
যারা কোরআন পড়ে না কিংবা মুসলিমদের সঙ্গে যাদের কোনো ধর্মীয় বিরোধ নেই, তারা কোরআন পোড়ায় কেন? ধর্মীয় কারণে বিশ্বব্যাপী যেখানে খ্রিস্টানদের সঙ্গে ইসলামের অনুসারীদের জেরুজালেম নিয়ে কোনো সংঘর্ষ বা ধর্মযুদ্ধের প্রশ্ন ওঠে না, সেখানে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? বর্তমান অশান্ত বিশ্বকে আরো অস্থির করে তোলায় তাদের কী ফায়দা হাসিল হবে? ফায়দা বা স্বার্থ হাসিলের মূল লক্ষ্য ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। পশ্চিমাজগতে উগ্র ডান কিংবা দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলরা ইদানীং ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে কারণে গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের মর্মমূলে আঘাত করতে অক্ষম সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা ধর্মকেই বেছে নিয়েছেন তাঁদের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। বর্তমান বিশ্বে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে শোষণ-বঞ্চনার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিমা ডানপন্থী কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা-নেত্রীদের দৃশ্যত কোনো বিরোধ নেই। সুচিন্তিতভাবে বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ ও তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। এতে পশ্চিমা উগ্র ডান কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মনে করে তাদের জনপ্রিয়তা অর্জন সহজতর হবে। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পশ্চিমাজগতে, বর্তমান প্রথাগত (নিয়মতান্ত্রিক) রাজনীতিকরা যখন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন উগ্র ডানপন্থী কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনো ধর্মীয় বিষয়কে ইস্যু করে মাঠে নামছে বিভিন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে, আবার কখনো জাতিগোষ্ঠীগত বৈষম্যকে উসকে দেয় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে। ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রে এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যেও যে এ ধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটেছে, তা-ও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রভাবাধীন রিপাবলিকান দলের এক বিশাল অংশের ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ’ কিংবা যুক্তরাজ্যের উগ্র জাতীয়তাবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্টের ‘শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ’ গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের নাকের ডগায় বৃদ্ধাঙ্গুলি ঠেকিয়ে প্রকাশ্যেই চরম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা ধর্মীয় বিরোধ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে তারা এমন সব ঘটনাকেও বরদাশত করে যাচ্ছে, যা অগণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারের বরখেলাপ। তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে চীন ও রাশিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক নীতিমালার অনুসারী দেশে কোরআন পোড়ানোর মতো ঘটনা সচরাচর ঘটে না কেন? কারণ সেসব দেশে গণতন্ত্রের নামে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা প্রচার ও প্রসারের কোনো অবকাশ নেই। ধর্ম, বর্ণ ও জাতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার রয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ইতালি, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ পশ্চিমাজগতে সেগুলো খাতায় লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে তারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে নানা বৈষম্য, বিরোধ ও সংঘর্ষ। তা ছাড়া উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতার কারণে ভেঙে পড়ছে সাধারণ মানুষের প্রচলিত কিংবা প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ। গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমে ক্রমে নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের কাছে তুরস্কবিরোধী বিক্ষোভ এবং সেখানে কোরআন পোড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মন্তব্য করেছেন—ন্যাটোর সদস্যপদ লাভের জন্য সুইডেন যেন তুরস্কের সমর্থন আশা না করে।
আগামী মে মাসের ১৪ তারিখ তুরস্কে জাতীয় সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন ঘোষণা করেছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম সেই নির্বাচনকে এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ সেই নির্বাচন একদিকে যেমন প্রাজ্ঞ-প্রবীণ রাজনীতিক এরদোয়ানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, অন্যদিকে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ এবং এমনকি ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অবস্থান ও কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করবে বলে বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষকদের অভিমত। এরদোয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে নয়, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, বিশ্ববাণিজ্য, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যশস্যসংকট মোকাবেলা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই রাজনীতি করেন। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষকদের মতে, এরদোয়ান এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন যে তিনি কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের প্রধান নন, বরং বিশ্বরাজনীতিতে তাঁর নীতি ও রণকৌশল দিয়ে নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন। তবে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর মতো পুঁজিবাদ ও আধিপত্যবাদীদের সমর্থিত সাময়িকীতে সম্প্রতি আসন্ন নির্বাচনে এরদোয়ানকে ঠেকানোর উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। এরদোয়ানকে একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও গত দেড় দশকে তিনি প্রতিটি নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। কোনো কোনো নির্বাচনে তাঁর দলের নেতৃস্থানীয় প্রার্থী হেরে গেলেও, ইস্তাম্বুলের মতো নগরীতে মেয়র পদসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর দল (একে পার্টি) শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। অভিযোগ উঠেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরদোয়ান কিংবা মুসলিম বিশ্বের অকৃত্রিম বন্ধু নয়। তিনি প্রকাশ্যেই ইহুদিবাদের সমর্থক। তিনি কোনো মতেই চান না এরদোয়ান আবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য হারায়। আগামী বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন দ্বিতীয় টার্মের জন্য আবার নির্বাচিত হবেন কি না সেটা নিয়ে এখন মার্কিন গণমাধ্যম সোচ্চার। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের চরম আধিপত্যবাদী রাজনীতির লক্ষ্য তুরস্কে স্বাধীনচেতা এরদোয়ানের পরিবর্তে একজন তাঁবেদার খুঁজে পাওয়া। এ অবস্থায় কী করবেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান? যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদারির পরিবর্তে ক্ষমতা ধরে রাখা, নাকি বিশ্বরাজনীতিতে একজন স্বাধীনচেতা বিকল্প নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা?
স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের কাছে কোরআন পোড়ানোর ঘটনাটি তাঁর নিজ দেশের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সামনে ঠেলে দিয়েছে এরদোয়ানকে। নতুন আঙ্গিকে তুরস্কের স্বাধীনতা অর্জনের ১০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। সে কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে পরাজয়ের পর তুরস্ককে নতুনভাবে বেরিয়ে আসার জন্য মিত্রশক্তির সঙ্গে লুজান চুক্তি নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছে, তারও ১০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এখন। তাতে নয়া তুরস্ক রাষ্ট্রের ওপর বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করা। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন তার অবসান ঘটিয়ে তুরস্কে ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়িত করতে চান। এর অন্যতম প্রধান কারণ তুরস্কের প্রায় ৯৯.৮ শতাংশ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তাই তারা চায় সাম্প্রতিক সময়ে স্টকহোমে সংঘটিত ঘটনার বিরুদ্ধে এরদোয়ানের একটি জোরালো ভূমিকা। তুরস্ক সামরিক দিক থেকে এবং বিশেষ করে সামরিক অস্ত্র সরঞ্জাম উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে। তা ছাড়া এরই মধ্যে তুরস্ক বুঝে গেছে যে যুক্তরাষ্ট্র চায় না শিগগির রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের অবসান ঘটুক। তাই যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও পোল্যান্ড অনেক যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে ইউক্রেনে। তাতে আধুনিক জঙ্গি বিমান, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং অনেক উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তা ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘর্ষে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি তুরস্ক ভিন্নমত পোষণ করেছে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সংঘর্ষে জড়াতে চায় না। তেমন অবস্থা সৃষ্টি হলে তুরস্ক ন্যাটো জোট ত্যাগ করে অবিলম্বে সেই অঞ্চলে যুদ্ধাবসানের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে পরোক্ষভাবে ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং তুরস্কের নির্বাচন সামনে রেখে অনেক অকল্পনীয় ঘটনাও ঘটতে পারে, যা এত দিন ভাবা যায়নি।
সম্ভাব্য বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থাকে বিবেচনা করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিভিন্ন কৌশলগত স্থান ও স্থাপনার ওপর নতুন কৌশলে বৃহত্তর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছেন। সেসব ইউক্রেনীয় অঞ্চলে তিনি উন্নত সামরিক কৌশল, যুদ্ধবিমান এবং এমনকি আরো উন্নত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনার কথা বিবেচনা করছেন। নির্দিষ্ট বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে সেনা সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো ও নজরদারি আরো বিস্তৃত করার রণকৌশল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। সে কারণে ২০২৩-২০২৬ সময়ের মধ্যে রুশ সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে রাশিয়া। সুতরাং ইউক্রেন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে রাশিয়া যে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে, তাতে সামরিক কিংবা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে তুরস্ক, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এ অবস্থায় চলতি বছরের নভেম্বরে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত সভায় যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব নেওয়ার মতো বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিণতি এরই মধ্যে উপলব্ধি করেছে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো। বিশ্ব এখন এক অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপক গ্রাসে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে বলে তাদের আশঙ্কা। এ অবস্থায় ইউক্রেনকে বিজয়ী করতে কিংবা রাশিয়াকে ভেঙে দেওয়ার জন্য দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে যেতে তারা প্রস্তুত নয়।
লেখক:বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
[email protected]