তৃতীয় পর্ব
আমি যখন বাংলা বিভাগে যোগদান করি, বিভাগের প্রধান আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক কাজী নরুল ইসলাম, অন্য দু’জন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হলেন অধ্যাপক আমীর আলী চৌধুরী ও অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক। এছাড়া অন্যান্য বিভাগেরও আমার শিক্ষক ছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক লায়লা নূর, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক আকতারুল হক ও অধ্যাপক মতিয়ুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শামসুল আবেদীন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ফজলুর রহমান, অধ্যাপক সুলতান আহমদ, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুবীর কুমার চক্রবর্তী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো: সিরাজুল হক, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জাহানারা মুন্সী, অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্রকুমার রায় (কে, কে রায়), বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক মো: শাহাবুদ্দিন প্রমুখ।
যাঁদেরকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, তাঁরা ছিলেন খ্যাতিমান অধ্যাপক এবং কলেজের ঐতিহ্যের ধারক, আমি এখন বাংলা বিভাগের আমার শিক্ষকদের কথাই সংক্ষিপ্তভাবে বলতে চাই।
অধ্যাপক আলী আহমদ স্যার চলে যাওয়ার পর অধ্যাপক কাজী নুরুল ইসলাম স্যার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বেসরকারি কলেজের কোনো বিভাগে যিনি শিক্ষক হিসেবে আগে যোগদান করেন, তিনিই বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কাজী নুরুল ইসলাম স্যার ১৯৫০ সালে বিএ পাশ করেছেন, ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। মোবাশ্বের আলী স্যার ১৯৫১ সালে অনার্স ও ১৯৫২ সালে এম এ পাশ করেন। কিন্তু কলেজে যোগাদন করেন কাজী স্যারের পরে। সুতারাং যথারীতি মেনেই কাজী স্যার বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে যান।
অধ্যাপক কাজী নূরুল স্যার আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা ও ধ্বনিবিজ্ঞান পড়াতেন। দীর্ঘদিন পাসকোর্সের শিক্ষক হিসেবে যে ধারা অনুসরণ করে এসেছিলেন তা প্রথমদিকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না। এ কথাটা বলা হয়ত ঠিক হয়নি। বললাম এজন্য যে- যেমন রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী চিত্রা বা অন্য কাব্যগ্রন্থের কবিতা পড়া ছিল ছাত্রদের নিজস্ব প্রচেষ্টায়, ক্লাশে স্যার সামগ্রিক আলোচনা সাজাবেন কবিতাসমূহের শ্রেণি বিন্যাস করে, তাতে কবিতার উদ্ধৃতি থাকবে, কিন্তু বিস্তৃত বক্তব্য থাকবে প্রাসঙ্গিক বিষয়কে কেন্দ্র করে।
এ ক্ষেত্রে মোবাশ্বের আলী স্যার, যাঁকে উচ্চ মাধ্যমিকে এড়িয়ে চলেছি, তাঁর বক্তব্য অনুসরণ করেছি, কিন্তু অনুসরণ করিনি, যিনি উচ্চ মাধ্যমিকে রবীন্দ্রনাথের ‘ছবি’ কবিতাটি দু’বছর পড়িয়ে শেষ করতে পারেননি, তাঁকে আমাদের বিবেচনায় পেছনে ঠেলে রেখেছিলাম। কিন্তু অনার্স পড়তে এসে তিনিই হলেন আমাদের রক্ষাকর্তা, পাঠদানের শিরোমনি। নিজেকে উপস্থাপন করলেন একজন প্রাজ্ঞ সমালোচক লেখক হিসেবে। হাতে পেলাম তাঁর জ্ঞানগর্ভ ‘মধুসূদনের মেঘনাদবধ ও নজজাগৃতি’ বইটি। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের নিয়ে সেমিনারে বসতেন আলাপচারিতায় পাঠদানের উদ্দেশ্যে। এ নিয়ে দু’একটি কথা।
১. প্রশ্ন করতেন- সাহিত্য কাকে বলে ?
আমরা শ্রীশ দাষের ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ থেকে সাহিত্যের সংজ্ঞা মুখস্থ বলতাম। তিনি সেদিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে সহজ করে বাস্তবভিত্তিক উদাহরণ দিয়ে বলতেন- যে সাহিত্য সম্ভার পড়ার পর পুনরায় পড়বার আকাক্সক্ষা থেকে যায়। যত্ন সহকারে তা সংরক্ষণ করে বার বার পড়তে ইচ্ছে জাগে, তা-ই সাহিত্য। এ প্রসঙ্গে ‘সংবাদপত্র’ সাহিত্য নয় কেন তাও বুঝিয়ে দিতেন। আরও বলতেন- ভাবের সাহিত্য শাশ্বত, জ্ঞানের সাহিত্য যুগান্তরে পরিবর্তিত ও মার্জিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ নিয়ে হয়ত ২/৩ দিন বিস্তারিত আলোচনা করতেন।
২. প্রশ্ন করতেন- কবিতা কাকে বলে ?
আমরা সুগপৎ শ্রীষ দাষের বই থেকে নানা কবির উল্লেখ্য সংজ্ঞা বলতে চেষ্টা করতাম। তিনি তা শুনতেন। পরে বলতেন পরীক্ষার খাতায় হয়ত তা-ই লিখতে হবে। তবে বুঝবার জন্য বাস্তবভিত্তিক উদাহরণের মাধ্যমে যদি অনুধাবন করা যায়, তাহলে বিষয়টি আরও স্বচ্ছ হবে। তিনি তখন সবিস্তারে বলতে থাকতেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। শুনে শুনে আমাদের প্রথাগত ধারণার কৃত্রিমত্তা থেকে বের হয়ে মগ্নচৈতন্যকে শাণিত করতাম। আগেই বলেছি তিনি মধুসূদনের উপর বই লিখেছেন। অর্থাৎ মধুকবির উপর তাঁর পঠনের ব্যাপকতা ছিল বিশাল।
মধুসূদন দত্ত বিলেত থেকে কিরে এসেছেন। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা করেছেন। অর্থাৎ মাতৃভাষাকে ভুলে ইংরেজি ভাষার প্রতি আত্মগত ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন। একসময় উপলব্ধি হলো- মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা মাতাপিতাকে অস্বীকার করার সামিল। তিনি মাতৃভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করলেন এবং মাতৃভাষায় বই লিখতে শুরু করলেন। তিনি লিখলেন তাঁর অমরকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। পাঠক সমাজ তাকে মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিল। সারস্বত সমাজে মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেন মহাকবি মধুসূদন দত্ত। মোহিতলাল মজুমদার আলোচনা বই-এর শিরোনাম দিলেন ‘কবিস্ত্রী মধুসূদন’।
একদিনের ঘটনা। মধুসূদন মনোহরী জিনিস কিনতে এক মুদি দোকানে গেলেন। তিনি দেখলেন- দোকানি কন্ঠছেড়ে ‘মেঘনাবদবধ কাব্য’ পড়ছেন। মধুসূদন আনন্দে শিহরিত হলেন। দোকানি কবিকে চেনেন না। কবি জানতে চাইলেন ‘কী বই পড়ছেন’। দোকানি-‘কবিতার বই’। ‘নাম কি ?’ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘কে লিখেছেন ?’ ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত, একজন ইংরেজ কবি’, ‘কেমন লিখেছেন ?’
‘আর বলতে, জীবনের এত ভালো কবিতার বই দ্বিতীয়টি পড়িনি।’ ‘একটু পড়ে শোনাবেন ?’
দোকানি কবির আপদমস্তক নিরক্ষণ করে বললেন- ‘আপনি বুঝবেন না।’
একথা বলে স্যার থামলেন। কিছুটা সময় নিলেন। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে বলতে থাকলেন- ‘যে কবি কবিতা লিখেন, তিনি বুঝবেন না; অথচ পাঠক বুঝবে এবং প্রাণভরে উপভোগ করবে-এটাই কবিতা। আমাদের স্যার মোবাশ্বের আলী কবিতার কী সংজ্ঞা দিলেন। সত্যিই তো একজন কবি যখন কবিতা লিখেন, তিনি কি জানেন- কী লিখেছেন, কাদের জন্য লিখেছেন, রচিত কবিতার সুদূর প্রসারী অর্থ-মাহাত্ম্য বা মাধুর্য বা কি ?
এভাবে ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্যের সংজ্ঞা বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে আমাদেরকে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যেতেন যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরগুপ্তকে কীভাবে ‘ট্রাফিক পুলিশ’- হিসেবে দাঁড়া করিয়ে ‘যুগসন্ধিক্ষণ’ কি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। আরও অনেক কথা, অনেক স্মৃতি, অনেক ইতিহাস। এই কথা বলার অর্থ হলো, ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা অনার্স পড়তে গিয়ে আমাদের কিংববদন্তিতুল্য শিক্ষকদের স্নেহ-সহচর্য ও পাঠদান লাভে কতটা উজ্জীবিত হয়েছি তা শ্রদ্ধার সাথে স্মৃতিচারণ করা মাত্র।
অনার্স পড়তে গিয়ে মনে বড় দীনতা ছিল যে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি, না জাািন কতটা অপূর্ণতা নিয়েই সারাজবিন ডিগ্রিটার ভার বহন করে চলতে হবে। পরে একবছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ (ফাইনাল) পড়তে গিয়ে অসামান্য শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাঁদের জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছি, সাহিত্য পাঠের সীমান্ত প্রসারী ব্যাপকতায় বিস্ময় মুগ্ধে আপ্লুত হয়েছি। কিন্তু সেখানে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের পরিচিতি ছিল স্থানিক। মোবাশ্বের আলী স্যারের ‘মধুসূদনের মেঘনাদবধ ও নবজাগৃতি’র ভূমিকা লিখে গিয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের প্রধান মুহম্মদ আবদুল হাই। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘সাহিত্য পত্রিকায়’ স্যারের বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছাপা হতো। দেরি হলেও পরে বুঝতে পেরেছি- ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স পড়ে খুব যে ঘাটতি বা প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকেনি। আমরা যে বছর (১৯৬৬) অনার্স পাস করেছি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আহমদ কবির দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল, প্রথম শ্রেণি কেউ পায়নি। তদ্রƒপ ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিমলকান্তি দে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তৃতীয় হয়েছিল। আমরাও তো ছয়জন ছাত্র/ছাত্রীর মধ্যে পাঁচজনই দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে পাশ করেছিলাম।
এই ধারাবাহিকতায় ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের অনার্স কোর্সের পঠন-পাঠন গৌরবে-ঐতিহ্যে এগিয়ে চলে আজ ৬০ বছর অর্থাৎ হীরক জয়ন্তীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ কার্যক্রম সগৌরবে বহমান। এখন তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি পেয়ে পাশ করেছে অনেকে। ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা অনার্স বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে বেঁচে থাকা শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের অহংকারের প্রত্যাশাটি অবশ্যই আকাশচুম্বী।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫