
স্মরণ
স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া অন্তর্লীন কথা সাহিত্যিক কায়েস আহমেদ।
কায়েস আহমেদ জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না। খ্যাতি, বিত্ত, ঐশ^র্য- এসব তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে সাহিত্য সাধনায় নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। এই মহৎ নিভৃতচারী লেখক আজ মাটি ও মহাকালের অংশ। জীবিতকালে চারটি মাত্র বইঃ অন্ধ তীরন্দাজ (১৯৭৮), দিনযাপন (১৯৮৬), নির্বাসিত জীবন (১৯৮৬), লাশকাটা ঘর (১৯৮৭) প্রকাশ হয়।
কায়েস আহমেদ বিভাগোত্তর বাংলাদেশের শক্তিমান কথা শিল্পী। জন্ম ২৫ শে মার্চ ১৯৪৮। গ্রাম বড় তাজপুর, থানা শ্রী রামপুর, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। মাতা ওলিউন্নেসা, পিতা শেখ কামাল উদ্দিন আহমেদ। দেমভাগ ও পিতার চাকরি বদলের সূত্রে ঢাকা আগমন ও বসবাস। ম্যাট্রিক পাশ ১৯৬৪ সারে।আইএ ১৯৬৬ সালে। অতঃপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে ভর্তি অনার্স শেষবর্ষে অধ্যায়নে ছেদ পড়ে। পূর্বদেশে প্রথম গল্প প্রকাম। দৈনিক গণকণ্ঠ এবং সংবাদ- এ সাংবাদিকতা করলেও কায়েস আহমদেও আজীবন পেশা ছিল শিক্ষকতা। মৃত্যূও আগ পর্যন্ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে বাঙলার শিক্ষক ছিলেন। বিয়ে ১৯৮৩ সালে। একমাত্র পুত্র অনীক আহমেদ। হুমায়ূন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), মৃত্যূ ১৪ জুন ১৯৯২।
গল্পঃ অন্তর্লীন চখাচখী। সমস্ত গল্প জুড়িয়া শীত কাল। কেন শীত কাল ! শীত কালের আবরণে আর কিছু আছে কি না আমরা দেখবো একটু পড়ে। আগে তিনটি শীত কণা হাত পেতে নেই। প্রথম কণাঃ দোলা নামের মেয়েটি কাঁধ ডিঙিয়ে বুকের উপর পড়ে থাকা আঁচলকে অল্প তুলে আরো একটু টেনে এনে বুকের উপর রাখে এবং চকিতে ছেলেটির, মানে পল্টু নামের বাইশ - তেইশ বছরের যুবকটির দিকে তাকালে দেখে, সে তখন বাঁদিকের দেওয়ালে গভীভোবে কি যেন নিরীক্ষণ করছে, দোলা মেয়েটি চার পাশে তাকিয়ে বলে ‘ কী ঠাণ্ডা’। দ্বিতীয় কণাঃ ... তার যেনো শুধুই অভ্যাস বশে বইয়ের মাঝামাঝি একটি পাতা খুলে তার ওপরে দুই চোখ নিবদ্ধ করে এবং হঠাৎ কিঞ্চিৎ শীত ও সেই সঙ্গে তৃষ্ণা অনুভব করে সে।
তৃতীয় কণাঃ বাইরে নিঃশব্দ শিশিরপাত, ভিজে ভিজে নরম জোস্না।
পৃথিবীতে শীত আসে । কেন আসে? জীবনানন্দ দাশ বলেনঃ
“ এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা পেঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।”
কবিতায় গদ্যের রুক্ষতা অনুপস্থিত। শীত এখানে মুখোশ। মুখোশের অন্তর্লীনে যা ছিলো তার তত্ত্ব তালাশে দেখি, জোসেফ ক্যাম্পবেল বলেন, ‘ রহস্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকলে জানবেন যে ব্রহ্মাণ্ডের একটি দিক রয়েছে যা আপনার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধরা ছোঁয়ার উর্দ্ধে। উপনিষদে একটি লাগসই বচন আছে তাতে বলা হয়েছে, “ সূর্যাস্তের সৌন্দির্য দেখে কি পর্বতমালার সৌন্দির্য দেখে আপনি যখন মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে বিস্ময়োক্তি করেন, ‘আহ!’ তখনই কিন্তু আপনি স্বর্গীয় সত্তায় অংশ নেন।” ক্যাম্পবেল আরো বলেন, “ জীবনের বিস্ময়ের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আমার রয়েছে হিংসা দ্বেষের, এক ব্যাটার চোপায় ঘুষি মারার ইচ্ছা পোষণের অভিজ্ঞতা। প্রতীকী চিত্রকল্পের কোন থেকে দেখলে ওইসব বিভিন্ন শক্তি আমার মনে ক্রিয়ারত। ওদের সম্পর্কে এভাবে ভাবা যায় যে ওরা বিস্ময়, ভালোবাসা, ঘৃণা- ওরা বিভিন্ন স্বর্গীয় শক্তি দ্বারা অনুপ্রাণীত।”
স্বয়ং লেখক তাঁর এ গল্পে পল্টুর জবানিতে বয়ান করেন- ‘জানো , চখাচখি সম্বন্ধে একটা কাব্যশ্রুতি আছে-তারা সারাদিন খুব কাছকাছি থাকে, পাশাপাশি, দিন শেষ হযেয় রাত নামলে একজন আরেকজনকে আর দেখতে পায় না। সরারাত পরস্পর পরস্পরকে ডেকে ডেকে ফেরে; কিন্তু কেউ কাউকে কাছে পায় না। এমনি সারারাত।’
এ গল্পে পল্টুকে সাপে কাটে। সেই সাপের রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা। হাসান আজিজুল হকের ‘ আমৃত্যু আজীবন’ গল্পে আমরা যে সাপের দেখা পাই সেই সাপও বিশদ বর্ণনায় উপস্থিত। হাসানের গল্পের প্রকাশ কাল ১৯৬৭ কায়েসের গল্পের প্রকাশ কাল ১৯৭৮।
এই গল্প দিয়ে কায়েস আহমেদ’কে বুঝা যাবে না। ভুল বুঝার সম্ভাবনা থেকে যাবে। কায়েস ছিলেন রাগী তেজি। লেখা সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘ লেখক শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক সময় তুমুল আলোড়ন হয়েছিল আমাদের দেশে।
এখানে দৃষ্টিভঙ্গি বলতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হচ্ছে- বিশেষতঃ চল্লিশের দশকের বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন এই রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ভাবেই তার ধাক্কা লাগে।
ইদানীং শিল্প সাহিত্য নিয়ে আবার নতুন করে প্রসঙ্গটি আসছে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে কারো কারো মুখে, যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে শেষ করেছেন আমাদের সাহিত্য বিশেষতঃ কথা সাহিত্য, সেখান থেকে শুরু করতে হবে। ব্যাপারটি যেন রীলে রেসের মতো- একজনের হাত থেকে নিয়ে দৌড় দেওয়া। এভাবে আর যাই হোক শিল্প-সাহিত্য হয় না, প্রতিটি লেখককে শুরু থেকেই শুরু করতে হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
হ্যাঁ, একথা সত্যি, একশোবার স্বীকার্য যে, একজন লেখককে (জনমনতোষী বাণিজ্যবুদ্ধিসর্বস্বদের কথা আলদা) এ যুগের মানুষের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে কলম চালনা করতে হবে।
কিন্তু তার জন্য লেখককে নিজের পথ নিজেকেই নির্মাণ করে নিতে হয়। চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে কোন একটি নির্দিষ্ট আদর্শকে বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করলেই যে তিনি সেই আদর্শ অনুযায়ী গড় গড় করে সৃষ্টি করে ফেলবেন, তা হয় না। এ ধরণের রচনা তাৎক্ষণিক আবেগ-সজ্ঞাত, মোটা দাগের অতি সরলীকরণ, যান্ত্রীক, ইচ্ছাপূরণ মাত্র।
ভেতরে তার মস্ত ফাঁকি থেকে যায়।
গোট বিষয়টা গড়ে ওঠার ব্যাপার,হয়ে ওঠার ব্যাপার।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী ১৯৬০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২] বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৮৬ সালে লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার প্রথম শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়।[৩] এছাড়াও তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ও নাটকসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন। তার অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে, বিবাহবার্ষিকী ও অন্যান্য গল্প (ছোটগল্প), সম্ভ্রমহানির আগে ও পরে (গল্পগ্রন্থ), মাঠের ওপারে যাবে, লীলা? (কাব্যগ্রন্থ), নার্গিস ও বাসন্তী (উপন্যাস), তোমার পুরুষ কোথায়? (উপন্যাস) প্রভৃতি।[২]
কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।[১]
ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসনের একটা নাটকের নাম ভলপোনি। ওখানে একজন চরিত্রের মারাত্মক লোভ বৈষয়িক জিনিসের প্রতি, বিশেষ করে স্বর্ণের প্রতি। তো, সে সকাল শুরু করে স্বর্ণের প্রতি অভিবাদন জানিয়েঃ "এড়ড়ফ সড়ৎহরহম ঃড় ঃযব ফধু; ধহফ, হবীঃ, সু মড়ষফ." ভদ্রলোকের টাকাপয়সা, স্বর্ণ-চান্দির কোন অভাব নেই। কিন্তু, সমস্যা হলো তাঁর সীমাহীন লোভ। এই লোভই অন্তিমদশায় তাকে বেশ ভোগায়। বাইবেলে বর্ণিত সাতটি নারকীয় পাপের একটি হলো লোভ। লোভের বশবর্তী মানুষ নিজেকে অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে দ্বিধা করে না। কার্ল মার্ক্স "ঞযব চধংংরড়হ ড়ভ এৎববফ" এ বলেছেন, পুঁজিবাদের ঈশ্বরের নাম টাকা। মানব সমাজের ইতিহাস জুড়ে আছে লোভের বশবর্তী মানুষ। সে নিজেকে তার প্রয়োজনীয় মানবিক গুণাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে দ্বিধাবোধ করে না। লোভ সকল মূল্যবোধকে তার বিপরীত শক্তি হিসেবে পরিণত করে। বিশ্বস্ততাকে অবিশ্বস্ততায় রুপ দেয়, ভালোবাসাকে ঘৃণায়, ঘৃণাকে ভালোবাসায়, সততাকে অসততা,অসততাকে সততা, প্রজাকে প্রভু, প্রভুকে প্রজা, নির্বুদ্ধিতাকে বুদ্ধিমত্তা এবং বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতায় রূপান্তরিত করে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস খুন ও আনন্দ কুসুমের অন্যতম থিম হলো লোভ। এই লোভই শেষমেশ সব সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। ভাই ভাইকে সম্পদের লোভে ছাদ থেকে ফেলে দেয় ধাক্কা দিয়ে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে না পেরে হতাশায় তাকে সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে সুস্থতার ছাড়পত্র পেয়েও ঘরে আনে না। গড়িমসি করে রেখে আসে সেখানে আরেকটা মানসিক রোগীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে? শিবলী ও বেলাল দুই ভাই। বড় ভাই বেলালের বৈষয়িক লালসার শিকার শিবলী। কিন্তু, ভাগ্যের মুদ্রার পিঠ উল্টে শিবলী বেঁচে যায়। নিয়তির নির্মম পরিহাস অন্যজনের হাতে তাকে প্রাণ দিতে হয় সেই পুরনো কায়দায়, যেভাবে সে মেরে ফেলতে চেয়েছিল আপন ছোট ভাইকে।
এই উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্র লোভের লাল জিহবার শিকার। রাফিয়া গোলাম সারওয়ার নামে এক লম্পট ও লোভী ব্যবসায়ীর কাছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। বিচার হিসেবে সবচেয়ে জঘন্য সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দেয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তার পরিবার। রাফিয়ার বিধবা মা ও ছোট ভাই আলমগীর ধর্ষক সারওয়ারের ফ্যাক্টরিতে তার চাকরি পাওয়ার লোভের টোপে পা দিয়ে বোনকে একজন ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়।
মানসিক চিকিৎসালয় ও আশ্রয় কেন্দ্রের দারোয়ান শেখ আহমদ আর শিবলী দুজনের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা কাকতালীয়। দু'জনেই প্রিয়জনের লোভের বলি। শেখ আহমদের প্রিয়তমা স্ত্রী তার প্রবাসে থাকা অবস্থায় এলাকার একজন প্রভাবশালী লোককে বিয়ে করে। শুধু তাই নয় সেই প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে শেখ আহমদের কলিজার ধন ছেলেটা খুন হয়। " কোন এক গভীর বেদনার জায়গায় দুইজনের জীবনের মিল থাকলে সম্পর্কটা সহজে ভালোবাসার জায়গায় পৌঁছায়।" শেখ আহমদ আর শিবলীর সম্পর্কটা এভাবে গড়ে উঠে। ভদ্রলোক নিজে প্রতিশোধ নিতে না পারলেও চান শিবলী যেন বিচার পায়।
খুন ও আনন্দ কুসুম নাগরিক জীবনের গল্প। চট্টগ্রাম শহরের প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ীর দুই সন্তানের মধ্যকার সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিবাদের গল্প। লোভ মানুষকে কতটুকু ইতর বানাতে পারে সেটা এই উপন্যাস পড়লে বুঝা যায়? প্রায় প্রত্যেক চরিত্র লোভের বশবর্তী হয়ে একে অপরের ক্ষতি করে। লোভ, লাম্পট্য, প্রেমহীনতা, প্রেমে বঞ্চিত হওয়া এসব নাগরিক জীবনের নিত্যকার ঘটনা। সাংবাদিক জোবেদুর রশিদ, যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় একজন অসৎ লোক। ভেতর ভেতর সেও এক হৃদয়ভঙ্গের যাতনা বয়ে বেড়ানো মানুষ। বেলালের স্ত্রীর সাথে তার প্রেম ছিল। কিন্তু, বিয়েটা হয় বেলালের সাথে। বেলাল তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, নিয়ত নির্যাতন করেছে এটা জানার পর সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না? শেষমেশ বেলালকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রতিশোধ নেয়।
নাগরিক জীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শওকত আলীর। তাঁর পাকা দেখা উপন্যাসের সাথে ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারজয়ী বিশ্বজিৎ চৌধুরীর খুন ও আনন্দ কুসুমের একটা মিল আছে। উভয়েই তাঁদের সমাজ অণুবীক্ষণের মাধ্যমে তুলে এনেছেন নাগরিক জীবনের বিদ্যমান সব সমস্যার কথা, সেসব সমস্যা তৈরির পেছনে কী কী নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে সেই প্রসঙ্গ। খুন ও আনন্দ কুসুম একটা অন্যতম নাগরিক উপন্যাস। তথাকথিত নগরজীবন ও নাগরিকদের ভেতরকার দূষিত, পূজময় দুর্গন্ধ ছড়ানো ব্যাধিগুলো খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ক'রেছেন কথক এবং পাঠকমাত্রই বিস্মিত হবেন লেখকের এই আশ্চর্য রকম সমাজ ভাবনায় ডুবে?
আলমগীর মোহাম্মদ, শিক্ষক ও অনুবাদক।
সিরাজুল ইসলাম জীবন
কাশফুল কখনো বিষফুল
নদী চলার বাঁকে বাঁকে যেমন কাশফুল ফুটে জীবননদীর বাঁকেও তেমনি কাশফুলের মতো রঙ ধরে। জীবন আসলেই রঙের খেলা। রঙের উৎপত্তি কীসে? সীমাহীন আবেগ থেকে জন্ম নেয় স্বপ্নঘোর। স্বপ্নের প্রতিটি সিঁড়িই নানান রঙে রাঙানো। আবেগশূন্য মানুষই স্বপ্নশূন্য; আর স্বপ্নশূন্য মানুষ রোবট বা যন্ত্রমানব। ইঞ্জিনিয়াররা পেশাগত কারণেই বাস্তবধর্মী হয়, একদম রোবট না হলেও নিয়ন্ত্রিত আবেগের মানুষ। নিজের চরিত্রের উপর যথেষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ থাকে তাদের। এই নিয়ন্ত্রণ কখনো কখনো পরাজয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইঞ্জিনিয়ার তুহিন পরাজয় মানতে নারাজ।
পিতার ইচ্ছায় তার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়া। এ নিয়ে পিতা-পুত্রে অনেক মান-অভিমান ঘটে। তুহিনের কলা অনুষধের প্রতিটি বিষয়ই প্রিয়। বিশেষ করে সাহিত্য, ইতিহাস এবং দর্শন। কিন্তু বাবার অনুগত পুত্রের এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হয়নি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও তুহিনের পক্ষে সম্ভব হয়নি সাহিত্য-দর্শন ভুলে থাকা। কর্মজীবনে এসে তুহিনের নিকট আরো প্রিয় হয়ে ওঠে কলাশাস্ত্র। প্রচণ্ড আবেগ ও স্পর্শকাতর তুহিনকে কে বলবে ইঞ্জিনিয়ার? জন ডান ও কীটসের কবিতা তাকে ক্রমাগত এক স্বপ্নের রাজ্যে ডুবিয়ে রাখে। লতা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে প্রায় সে নিমজ্জিত থাকে । ক্যারিয়ার বিবেচনায় তুহিন একজন বড় মাপের ইমারত শিল্পী। কিন্তু এ পরিচয় তার নিকট গুরুত্বহীন। বরং প্রাসাদ অভ্যন্তর মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়াবলীতেই তার ঝোঁক বেশি। তুহিন শুধু প্রাসাদ বানায় না রাঙায়ও ও
ঘুষ-দুর্নীতির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণায় তুহিন সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর বিষাক্ত ঢাকা শহরও ছেড়ে সোজা কুমিল্লা শহরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজেই একটা ফার্ম খুলে বসে। একদম স্বাধীন জীবন। মন চাইলে বিল্ডিং-এর নকশা তৈরি করা অথবা নান্দনিকতার সর্বো”চ প্রয়োগ। কখনো সে শেলীর স্কাইলার্ক পাখির গাওয়া অজানা সঙ্গীতে ডুবে থাকে। কখনো নজরুলের বেদনা বিধুর সুরের মূর্ছনায় স্বপ্নের বাসিন্দা হয়ে ওঠে। কখনো কখনো হারমোনিয়ামে নিজের কণ্ঠের সুর লহরি---'উচাটন মন ঘরে রয় না, পিয়া মোর উচাটন মন ঘরে রয় না...’ নিতল নিস্তব্দতায় সমাহিত থাকে।
তুহিনের অলিন্দ নিলয়ে সৌন্দর্যতৃষ্ণা বাড়াতে থাকে। ওর ভেতরকার স্বপ্নদোয়েল অবচেতনেই শিশ তোলে। বুয়েটে পড়ার সময় ক্লাসমেট ডালিয়া নামের মেয়েটি এখন চোখের পর্দায় প্রজাপতির ডানা মেলে। প্রজাপতির মতোই ডালিয়ার গায়ের রঙ; হলুদ। নারীদের গায়ের রঙে বৈচিত্র্য আছে, আছে মোহময় ঘ্রাণ। এরমধ্যে হলুদ বর্ণ কদাচিৎ দেখা যায়। ছাত্রজীবনের শেষ গর্যায়ে এসে তুহিন হলুদ বর্ণে মোহাবিষ্ট হয়। ওকে আরো বিস্মিত করেছে ডালিয়ার শব্দ উচ্চারণের ব্যক্তিগত ধরণ। ওর সঙ্গে কথোপকথন মানে স্বপ্নপ্রাসাদ আঁকাআঁকি; হিসেবহীন সময়ে সন্তরণ। সময় যে কোনদিকে দিয়ে পাড় হয়ে যায় টের পাওয়া যায় না।
একদিন তুহিনের হৃদয়ে গভীর আবেগ সঞ্চারিত হয়। তারপর স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চূড়ায় আরোহণ। মগজের কোষে কোষে জোয়ার অর্থাৎ গভীর স্বপ্নঘোর; প্রজাপতির নাচন, শুধুই হলুদ রঙের ছড়াছড়ি।
ডালিয়াকে বলে, "একদিন তোমার বাসায় যাব।"
ডালিয়া বলে,"হ্যাঁ অবশ্যই সময় নিয়ে আসবা।"
ওর হলুদ মাখানো হাসি তুহিনের যাবার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করে ঠিকই একদুপুরে সে ডালিয়ার বাসার অভিমুখে ছুটে। দুরন্ত গতি আর রোমান্স ভর করে তুহিনের শিরায় । অন্য দিগন্তে উড়াল দিতে উদগ্রীব সে। ডালিয়াদের পাঁচতলা বাসার সিঁড়ি বেয়ে উঠছে , এক সীমাহীন চঞ্চলতা তার প্রতিটি তন্ত্রীকে গ্রাস করে । ভেতরে রক্তপ্রবাহের গতি উদ্দাম নৃত্য করে চলে। তিন তলায় ওঠে কলিংবেল টিপতেই ডালিয়া হাজির। মৃদু হাসির ঝিলিক। চোখাচোখি। মুখোমুখি। মাঝখানে একটা টি-টেবিল। আধাঘন্টার মধ্যেই জলযোগ এবং চা...। তুহিন-ডালিয়া ছাড়া অন্য কেউ ছিল না তখন। কেউ কাউকে তখনো বুঝতে পারছে না। উভয়ের দিকে উভয়ের কৌতূহলী দৃষ্টি। উভয়ের মাঝখানে সীমাহীন এক দ্বিপ্রহর।
ওরা আরো কিছুক্ষণ স্মৃতিকাতরতায় নিমজ্জিত। ডালিয়ার ভেতরে উচ্ছ্বাস উঠে, কিন্তু চেহারায় তা একেবারেই ভাবলেশহীন। চরিত্র এবং আবেগের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ বিস্ময়কর। বসবার ভঙ্গি এমন---তাকে প্রাচীন গ্রিসের স্ট্যাচু বলে বিভ্রম হতে পারে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ তার রসুনের মতো খোঁপা। তুহিনের চাঁপাফুল গুঁজে দেয়ার ইচ্ছে হয়। এরকম সাধ-ইচ্ছে কোনো কালেই আলোর মুখ দেখে না। ডালিয়ার বিভ্রান্তি ডালপালা মেলছে। তুহিনের আগমনের হেতু কী? এর জবাব পেতে তার জিজ্ঞাসা ব্যাকুল। ক্লাসমেট হিসেবে তুহিনকে সবসময়ই কিছুটা নির্লিপ্ত এবং নিভৃতচারী বলেই ও জানতো। পারতপক্ষে তুহিন কারো সঙ্গেই গভীরভাবে মিশতো না। একেবারেই স্রোতের বিপরীতে অবস্থান। কিন্তু হঠাৎ তার চরিত্রের পরিবর্তন দেখে ডালিয়ার বিভ্রান্তি চরমে । উভয়ই নীরব। ঝড়ের পূর্বাবস্থা । অসহনীয়।
তুহিনের বাঁধ ভাঙলো, "আমাদের শিক্ষাজীবন দ্রুত ফুরিয়ে গেল ডালিয়া, দিনগুলো সোনার খাঁচায় আটকানো গেল না।"
ডালিয়া একগাল হেসে বললো, "আমরা সবাই আসলে সময়ের ফ্রেমে বন্দি। গতির দৌড়ের অভিযাত্রী; অঙ্কের নিয়মে বাঁধা জীবনের ছক; এর থেকে মুক্তি নেই।"
"না মুক্তি আছে। অঙ্কের নিয়মে কখনো জীবনের হিসেব মেলানো উচিৎ নয়। দার্শনিক কান্টের তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নই। তাঁর 'কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য' মানতে আমি নারাজ। জীবনে আবেগ-অনুভূতির মূল্য সময়ের চেয়ে বেশি।"
"তোমার ওরকম দর্শন-সুলভ কথা আমি বুঝি না।"
"আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি, তা শত বছরের হিসেবী জীবনের চেয়ে একরাত্রির মুরলীর সুর ছড়ানো ও জড়ানো অনেক বর্ণিল। জীবনকে রাঙাতে হয় ভাবে, ভাষায়, সুরে ও ছন্দে।"
এ কোন সুর-ছন্দের কথা বলছে তুহিন? ডালিয়া এর কোনো উপসংহার টানতে পারছে না। ছাত্রজীবনে যার মুখে কথাই বেরুতো না, অথচ মুখে এখন কথার খৈ ফুটতে দেখে সে বিস্মিত। আরো অনেক বিস্ময়ই জন্ম দেবে তুহিন। আবেগের গতি কত তীব্র ও অসঙ্কোচ তা সে জীবনে অনেকবার উপলব্ধি করেছে, কিন্তু এখন উপলব্ধি করানোর অপেক্ষায় আছে। একতরফা কথা বলে যাচ্ছে তুহিন, আর ডালিয়া শুনছে...। অনুরক্ত বা বিরক্ত কোনোটাই বুঝা যাচ্ছে না। দুজনকেই রহস্যময়তা ঘিরে ধরেছে। একপর্যায়ে তুহিনের কথায় বিরতি। নিঃস্তব্ধতা। নীরবতা। রহস্যময় নীরবতা। এ নীরবতা খুবই বিরক্তিকর। অবশেষে বড় ভয়ঙ্কর নীরবতা ভাঙলো তুহিনই। ডালিয়া কান পেতে শুনছে। তার সব অনুমান-ধারণাকে উল্টে দিল তুহিন। কোনো প্রেম-ভালোবাসার কথা শোনাতে আসেনি। সত্য প্রকাশের সীমাহীন সাহস বেরিয়ে এল ওর মুখে, "ডালিয়া একটি বিশেষ উদ্দেশে এ অবেলায় তোমার বাসায় এলাম। তুমি আমার ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ। আমি আর আবেগ সংবরণ করতে পারছি না। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি জানি এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াটা অশোভন, কিন্তু আমার সঙ্কোচের বাঁধ ভেঙে গেছে...।"
ডালিয়ার আপাদমস্তকে ভূমিকম্প হল।
খুনের আসামীর মতো তুহিন এখনো বসা। দুজনের কাছেই সেকেন্ড মিনিটে পরিণত হল। সময়ের গতি যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ডালিয়া একটা অনড় পাথরের মতো বসা। যেন পিরামিড যুগের কোনো কঙ্কাল মানবী; নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না।
তুহিন নিজেকে ভাবছে হিটলার - মুসোলিনী। একসময়ে ও উঠে দাঁড়ায়। কোনো বিদায় নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। সোজা সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। ওর দুপায়ে যেন দুটো পাহাড় বেঁধে দিয়েছে কেউ। মাথায় ভর করেছে সাত আসমানের বোঝা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও পিচঢালা রাস্তায় নেমে আসে এবং রিক্সায় চেপে বসে।
হ্যাঁ, জীবন কখনো-কখনো বিষফুল রঙে মাখা।
সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
ফিরোজ মিয়া সরকারি কলেজ
আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
০১৭১১২৩৫৪৮৮