ঞায়, 
প্রত্যয়ে দূর করতে চেয়েছেন এই তমিস্রাকে, তার সংক্রমনকে রুখতে বারবার 
উদ্যোগী হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যদিবা তাঁর জীবনের শেষভাগে এই নিরাশ্বাস 
যন্ত্রণার দ্বারা কখনো কখনো স্পৃষ্ট হয়ে থাকেন, কবীর চৌধুরী মনে হয় কখনোই 
এই আর্তিকে তাঁর অস্তিত্বের অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে দেন নি। মনীষী ও 
চিন্তানায়ক হিসাবে তাঁর অমরত্ব সুনিশ্চিত।
                                                                                
