
চলে গেলেন
সংবাদ-সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একটি কবিতা লিখেই
বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া মানুষটি ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই প্রতিবাদ জারি
রেখেছিলেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।
যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি
মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করেছে, তখনই প্রতিবাদী হয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের পর থেকে
প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে দেশে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলম
প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। নিষিদ্ধ বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতিদের রাজনীতিতে
পুনর্বাসন করা হয়েছে; প্রতিবাদী হয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রতিবাদে
কলম ধরেছেন। প্রবাসী সরকারের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি
লিখেছেন অসাধারণ একেকটি কলাম। যুদ্ধের মাঠে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা
জুগিয়েছেন। ক্যাম্পে মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। আর এ সব কিছুই তিনি করেছেন
দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে। দুই চোখজুড়ে
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটি আজ শুধুই স্মৃতি।
অনন্যসাধারণ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইতিহাসের সাক্ষী শুধু নন, সঙ্গীও।
১৯৭১
সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায়
অবতীর্ণ হন। জয়বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভূমিকাও পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর
ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার
চৌধুরী।
তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যেত অসাধারণ এক কথককে। পাঠককে টেনে
নিয়ে যাওয়ার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। শব্দ বয়নের অসামান্য দক্ষতায়,
সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। লেখার
দায়ে নয়, লেখাকে অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন তিনি। পাঠকের প্রতি
দায়বদ্ধতাই ছিল তাঁঁর লেখার অনুপ্রেরণা।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের
প্রথম সোপান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্পর্শ করেছিল তাঁকে। লিখেছিলেন এক অমর
কবিতা। অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে তা আজ গীত হয় বিশ্বজুড়ে একুশের
প্রভাতফেরির গান হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে
এভাবেই নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। বাঙালি চিরদিন স্মরণ করবে এই
গানটি। আর স্মরণ করবে এই গানের গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও। যত দিন
বাঙালি জাতি টিকে থাকবে, একুশের প্রভাতফেরি হবে। প্রভাতফেরিতে গীত হবে
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ’
আজ সারা বিশ্বে গানটি
গাওয়া হয়। বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটি। গাওয়া হয়েছে। বেরিয়েছে
রেকর্ড। বাঙালির জন্য এ এক অনন্য সম্মান। কৃতজ্ঞ জাতি তাঁকে ভুলবে না।
চিরদিন মনে রাখবে তাঁকে।