৪৫
বাবার
মুখে শুনেছি ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শিখতে হতো, শিক্ষার
শেষে পরীক্ষা দিতে হতো। এক পরীক্ষক জিজ্ঞাসা করেন, “কলের জলের আর জলের কল এ
দুটোর তফাত?” পরীক্ষার্থীদের একজন উত্তর দেন, “একই জিনিস।” বলা বাহুল্য,
তাঁকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা বলছেন ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মে নিরপেক্ষ
রাষ্ট্র একই জিনিস ইতিহাস তার পরীক্ষায় তাঁদেরকে ফেল করিয়ে দেবে। অমন করে
গোঁজামিল দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকতে পারে না। মৌলবাদীরাই তাকে
নাড়া দিয়ে নাজেহাল করবে।
ধর্মে নিরপেক্ষ রাজত্ব সম্রাট আকবরের আমলেও
ছিল। মহারাণি ভিক্টোরিয়া ধর্মে নিরপেক্ষ থেকে হিন্দু-মুসলমানদের সমান
আস্থাভাজন ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মে নিরপেক্ষতার উত্তরাধিকার পেয়েছে।
সেটা তার নিজস্ব প্রবর্তন নয়। নতুন যেটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
ধর্মনিরপেক্ষতা স্টেট। এই জিনিসটি বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে অভূতপূর্ব।
তিন
শতাব্দী পূর্বে ত্রিশ বছরের যুদ্ধের পর জার্মানদের মধ্যে এই মর্মে একটা
বোঝাপড়া হয়ে যায় যে রাজা প্রটেস্টান্ট হলে প্রজারাও হবে প্রেটেস্টান্ট আর
রাজা, ক্যাথলিক হলে প্রজারাও হবে ক্যাথলিক। অর্থাৎ রাজধর্মই প্রজাধর্ম।
যাদের বিবেকের আপত্তি তারা রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে পারে। এর ফলে একপ্রকার
লোকবিনিময় ঘটে যায়। অনেকে ইউরোপে ঠাঁই না পেয়ে আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেন।
সেখানে রাজধর্ম গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংল্যান্ডের রাজা যদিও চার্চ
অভ্ ইংল্যান্ডের কর্তা তবু উপনিবেশগুলোর বিকাশের জন্য বিস্তর প্রজার
প্রয়োজন ছিল। তাই নানা সম্প্রদায়ও ছিল। খাস ইংল্যান্ড তারা উৎপীড়িত।
আমেরিকায় গিয়ে তাঁরা যে যার স্বকীয় ধর্মমত পালন করে। ব্যয়ভারের জন্য
রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয় না। আমেরিকার উপনিবেশগুলো যখন যুদ্ধে জিতে তাদের
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তখন রাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজধর্মও বর্জিত হয়।
রাজার যে ধর্ম প্রজারও সেই ধর্ম রাজতন্ত্রের বেলা-খাটে, সাধারণতন্ত্রের
বেলা-খাটে না। সেখানে প্রজার যে ধর্ম রাষ্ট্রেরও সেই ধর্ম। কিন্তু প্রজাদের
ধর্ম যদি হয় ব্যাপটিস্ট, মেথডিস্ট, কোয়েকার, এপিসকোপালিয়ান,
প্রেসবিটারিয়ান, ক্যাথলিক, ইহুদি প্রভৃতি বহু ধর্ম তবে তাদের দেশের
প্রেসিডেন্ট বা গভর্নর যাঁরা হবেন তাঁদের এক একজনের হয়তো এক এক ধর্ম। তেমন
রাষ্ট্রে প্রজাধর্ম কি তবে সংখ্যারিষ্ঠের ধর্ম? না, তাও নয়। মিলেমিশে থাকতে
হলে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে। নাগরিকদের যার যার নিজের ধর্ম,
কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। এটা একটা নতুন তত্ত্ব। রাষ্ট্রের প্রধান
যাঁরা স্বধর্মে বিশ্বাস হতে পারেন, রাষ্ট্র কিন্তু কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে
না।
বিপ্লবী আমেরিকার রাষ্ট্র বিধাতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু বিপ্লবী
ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নিরীশ্বরবাদী তথ্য অজ্ঞেয়বাদীদেরও উচ্চপদ
দেয়, কারও কাছে বিধাতা বিশ্বাস দাবি করে না। নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে
গেছে ফ্রান্স। প্রেসিডেন্ট পদ পেয়েছেন সংখ্যালঘু প্রটেস্টান্ট তথা
ইহুদিরাও। উচ্চতর পদে বসেছেন নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাসী বা মার্ক্সবাদীরাও।
দেশটা ক্যাথলিকপ্রধান। ইচ্ছা করলে ক্যাথলিকরা কি ভোটের জোরে রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতা দখল করতে পারত না? কিন্তু রাজতন্ত্রের শূন্যতা পূরণ করা চার্চের
সাধ্য নয়। চার্চ চিরকালই রাজ্যের শাসনভার রাজার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। চার্চ
তার বিচারে দণ্ডনীয়দের কারাদণ্ডে বা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতে অক্ষম। সে কর্ম
সে রাজাকে দিয়ে করিয়েছে। রক্তপাত করা খ্রিষ্টধর্মে নিষেধ। তাই মানুষকে
মৃত্যুদণ্ডের ভার দেওয়া হতো রাজাকে। চার্চের হাতে রক্তের দাগ লাগত না।
রাজার হাতেই লাগত। যুদ্ধবিগ্রহে তো রক্তপাতের সীমা- পরিসীমা থাকত না। সে
পাপের দায় চার্চ নিত না। নিতেন রাজা। রাজাকে তাই তার একান্ত প্রয়োজন। চার্চ
ইচ্ছা করলেই রাজার আসনে তার বিশ্বাসভাজনকে বসাতে পারত, কিংবা সে আসন থেকে
অবাধ্য জনকে সরাতে পারত, কিন্তু যাজকরা কেউ রাজা হতেন না। সুতরাং অধিকাংশের
ভোটে রাজক্ষমতা হাতে পেয়ে ক্যাথলিকারা ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনত বা
এমন একজনকে প্রেসিডেন্ট করত যিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, আইন-আদালত
ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে চার্চের অনুগত। সেটা হওয়ার নয়। ফরাসি বিপ্লবী যদিও
ব্যর্থ হয়েছে তবু নেপোলিয়নের রচিত কোড এখনও সে দেশের সামাজিক আইন। তা ছাড়া
সংবিধান তো আছেই। একটা নির্বাচনে জিতে ক্যাথলিকরা বড়ো রকম রদবদল করতে পারে
না। বিরোধী পক্ষও যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল,
কলেজ, খবরের কাগজ, থিয়েটার সিনেমা, সিভিল সার্ভিস, বিচারক ইত্যাদি।
মনে
রাখতে হবে যে ফ্রান্স হচ্ছে এনলাইটেমেন্টের আদ্য পীঠ। অষ্টাদশ শতাব্দীর
এনলাইটেনমেন্ট সেই দেশ থেকেই ইউরোপের সর্বত্র সঞ্চারিত হয়। রুশো, ভলতেয়ার
দিদেরো প্রমুখ ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। সে বিপ্লব আখেরে
ব্যর্থ হলেও তার প্রভাব মনের কন্দরে থেকে যায়। তাই ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা
একধার থেকে যুক্তির উপাসক। বিপ্লবের দিন “যুক্তির দেবী” ভাস্কর্য পরিগ্রহ
করেছিলেন। এখন তিনি নিরাকার হলেও বিধাতার মতো অন্তরালে তাঁর অস্তিত্ব।
যুক্তির জোরে বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বাসের জোরকে পরাস্ত করতে পারেন। অনেকগুলো
প্রতিষ্ঠানে তাঁরা দীর্ঘকাল ধরে জাঁকিয়ে বসে আছে। দেশের সরকারি
শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের স্থান নেই। পড়াশুনা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতা।
ছেলেবেলা থেকেই শিশুদের তালিম দেওয়া হয় আধুনিকতম জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে
জগৎকে দেখতে। প্রাচীনকালে রচিত শাস্ত্রের দৃষ্টিতে বা মধ্যযুগে গ্রথিত
টীকাভাষ্যের দৃষ্টি নয়। সমান্তরাল একটা শিক্ষাব্যবস্থাও আছে। সেটা
ক্যাথলিকদের কুক্ষিগত। তাঁদের হাতে গড়া ছাত্ররা যুক্তপ্রবণ নয়, ভক্তিপ্রবণ।
তবে তাঁদের মধ্যেও প্রতিভাশালীর অভাব নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারাও
পারদর্শী। বিশেষেত সেনাবিভাগে। যেখানে ডিসিপ্লিন অপরিহার্য। ফ্রান্সে
মিলিটারির মর্যাদা দারুণ।
আমেরিকার মতো ফ্রান্সও ধর্মনিরপেক্ষতা স্টেট।
ফ্রান্সও সাধারণতন্ত্র। তফাত এই যে ফ্রান্সে বিধাতাভক্ত না হলেও উপরে উঠতে
দেওয়া হয়। ওই ক্যাথলিকরাও ভোট দিয়ে উপরে উঠতে দেন। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক
কারণে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। দেশ ভক্তিও বিধাতাভক্তির চেয়ে কম প্রবল নয়।
একালের ফরাসিরা দেশের জন্য যুদ্ধে প্রাণ দেয়, ধর্মের জন্য নয়। যারা প্রাণ
দেয় তাদের মধ্যে অনেকেই প্রটেস্টান্ট, অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক, ইহুদি।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র না হলে ফ্রান্স কি নিরাপদ হতো?
ফ্রান্সের চেয়ে আরও
ধর্মনিরপেক্ষতা সোভিয়েট ইউনিয়ন। আরও ধর্মনিরপেক্ষতা বলেই আরও নিরাপদ। সে
নিরাপত্তা কেবল বহিঃশত্রুর হাত থেকে নয়, আভ্যন্তরীণ প্রতিবিপ্লবীদের হাত
থেকেও। প্রতিবিপ্লবীরা অনুপ্রবেশ করবে এই আশঙ্কায় কমিউনিস্ট পার্টিতে
নিরীশ্বরবাদী ভিন্ন আর কাউকে সভ্য পদ দেওয়া হয় না। শাসনব্যবস্থার বাইরে
যারা, তাদের ধর্মবিশ্বাসী থাকলে ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রতিবিপ্লবের সঙ্গে
জড়িত হলে রক্ষা নেই। সোভিয়েট ইউনিয়নে ধর্মবিশ্বাস হওয়া নিরাপদ নয়। যেমন
আমেরিকায় ধর্মবিশ্বাসী না হওয়া নিরাপদ নয়। অথচ দুই রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ
বা ধর্মনিরপেক্ষতা। এর কারণে আমেরিকা সমাজবিপ্লবকে ভয় করে আর সোভিয়েট
ইউনিয়ন প্রতিবিপ্লবকে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্ট্যালিন সোভিয়েট
নাগরিকেদের আহ্বান করেন পিতৃভূমির জন্য লড়তে, শ্রমিক রাষ্ট্রের জন্য লড়তে
নয়। যুদ্ধের নাম ইংরেজি অনুবাদে প্যাট্রিয়াটিক ওয়ার। রেভোলিউশনারি ওয়ার নয়।
সুতরাং সোভিয়েটের সঙ্গে মিলে নাৎসি জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধে না
কমিউনিজমবিরোধী দেশ আমেরিকার। একদল আমেরিকানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্ট্যালিন
বিধাতার নাম করেন। মিখাইল গর্বাচেভও আমেরিকায় পদাপর্ণ করে বিধাতার সাহায্য
চান। এক আধবার বিধাতার নাম নিলে যদি কাজ উদ্ধার হয় তবে মন্দ কী। বিপ্লবের
যুগে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবের নাটের গুরু ছিলেন চার্চিল।
তাঁকে দেখা গেল দূত পাঠিয়ে স্ট্যালিনকে খবরটা দিতে যে উভয়ের মহাশত্রু
হিটলার রুশদেশ আক্রমণ করতে যাচ্ছে। হিটলারের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করে
স্ট্যালিন তো দুই বছরের মতো নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুম দিচ্ছিলেন। তাঁকে অকালে
জাগিয়ে দেন চার্চিল। প্যাট্রিয়াটিক ওয়ার না হয়ে যদি রেভোলিউশনারি ওয়ার হতো
চার্চিল দূত পাঠিয়ে হিটলারকেই আক্রমণের প্রেরণা জোগাতেন। যুদ্ধ যেই সারা
হলো অমনি বেধে গেল বার্লিনের উপর আধিপত্য নিয়ে মিতায় মিতায় দ্বন্দ্ব।
স্ট্যালিনের মুখে বিধাতার নাম আর শোনা গেল না। কাজ ফুরোলে পাজি।
চলবে.....