ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মাদকাসক্তির চিকিৎসা করুন
Published : Friday, 30 September, 2022 at 12:00 AM
মাদকাসক্তির চিকিৎসা করুন অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
মাদকাসক্তি হচ্ছে একটি মাদক বা ড্রাগের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াসমূহের বাস্তবতাকে পিছনে রেখে শুধু আরাম অনুভূতিকে ভোগের প্রবল বাসনায় বৈধ বা অবৈধ মাদক/ড্রাগ উপর্যুপরি অধিক মাত্রায় ব্যবহারের বদনেশা। মানকাসক্তরা প্রায়শঃই লক্ষণসমূহ গোপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু নিকটাত্মীয়/ বন্ধুবান্ধদের থেকে বিস্তারিত ইতিহাস জেনে কড়া নজরদারিতে কিছু লক্ষণ বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। প্রাথমিকভাবে একজন মাদকাসক্তকে নির্ণয় করতে যে সকল লক্ষণসমূহকে আমলে আনতে হবে-
ক্স    হঠাৎ কর্মস্থলে বা স্কুল-কলেজে উপস্থিতিতে পরিবর্তন বা হঠাৎ কাজের মাঝে ত্রুুটির প্রবণতা।
ক্স    মাদক নেয়া ছাড়া আনন্দ ফূর্তি বা বিশ্রামে অনীহা।
ক্স    অস্থিরতা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, মানসিক অবস্থার তড়িৎ পরিবর্তন, সামগ্রিক আচার আচরণে পরিবর্তন।
ক্স    ঘন ঘন টাকা হাওলাত চাওয়া, নিজের কাছে রক্ষিত বা ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি, চাকুরীস্থল, বাড়ী বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র চুরি।
ক্স    অসংলগ্ন কথা বলা, অযৌক্তিক মন্তব্য করা।
ক্স    ঘন ঘন অসময়ে সানগ্লাস বা লম্বা ঝুলানো শার্ট পড়া।
ক্স    শারিরীক অবস্থার বিচিত্র পরিবর্তন।
ক্স    পুরনো বন্ধদের চেয়ে নতুন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা ও সময় কাটানো।
ক্স    পরিশ্রান্ত, আশাহত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকা।
ক্স    নিজেরকে সবসময় সন্দেহজনক আচরণে ব্যস্ত রাখা, বারে বারে বিশ্রামের স্থানে গমন করা, নীরব নিভৃত জনশূন্য স্থানে বেশী সময় কাটানো যাতে কোন বিরক্তি ছাড়া মাদক সেবন করা যায়।
ক্স    দিনের বেলায় বেশী ঘুমানো এবং রাতের বেলায় বেশী সজাগ থাকা।
যেহেতু মাদকাসক্তি একটি পুন: আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপার তাই দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা চাইলে বেশী সময় আসক্তি থেকে মুক্ত থাকা যায়। চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতিও আসক্তির  একটি লক্ষণ। আসক্ত লোকটি কখনোই তার চিকিৎসা চাইবে না তাই তার সন্নিকটের সবাই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চিকিৎসা কাজে সহায়তায় হস্ত প্রসারিত করতে হবে। মাদকাসক্তি নির্ণয়ে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করতে পারেন একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিষ্ট), সাইকলজিষ্ট (মনোবিজ্ঞানী) বা মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ। যে সকল মাদকাসক্ত অস্বীকৃতি বেশি জানায় তাদের ক্ষেত্রে রক্ত বা প্রশ্রাব পরীক্ষা করে মাদকের উপস্থিতি নির্ণয় করা যেতে পারে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।
মাদকাসক্তি একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ন্যায় কার্যকরী চিকিৎসা দেয়া অত্যন্ত কঠিন। একই ধরণের চিকিৎসা বিভিন্ন মাদকাসক্তকে দেয়া যায় না। চিকিৎসার ব্যাপারে মাদকের প্রকারভেদ ও মাদকসেবীর প্রয়োজনীয়তার ভিন্নতা হিসাবে আনতে হবে। মাদকের বিষাক্ততা নিবারণ, সুনিপুণ পরামর্শ ও অনেক ক্ষেত্রে ভেষজ চিকিৎসা এক্ষেত্রে সফলতা আনতে সক্ষম। সম্পূর্ণ মুক্তির জন্য বিভিন্ন মেয়াদী চিকিৎসা সম্পন্ন করতে হবে। আচরণগত এবং ভেষজ এ দুপ্রকারের উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে বিদ্যমান আছে। আচরণগত চিকিৎসা আসক্তকে মাদক সেবন থামায়, মাদক ছাড়া কিভাবে থাকা যায় তা শেখায়, পুনরায় নেশাগ্রস্থ হতে বাধা দেয়, মাদক নেয়ার পরিবেশ থেকে আসক্তকে দূরে রাখে, তীব্র আকাঙ্খা দূরীভূত করে। ভেষজ চিকিৎসায় মাদকের ক্রিয়াকে ধ্বংস করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও আচরণের পরিবর্তন ঘটায়, মাদক প্রত্যাহার বিক্রিয়াকে প্রশমন করে এবং মাদক সেবনের প্রবল ইচ্ছাকে বিতাড়িত করে। অতিরিক্ত প্রবল বাসনার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ভেষজ ও আচরণগত থেরাপি দিতে হয়।
মাদক ছাড়ার পর আবার আসক্ত হওয়ার ঘটনা অনেক, কেন আবার মাদকাসক্ত হচ্ছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান অনেক মাদক সেবনের উৎস- মনের আনন্দে বা অতি মনকষ্টে অনেকে মাদক নেয়- কিছু লোক নিজের উপর পরীক্ষা করতে গিয়ে মাদকসক্ত হয়ে পড়ে- এগুলোর মধ্য থেকে সঠিক কারণটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বন্ধু-বান্ধব। অবসর সময়ে তরুণেরা বা ছেলেমেয়েরা কি করে তা নজরে রাখতে হবে। শ্রদ্ধাবোধ, মনের মিল, বিভিন্ন জনের সঙ্গে সম্পর্ক-এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ। হতাশা, দুঃখবোধ ও নব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অনেকে মাদক নেয়। প্রথমে তারা বন্ধুদের কাছ থেকে শেখে। তাই তরুণদেরকে নিরাপদ বন্ধু মহলে চলাফেরা ও নির্মল আনন্দদায়ক কাজে অংশগ্রহণ করা নিশ্চিত করতে হবে।
কতটুকু মাদক নিলে মানসিক রোগী হয় তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এ কথা নিশ্চিত যে, মাদক নিলে মানসিক রোগী হয়। মাদকাসক্ত হলে ত্বকের রং, শারিরীক অবস্থা, কথার ধরণ ইত্যাদি বদলে যায়। যারা ইনজেকশন নেয় তাদের হাত দেখলেই বুঝা যায়। মনরোগ বিশেষজ্ঞরা চেহারা দেখলেই অনুমান করতে পারে অনেক ক্ষেত্রে। সমস্যা হয় নতুন মাদকাসক্ত সনাক্তকরণ যাকে পরীক্ষা, নিরীক্ষা করে নির্ণয় করা হয়। যারা মাদকাসক্ত হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক ভালো থাকেনা। ছেলে-মেয়েরা বড় হলে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী অভ্যাসসমূহ গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন তাই ছোট থাকতেই ভালো অভ্যাসসমূহ রপ্ত করে নিতে হবে। সন্তান বাসায় আসলে তার সঙ্গে কথা বলার সময় ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করতে হবে এবং খারাপ বা ভূল কাজের জন্য পরে অন্য এক সময় বুঝাতে হবে। মা-বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক যতটা সম্ভব প্রাণবন্ত করে রাখা চাই। মাদকসেবীকে পরিবার ও সমাজ সকল সময় সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মাদক ছাড়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি- সেই ইচ্ছা শক্তি বাড়ানোর কাজে চিকিৎসকের সহায়তা প্রয়োজন, যে কাজে মাদক সেবীর পারিপার্শি¦ক লোকজন বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র আছে। প্রায় ১৫০ শয্যার এই নিরাময় কেন্দ্রে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা নেয়া যায়। সাধারণ কোন রোগের জন্য পিতা-মাতা সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান অথচ মাদকাসক্ত সন্তানের ব্যাপারে পিতা-মাতা হতাশ হয়ে পড়ে। এখানে হতাশার কিছু নাই মাদকসক্ত সন্তানকে অবশ্যই প্রয়োজনে বারে বারে মনরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট যেতে হবে। আপনার সন্তানকে ফলোআপে রাখতে হবে সবসময়, কোন ভাবেই মনে করা যাবে না যে, সে একজন নষ্ট ছেলে/মেয়ে।
মানুষের জীবনে দু:খ, কষ্ট, ব্যাথা, বেদনা ও প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। এগুলো জীবনের সাধারণ ঘটনা। তাই বলে দু:খ কষ্টকে ভুলে থাকার জন্য  মাদক নিতে হবে, এটার কোন যৌক্তিক  কারন নাই। জীবনকে আনন্দ দিতে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে মাদক থেকে অনেক দুরে থাকা দরকার। মানসিক শক্তি বা মনোবল অর্জন করতে পারলেই মাদক ছাড়া সম্ভব। মাদককে না বলার ক্ষমতা  নিজের মধ্যে লালন করতে হবে। কোনভাবেই নেশার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। মাদক থেকে দুরে থাকতে হলে মনোবলকে শক্ত করতে হবে। মাদক মানুষের চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি ও আচরনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন শিক্ষার্থী প্রেমে পড়তেই পারে। যে কোন কারনে বিচ্ছেদ আসতেই পারে। কিন্তু এজন্য মাদকে আসক্ত হতে হবে, এটা কোনভাবেই ঠিক নয়।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।