মাউন্ট
মঙ্গানুইকে সবাই ভেবেছিল একটা মাইলফলক। গত জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের
মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারানোর পর এ দেশের ক্রিকেটের কল্পলোকে শুধু
সুন্দর দিনেরই ছবি ফুটে উঠেছিল। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট আর পেছন ফিরে
তাকাবে না। তরতর করে সামনে এগিয়ে যাবে।
বিদেশের মাটিতে এর আগেও বাংলাদেশ
টেস্ট জিতেছিল। কিন্তু সেসব জয় আর মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের জয় এক ছিল না।
নিউজিল্যান্ডের ঘরে ঢুকে নিউজিল্যান্ডকে হারানো বলে কথা। সেটাও কী প্রতাপ
দেখিয়ে! সবাই ভেবেছিল, এই জয় নিশ্চয়ই টেস্টে বাংলাদেশের নতুন দিনের সূচনা।
টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হকের নব-অভিষেক।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ কারওই অজানা
নয়। মরীচিকাভ্রম কাটিয়ে আমরা দেখলাম, মঙ্গানুই জয় আসলে কোনো মাইলফলকই ছিল
না। ছিল একটা ‘ইউ টার্ন’। অথবা পর্বতের সেই শৃঙ্গ, যেখানে উঠলে উল্টো দিকে
শুধু গড়িয়েই পড়তে হয়।
নিউজিল্যান্ডে সেই শৃঙ্গে ওঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকা
সফর, এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠের টেস্ট সিরিজ এবং এবার ওয়েস্ট
ইন্ডিজে এসেও অ্যান্টিগার প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ দল শুধু গড়িয়েই পড়ল। গড়াতে
গড়াতে মাত্র পাঁচ মাসেই মাউন্ট মঙ্গানুই দূর অতীতের স্মৃতি। অধিনায়ক
মুমিনুলের নতুন শুরু মুহূর্তেই শেষ দেখে ফেলল অধিনায়কত্বের বিসর্জনে। ওপরে
ওঠার সিঁড়ি বাওয়া দূরের কথা, নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর থেকে বরং
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়েই পড়ে যায় টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ। যেন ফিরে গেছে সেই
আগের জায়গায়, যেখান থেকে নতুন করে শৃঙ্গে ওঠাটাকে মনে হয় অসম্ভব এক
কল্পনা।
কেন বাংলাদেশ টেস্টে এক কদম এগিয়ে তিন কদম পিছিয়ে যায়, তার কোনো
ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি বলবেন ব্যাটিং ব্যর্থতার কথা।
নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য নেই, সেটি কি বলা যাবে?
পরিসংখ্যানের পৃষ্ঠা উল্টে দেখুন। ব্যাট হাতে টানা ব্যর্থ যে মুমিনুলকে এখন
শুধু শূলে চড়ানো বাকি, তাঁর নামের পাশে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১১টি
শতক। ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পিঠাপিঠি শতক করা তামিম ইকবাল
টেস্টে তিন অঙ্ক ছুঁয়েছেন ১০ বার। লিটন দাস সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজেও
ছিলেন দুর্দান্ত। অ্যান্টিগার ব্যাটিং–ব্যর্থতা নিয়ে কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর
বিশ্লেষণেও ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। তাঁর চোখে সমস্যা
ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসে, সমস্যা মানসিকতায়।
সর্বশেষ ১০ ইনিংসে দুই
অঙ্কের রান নেই, এর মধ্যে চারটিই শূন্য—পেছনের এই ইতিহাসের পরিষ্কার
প্রতিচ্ছবি ছিল মুমিনুলের ব্যাটিংয়ে। সাকিব আবার বলছেন উল্টোটা। কোচের কথার
ঠিক এক দিন পর অ্যান্টিগা টেস্ট শেষে ব্যাটসম্যানদের মানসিকতায় পরিবর্তন
প্রয়োজন বলেও অধিনায়ক ধাক্কাটা দিয়েছেন অন্য জায়গায়। তাঁর সরল ভাষণ, দলের
অনেক ব্যাটসম্যানেরই টেকনিকে সমস্যা রয়ে গেছে। এই ব্যাটসম্যানদের নিজেদের
উন্নতি নিজেদেরই করতে হবে। উন্নতির সুযোগ যে কারও সব সময়ই থাকে। কিন্তু
সাকিব যে সুরে কথাটা বলেছেন, তাতে মনে হলো টেকনিকের ঘাটতি তিনি বেশ ভালোই
দেখেছেন, যে পরিমাণ ঘাটতি অন্তত জাতীয় দল পর্যন্ত চলে আসা ব্যাটসম্যানদের
সঙ্গী হওয়ার কথা নয়।
সে রকম হলে সমস্যা অবশ্যই প্রকট এবং সেটি অনেক
কিছুই গোড়া থেকে শুরুর দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত এসেও যদি
কারও ব্যাটিং–কৌশলে সে রকম ঘাটতি থেকে যায়, বুঝে নিতে হবে, আগের ধাপগুলো
পেরিয়ে আসতে খুব কঠিন পরীক্ষায় তাঁকে পড়তে হয়নি। আর সেটি আবারও প্রশ্ন তুলে
দেয় ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মান নিয়ে। সেখানে কারা খেলেন, কেমন
উইকেটে খেলা হয়, এসব খেলে একজন ক্রিকেটার আসলে কতটা পরিণত হন? এ আলোচনা
অবশ্য বহুদিনের এবং বিসিবির নির্বাচনমুখী ক্রিকেট নীতির কারণে আরও বহুদিনই
হয়তো সেটি টিকে থাকবে। আপাতত অত বড় বিষয়ে না তাকিয়ে সাম্প্রতিক কালে
বাংলাদেশ দলের টেস্টের ব্যাটিংটাই দেখা যাক।
পেস-জুজু নিয়ে দক্ষিণ
আফ্রিকায় গিয়ে উল্টো দুই টেস্টেই দুই স্পিনার সাইমন হারমার ও কেশব মহারাজের
বলে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস। দুজনের কেউই এমন কোনো মহা স্পিনার
নন, ডারবান-পোর্ট এলিজাবেথের উইকেটও অতটা উইকেট সংহারি ছিল না। তবু
বিস্ময়করভাবে যে বোলিংটা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ভালো খেলেন বলে সবাই
জানে, ধরাশায়ী সেই স্পিনেই। উইকেটে গিয়ে কী এক অজানা অস্থিরতায় যেন
ভুগছিলেন ব্যাটসম্যানরা।
গত মে মাসে মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে
ব্যাটিং-বিপর্যয়ের কাহিনি আবার বিপরীত। এবার ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন শ্রীলঙ্কার
দুই পেসার কাসুন রাজিতা আর আসিতা ফার্নান্ডো। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটে
পেসারদের সামনে এর আগে এতটা নাকাল বাংলাদেশ কমই হয়েছে। এবার কেন হলো, সেই
ব্যাখ্যাও কিন্তু নেই। ব্যাটসম্যানদের আউটের ধরনগুলো থেকে একটা ধারণা অবশ্য
পাওয়া যায়। যে উইকেটে আর যে বোলারের বিপক্ষেই খেলা হোক না কেন, প্রথম
এক-দেড় ঘণ্টার ব্যাটিংটাই যেন ভুলে গেছেন তাঁরা! ওই সময় বল একটু এদিক-সেদিক
করতেই পারে এবং সেটা সামলেই বিশ্বের সব টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান খেলেন। শুধু
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যেন এটি সমাধানের অযোগ্য এক সমস্যা।
কখনো কখনো
অবশ্য মনে হয়, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছে দিনের শুরু আর শেষটা একই!
সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে কোনো পার্থক্যই নেই। ডারবানে যেমন ৫৩ রানের লজ্জার
ইনিংসে বিপর্যয়ের শুরু চতুর্থ দিন শেষ বেলায় ৬ ওভারে ১১ রানে ৩ উইকেট
হারিয়ে। শেষ দিন সকালেও সে ধারাবাহিকতাই বজায় থাকল। বাকি ৭ উইকেট হারাতে
খেলতে হয়েছে আর মাত্র ১৩ ওভার। পোর্ট এলিজাবেথে পরের টেস্টে ৮০ রানে অলআউট
হওয়া দ্বিতীয় ইনিংসের চিত্রনাট্যও মনে হয়েছে একই হাতে লেখা। তৃতীয় দিন শেষ
বেলায় ২৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে পরদিন লাঞ্চের বেশ আগেই ম্যাচ শেষ।
মিরপুরে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা ভেঙে পড়েছিল সকালে। প্রথম ইনিংসে
৭ ওভারের মধ্যে ২৪ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে তবু টেনে তুলেছিল মুশফিক আর
লিটনের শতক। দ্বিতীয় ইনিংসে তা–ও হয়নি। ২৩ রানে পড়ে প্রথম ৪ উইকেট। মাঝে
সাকিব-লিটনের মৃদু প্রতিরোধের পর ইনিংস যবনিকা ১৬৯ রানে।
অ্যান্টিগা
টেস্টের প্রথম দিনেও সকালের ঝোড়ো হাওয়াটাই সইতে পারেনি বাংলাদেশ। ১০৩ রানে
অলআউট ব্যাটসম্যানদের অসহায়ত্বে সামান্য মলম হয়েছে বোলারদের সাফল্য। কিন্তু
ব্যাটিং–ব্যর্থতার রহস্য উদ্ঘাটন তবু বাকি থেকেই যাচ্ছে। রহস্যের সমাধান
দিতে পারে কেবল সেই চুটকি। বাংলাদেশের ব্যাটিং ভালো হয় না দুই দিন। যেদিন
তাদের সকালে ব্যাটিং করতে হয়, সেদিন এবং যেদিন তাদের বিকেলে ব্যাটিং করতে
হয়, সেদিনও।