লেখার কথাজীবনানন্দ দাশ ||
নিজের প্রয়োজন ও মতামত মুখের ভাষায় অন্যের কাছে ব্যক্ত করা প্রায় কোনও স্বাভাবিক লোকের পক্ষেই কঠিন নয়। সে ভাষা ভালো গদ্য হতে পারে; পদ্য, অবিশ্যি, হবে না; পয়ারে বা ছড়ায় কথা ব'লে সংসার-সমাজে চলাফেরার রেওয়াজ অনেক দিন হয় আমাদের দেশ-পৃথিবী থেকেই উঠে গেছে।
কিন্তু চিঠি ছাড়া আর কিছু লিখতে হ'লে অনেকের পক্ষে কলম চালানো মাঝে-মাঝে বেশ কঠিন হয়ে ওঠে; চিঠিও সকলে তরতর করে লিখে যেতে পারেন না। এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা নিজ ভাষায় সামান্য বিষয় নিয়ে চিঠি লিখতে গিয়েও মুশকিলে প'ড়ে যান; কাটাকুটি অদল-বদল ক’রে চিঠির একটা মোটামুটি খসড়া তৈরি হলে ভেবে-চিন্তে আস্তে আস্তে সেটা টুকতে থাকেন। এত মাথা ঘামিয়েও চিঠি তাঁদের চলনসই গদ্য-মাত্র, সাহিত্য নয়; তবে কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই, যা বলবার ভাঙা-ভাঙা ভাষায় পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে। কিন্তু অবাক হয়ে ভাবতে হয়, এ-দু’পাতা লিখতে গিয়ে এত মুশাবিদার কী দরকার ছিল। লেখাও হয়েছে বাংলা'য়-কোনও বিদেশি ভাষায় নয়। দিনরাত যা মুখে বলা হচ্ছে চিঠির ভাষা তার চেয়ে প্রায়ই ভালো নয়, তবুও মুখে বলতে যেটা তিন চার মিনিট লাগত, চিঠিতে দাঁড় করাতে গিয়ে লাগল আধ ঘণ্টা তিন কোয়ার্টার। কলমের নিব খারাপ নয়, কালিও ক্কাথ হয়ে যায় নি। খুব সম্ভব এঁদের লেখার অভ্যেস নেই, লেখা সম্বন্ধে একটা অবোধ্য ভয়ও রয়েছে মনে-মনে, মুখের ভাষা যে অনেক সময় লেখারও ভাষা, কেমন একটা সঙ্কোচ সন্দেহ রয়েছে তাতে।
কিন্তু লেখক নয়-কোনও দিন প্রবন্ধে-গল্পে অব্দি হাত দেয় নি, এমন কোনও-কোনও লোককেও দেখছি কথা বলবার সময় জিভ যে-রকম নড়ে প্রায় সেই সঙ্গেই তাল রেখে কলম চালিয়ে গেছেন। নিজের ভাষায় খুব তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে ফেলা প্রায় বারো আনি লেখাপড়া-জানা মানুষের পক্ষে কঠিন কিছু নয়। টেবিলে বা জলচৌকিতে-নিদেন হাঁটুর ওপর একখানা বই চাপিয়ে, ওপরে চিঠির কাগজ রেখে, পুরুষদের ও স্ত্রীলোকদের লিখতে দেখা যায় এত সহজ দ্রুতত্বে যে, নিবে বেঁধে কাগজ ছিঁড়ে গেলেও পারত, কিন্তু টিকে রয়েছে সব, লেখাও মানানসই হয়েছে, চার-পাঁচ পাতার চিঠিও মিনিট দশ-বারোর ভেতর শেষ হয়ে গেছে।
এঁদের কিছু-কিছু চিঠি সাহিত্য হিসেবে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু এ-লেখকদের নাম নেই বলে তারিখ পেরিয়ে এ-চিঠিগুলো উতরোয় না। হয়তো তাই-ই ভালো। পৃথিবীতে সাহিত্যের স্তূপের বেশি বাড় ঠিক নয়। সেই সূক্ত-সাহিত্যের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশেই যা জমেছে, অনেক-অনেক বাছাই করে তারও দিশা পাওয়া কঠিন। পড়ে কে, খবর রাখে ক' জন, সময় কোথায়।
কোনও কাগজপত্রে লেখা ছাপাবার কথা ভাবতে যান নি, লিখিয়ে হিসেবে সমাজেও পরিচিত নন, এমন অনেক বাঙালিকে ইংরেজিতে তাড়াতাড়ি বড়-বড় চিঠি লিখে ফেলতে দেখেছি। যাঁরা এটা পারেন তাঁরা বিবৃতিও লিখে ফেলতে পারেন-নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে প্রবন্ধও খুব সম্ভব। লেখার দিকে সে-রকম ঝোঁক থাকলে এঁরাও বোধ হয় ভালো ফলাতে পারেন-শুধু আক্ষরিক লেখা নয়, সাহিত্যও। কিন্তু সব দেশেই আজকাল লেখকদের বেশি ভিড়। সেটা এড়িয়ে এঁরা ভালোই আছেন। অন্য কারণে না হোক, এই জন্যেও এঁদের এক-আধখানা চিঠি সাহিত্যের ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখা উচিত।
আমি সে-দিন এক বন্ধুর সঙ্গে বিশেষ কারণে দেখা করতে গিয়েছিলাম সকালবেলা। চিঠি লিখছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে চোখ তুলে বললেন, ‘বসো’। ইনি চিঠি লিখতে আরম্ভ করলে লেখা না শেষ করে মানুষের সঙ্গে যে কথা বলবেন না, সে-দিনও রকমে সকমে সেটা বোঝা গেল; এঁর বরাবরকার এ-প্রকৃতি অজানা ছিল না, অবিশ্যি, আমার। চিঠি লেখার ফাঁকে ফাঁকে এক-আধটা কথা হয়তো চলতে পারে-বেতারের কোডের মত; কিন্তু সে সবের বিশেষ কোনও লক্ষ্য নেই, অর্থ নেই, কথার ভেতরে লেখকের কোনও মনও নেই। কাজেই চুপচাপ ব'সে আঙুল-কলমের তড়বড়ানির দিকে তাকিয়ে রইলাম। লিখছেন ইংরেজিতে-চিঠির একটা পুরো প্যাড কোলে চাপিয়ে; তিনখানা খাম টেবিলের ওপর; প্রথম চিঠিতে হাত দিয়েছেন মাত্র। এক-একখানা চিঠি কত বড় হবে? যত বড়ই হোক-কলম কোনও রেহাই পাচ্ছে না, চাচ্ছেও না। এ-রকম লিখিয়ের হাতে পড়লে কাগজ বিষয় ভাষা ও কলম নিজেদের ভেতর যে-একটা সহজ ত্বরিত মীমাংসা খুঁজে পায়, তা তাৎপর্যেও গভীর হলে তো আর কথাই নেই। তিনখানা চিঠি লেখাই শেষ হল বোধ হয় দশ-বারো পৃষ্ঠা হবে- মিনিট কুড়ি সময়ের মধ্যে। আমি এসেছি ব’লে তাড়া ক’রে নয়। দায়সারা কাজ নেই। দু'টো চিঠি আমাকে পড়তে দিলেন। কাকে লিখেছেন, কিছুই জানা নেই, বাইরের লোক-এ-সব চিঠি আমি কেন পড়ব-ভাবভঙ্গিতে এ-রকম একটা ওজর ফুটিয়ে চিঠি দু'খানা হাত পেতে নিলাম তবু-এত তাড়াতাড়ি এত কী লেখা যায়, দেখবার জন্যে। দিব্যি হাতের লেখা, পরিষ্কার ভাষা, কোথাও কোনও খুঁত-ভুল কিছুই নেই:মনে হল উজ্জ্বলই; না হোক প্রাঞ্জল তো একান্তই: সাহিত্য বলা যেতে পারে;এত চট করে লিখে ফেললেন। ইস্কুল-কলেজে মাস্টারি করেন না, কাগজে ইংরেজি প্রবন্ধও লেখেন না, চিঠিফিটি অব্দি না; কিন্তু এ-চিঠি দু'টোই পত্র-সাহিত্য; দু’ বার ভেবে তিন বার কেটে নয়-কলমে সহজেই এসেছে সব। ইনি ইংরেজি ভলোই জানতেন, জানতাম, কিন্তু সহজ লেখার ক্ষমতা শুধু ভাষাজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না। অনেক বড় সাহিত্যিক সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে লেখেন; এক পাতা চার বার লিখে পাঁচ বারের-বার লেখাটা দাঁড়ায় হয়তো। ফ্লোবেয়া’এর ও টলস্টয়'এর দৃষ্টান্ত আছে। রবীন্দ্রনাথ এর কোনও কোনও পাণ্ডুলিপির কাটকুটে বোঝা যায় লেখক কত ভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু মোটামুটি খুব সম্ভব দ্রুতত্বে লিখতে পারতেন। ইয়েটসই বোধ হয় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : আপনি কী করে এত তাড়াতাড়ি লেখেন, আমি তো লেখার তাগিদ নিয়ে আবছা দেয়ালের দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকি।
আমার বন্ধুটির চিঠি-সাহিত্যে ও রবীন্দ্রনাথ ইয়েটস’এর সাহিত্যে, অবিশ্যি, অনেকখানি তফাত। কিন্তু ছোট-বড় সব লেখকদের ভেতরেই এমন লোক আছেন যাঁরা বলবার কথা বেশ সহজে শিগগিরই গদ্যসাহিত্যে ফলিয়ে তুলতে পারেন, অন্যদের দেরি হয়। আমার মনে হয়, মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে সব শিল্পীরই প্রায়-সর্বদাই অনেকখানি সময়ের প্রয়োজন। সহজ-মোটামুটি সৎ-সাহিত্য কোনও-কোনও লেখক হামেশাই লিখছেন-এক রকম কলম হাতে নিলেই হল।
কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে এঁদের মতন কিংবা মহত্তর হয়েও অন্য এক জাতের লেখক ঝোঁকের মাথায় না লিখে তলিয়ে ভেবে দেখে আস্তে আস্তে লেখেন। মনকে অনেক বেশি ব্যাপ্তিপ্রসাদে ও নিবিষ্টতায় টেনে নিয়ে, আমার মনে হয়, এই ধরনের লেখকদের ভেতর থেকেই ঠিক শিল্পঘন-এমন কি মহান লেখা সৃষ্টি হয়। জীবনকে যাঁরা ভালো করে বুঝে পরিষ্কার তাৎপর্যে দেখাতে পেরেছেন তাঁদের হাতেই বড় সাহিত্য তৈরি হবে। প্রায়ই মানুষের বা শিল্পীর চেতনায় ভাসা-ভাসা স্তরই প্রথমে জেগে ওঠে। যে-লেখক এই চেতনাস্তরকে ভেদ করে আরও স্পষ্ট চৈতন্যে স্থিত হয়ে ঠিক শব্দ, ভাব, ভাষা যথাসম্ভব শিগগির লাভ করতে পারেন, তাঁর শক্তি খুবই অসাধারণ, কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে সে-রকম লেখক খুব কম। কবিতার বেলায়, অবিশ্যি, কবির সমস্ত চৈতন্য এক সঙ্গে কাজ করতে থাকে। কবিতার মোটামুটি একটা নমুনা গ্রথিত ক'রে তুলতে খাঁটি কবির অনেক সময়ই বেশি দেরি হয় না; কিন্তু তবুও কবিতাটিকে পরবর্তী প্রকৃত সিদ্ধির স্তরে পৌঁছিয়ে দিতে হলে সময়েরও দরকার।
গদ্য লেখবার সময় লেখকের চেতনার অতটা গাঢ় মন্থন প্রায়ই হয় না কবিতা লেখবার সময় যেমন হয়। হবার দরকারও নেই, গদ্যের কাজ যুক্তি নিয়েই বেশি। গদ্য-সাহিত্যের সিদ্ধির ও সার্থকতার নানা রকম মান ও বিভিন্নতা রয়েছে। কোনও কোনও লেখকের সাহিত্যকৃত্য তাড়াতাড়ি চলে, সহজেই অনেক রকম সার্থকতা আয়ত্ত ক'রে নিয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু সার্থকতাকে মহৎ সাহিত্যে দাঁড় করাতে হলে গদ্য-শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা ছাড়া প্রায়ই সময়েরও প্রয়োজন। শিক্ষিত লোকের হাতে অল্প সময়ের মধ্যেই দু'খানা চিঠি-সাহিত্য তৈরি হতে পারে বটে, যেমন ইংরেজি নবিশ বন্ধুর কথা বলছিলাম। কিন্তু মন্টেন, স্যার টমাস মুর, বেকন বা পাসকাল' এর সন্দর্ভ অথবা ওয়ালটন'এর কমপ্লিট অ্যাঙ্লার বা ল্যাম'এর লেখা কিংবা ড্রাইডেন বা আধুনিক কালের এলিয়ট বা বাংলা আলোচনা-সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী এবং আগেকার ও এখনকার বড় লেখকদের গদ্য-সাহিত্যের সিদ্ধি পেতে হলে তার চেয়ে বিভিন্ন অন্য এক ধরনের লেখার ও লেখকের প্রয়োজন। সে-সব লেখাও প্রায়-প্রতি পাতায়ই লেখকের মননে বারংবার আলোচ্য; এ ধরনের লেখা প্রায়ই ঘড়ি ধরে আগলানো কঠিন; বেশি সময় লাগে।
অন্য নানা রকম সার্থক জিনিসের মতন লেখারও চর্চা রাখলে, অবিশ্যি, লেখা ক্রমেই সহজ হয়ে আসে-খুব সম্ভব অনেক কিছু বিষয়েই ঠিক ভাবে লেখা যায়- তাড়াতাড়িও লেখা যায় হয়তো। কিন্তু চর্চা রাখলেও সব লেখকের লেখাই সাহিত্য হয় না-সৎ সাহিত্য তো আরও ওপরের জিনিস। চর্চা বা সাধনা ছাড়াও লেখকের পক্ষে উঁচু-দরের মননের দরকার-লেখায় বিশেষ সিদ্ধি পেতে হলে।
বিজ্ঞানের বা মানুষের যুক্তিপথের বাইরে যা রয়েছে তা অসত্য নয়-যুক্তির আয়ত্তে এখন পর্যন্ত আনতে পারা যাচ্ছে না বলে তাকে সত্য ব'লেও গ্রাহ্য করতে পারা যাচ্ছে না। বাকি-সব যুক্তির কাছে সত্য হলে সত্য। অনেকে মানুষের যুক্তির মূল্য মানেন না; তাঁদের মতে বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে জগতের ব্যাপার বোঝা যায় না, বিজ্ঞানীসুলভ বোধি দিয়েও না; আরও যুক্তিনিঃসক্ত হতে হবে। খুব সম্ভব এমন এক ধ্যানপ্রস্থানে পৌঁছতে হবে যেখানে বুদ্ধি, যুক্তি কিছু নয়। এঁদের সিদ্ধান্ত কতখানি সত্য জানবার সুযোগ এখন পর্যন্ত হয়নি আমার। যুক্তির পথ লঙ্ঘন করবার কোনও কারণ আছে কি-না অনুভব করতে পারছি না। তবে এঁদের একটা কথা ভাববার মত। এঁরা বলেন, শুদ্ধ বিশ্বাস থাকা দরকার। যে-সব জিনিস সত্য ও পরমার্থ ব’লে এঁরা বিশ্বাস করেন, সে-বিশ্বাসে এঁদের এত দাবি যে-যুক্তির ওপরও প্রায় কোনও যুক্তিবাদীরই খুব সম্ভব ততটা কিছু নেই। যুক্তির ওপর শুদ্ধ আস্থা থাকা দরকার। কিন্তু যুক্তির অজুহাতে বিজ্ঞানের বা মনোবিজ্ঞানের অজ্ঞাত জিনিসগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। মন ও নির্মন সম্বন্ধে আরও তথ্য পরিষ্কার ভাবে জানা দরকার। কবিতা লেখার সময় চৈতন্য যে-রকম ভাবে উদ্বুদ্ধ হলে গোটা কবিতাটিকেই প্রায় ঠিক মতন অবস্থায় তাড়াতাড়ি লাভ করা যায়, উদ্বোধনে বিপর্যয় ঘটলে, বা বাধা পেলে, মনের সক্রিয় অংশগুলো অনেক চেষ্টা ক’রেও-যে বিশেষ কিছুই ক’রে উঠতে পারে না, তার কারণ বিজ্ঞান (মনের) পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে পারবে হয়তো এক-দিন; ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, এমন কিছু অজ্ঞেয় নয়-যদিও অনেকের ধারণা ব্রহ্মস্বাদগভীর সাহিত্য সৃষ্টি করবার তাগিদ ও শক্তি মহাশূন্যের ভেতর থেকে আসে। এ-মত খণ্ডন বা সমর্থন করবার কোনও দরকার নেই। সাহিত্যিকের মন অন্য মানুষের মনের বাইরের কিছু বস্তু নয়, সেই মনেরই এক ধরনের সিদ্ধি লাভ, জীবন নিয়েই তার কাজ, অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দুর ও ভাবনাঘন যুক্তির আশ্রয়ে।
পাণ্ডুলিপির খাতা থেকে, ১৯৫২; প্রকাশিত ময়ূখ, আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৬৫
ভার্জিনিয়া উল্ফঃ আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অগ্রগামী নারী সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া
উলফের জন্ম ১৮৮২ সালে। লণ্ডন শহরে। তাঁর বাবা স্টেফেন লেসলি ছিলেন একজন
প্রখ্যাত ভিক্টোরিয়ান সমালোচক, দার্শনিক ও জীবনীকার। ভার্জিনিয়ার পরিবার
ছিলো জ্ঞানী গুণী মানুষের সমাগম স্থল। বাবার লাইব্রেরি ছিল সুবিশাল, সেখানে
বসে তিনি পড়ালেখা করেতেন। বাবার পরিচয়ের সুবাদে সে যুগের বিখ্যাত সব
মানুষের সাথে উলফের সাক্ষাত লাভের সুযোগ ঘটতো নিয়মিত। এই লাইব্রেরিতে বসেই
তিনি গ্রীক শিখেন ওয়াল্টার পেটারের বোনেরর কাছে।
১৯০৪ সালে
বাবার মৃত্যুর পর ভার্জিনিয়া ব্লুমসবেরিতে গিয়ে বসবাস করেন। সেখানে
অবস্থানকালে ব্লুমসবেরি গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। ব্লুমসেবেরি ছিল সে
সময়ের সবচেয়ে অগ্রগামী সাহিত্যিকদের একটা দল। ই এম ফস্টার ও লিটন
স্ট্র্যার্চি ছিলেন সে দলের অন্যতম সদস্য। একই দলের সাথে সম্পৃক্ত লিওনার্ড
উলফের সাথে ভার্জিনিয়া প্রণয়াবদ্ধ হন পরবর্তীতে ।
নিজের
চারপাশে জ্ঞানী গুণী মানুষের সাহচর্য পেয়ে ভার্জিনিয়া লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ
হন। বলা যায় তাঁর লেখালেখিতে আসাটা অনেকটা সহজাত এবং স্বাভাবিক । ইংরেজ
মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত লোকজনের কাছাকাছি থাকতে পারাটা ছিল ভার্জিনিয়ার
লেখালেখির ক্ষেত্রে সহায়ক একটা ফ্যাক্টর। মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের জীবনের
নানা সংকট ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
প্রথম দুইটা উপন্যাস লেখার
পর তিনি নিজস্ব একটা ন্যারেটীভ কৌশল নির্মাণ করেন। যাকে ইংরেজিতে বলা হয়
ঝঃৎবধস ড়ভ ঈড়হংপরড়ঁংহবংং । উপন্যাস লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি স্বাতন্ত্র্য
একটা গদ্যরীতিও নির্মাণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো মিসেস
ড্যালোওয়ে, টু দী লাইটহাউজ, দী ওয়েভস, এবং বিটুইন দি এক্টস। উপন্যাস ছাড়াও
ভার্জিনিয়া উল্ফ রচনা করেছিলেন বিখ্যাত কিছু প্রবন্ধ। " নারীর জন্য কর্ম", "
শেক্সপিয়রের বোন" এবং " নিজের জন্য একটা কক্ষ' ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য
প্রবন্ধ।
আধুনিক মানুষের জীবন সংকট, লেখালেখির ক্ষেত্রে পুরুষ
লেখকের প্রভাবের কারণে নারী লেখকদের আলাদা রাইটিং কৌশল না দাঁড় হওয়া,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে সৃষ্ট সংকট, ইংরেজ সমাজের অবক্ষয়
ইত্যাদি বিষয় ছিলো তাঁর লেখার মূল প্রতিপাদ্য। অসুস্থতা ছিলো তাঁর
নিত্যসঙ্গী। পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতা, মৃত্যু তাঁকে মানসিকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল মারাত্মকভাবে।
উল্ফের মা-বা দুইজনেরই আগে
একবার করে বিয়ে হয়েছিল। উভয় পক্ষের সন্তান-সন্ততিও ছিল। পারিবারিকভাবে
তাঁরা একটা সংকটের মধ্যে যাচ্ছিলেন। ভার্জিনিয়া উল্ফের জীবনেও মানসিক সংকট
এসেছিল বারবার। ১৮৯৫ সালে তাঁর মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুতে উল্ফ ভেঙ্গে
পড়েন। এই বড়সড় ধাক্কা তাঁকে সারাজীবন ভোগায়। ১৯০৪সালে উল্ফের এক বোন মারা
যান। উল্ফ আবারো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এতই মুষড়ে পড়েন যে
আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেন। বিয়ের পরপর আবারো মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
দ্বিতীয়বারের মতো আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
অসুস্থতা নিয়ে তাঁর
গুরুত্বপূর্ণ লেখা 'ঙহ ইবরহম ওষষ' পড়লে বুঝা নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে
কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে ছিলেন উল্ফ। ১৯৪১সালে আরো একবার মানসিকভাবে অসুস্থ
হয়ে পড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পকেটে পাথর ভরে, আউসে নদীতে ডুব দিয়ে তিনি
আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করার আগে তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে লিখে যান মাত্র
কয়েক লাইনের একটি পত্র যাকে বর্তমান যুগে সুইসাইড নোট হিসেবে গণ্য করা হয়।
পত্রে ভার্জিনিয়া কোন অভিযোগ করেননি কারো বিরুদ্ধে । স্বামীর প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশই মূল প্রতিপাদ্য ছিল এ পত্রের।
পেখম খোলে দাঁড়াবে তুমিখলিলুর রাহমান শুভ্র ।।
সঙ্গম থেকেই প্রাণের সংগ্রাম। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু চেকে চেকে জীবনের অভিসার। মৃত্যু সত্য। তারচে' অধিক সত্য আমি।এক চরিত্রে আস্থাহীন আমি মৃত্যুতেই প্রবহমান ছন্দ।
কত হুলোস্থুল-ন্যুব্জ মিনতি;প্রণয়ে হাইফেন বিরতি কি দিয়েছে জীবন-মরণ?
মৃত্যু নিটোল-গম্ভীর অব্যয় সুন্দর।
সুন্দরের জন্যই আমার রগচটা প্রেম?
আসমুদ্রহিমাচল গোলাপের কোরাস
আমি যখন মাটিতে বৃক্ষের বৃদ্ধি ফুলের সৌরভ
আমি যখন নদীতে ঢেউ কিংবা কূল
আমি যখন ঘাসে চোখ ফেরেনা সবুজ
তখন আমার জীবনের আনন্দ যজ্ঞে
পেখম খোলে দাঁড়াবে তুমি
তখন তোমার অজান্তেই তোমাকে ছোঁব
এক চরিত্রে আস্থাহীন আমি মৃত্যুতেই অমর হবো
বিভ্রান্ত অথবা বিব্রত
খলিলুর রাহমান শুভ্র ।।
সুখগুলো অবিকল তোমার মতো
চেতনানাশক বেদনা জাগানিয়া
অবিশ্বাস্য চড়া মূল্যে নেই মরীচিকা।
শোচনীয় পরাজয় মেনে হাসে, অতিসরলীকরণ বিপ্লব।জলে কুমিরের সাথে খেলতে নামে নাদুসনুদুস প্রেম। অখণ্ড সুখের প্রতিশ্রুতির নোট ভাঙিয়ে বুনোকুসুম থেঁতলে দেয় নাগরচরণ।
যেটুকু তোমাকে পাই সংকেতে সংলাপে
রক্তে ফেনা তুলে মহামারী। চর্বিশূন্য
দেহে মৃত্যু নাচে মুষলধারায়। নিঃশ্বাস দ্রুত হলে ট্যাবুতে জেগে ওঠে শুদ্ধতম নির্বাণ;মদ্যপ হুলিয়া।
সুখগুলো অবিকল তোমার মতো
চেতনানাশক বেদনা জাগানিয়া
আরিফুল হাসানের : নজরুল সম্পর্কে তিনটি কবিতা আগুনের বলয়একরাশ অন্ধকার ছেয়ে এলে পৃথিবীর পথে
মানুষ জেগেছে খুব, ইতিহাস এই কথা বলে
পরাজিত দিনরাত উৎরে গেছে সাগরের ঢেউ
মরুচারী পৌঁছে গেছে অভিষ্ট উদ্যানে।
এ কথা সত্য যেনো হয়, যেনো এই কথা
মানুষের প্রাণে প্রাণে বারবার উঁকি দিয়ে নজরুল
আগুনের বলয় এক ঘিরে রাখে চাক্ষুষ অন্ধকার হতে
যেনো জীবনের তিমির, তিমিরঘেরা অনির্বাণ এক শিখা।
প্রান্তরজনের মৌনসাধতারপর, অনুরূপভাবে নজরুল, আমাদের নজরুল
বাগানের স্ফিত সুরভির
শিশিরমাখা কোমল রোদের ভোরে, নাবিকের চোখে
আরবের সাগর যখন দুলে উঠে সাইক্লোন নিয়ে
জলের মাছেরা নিশ্চুপ, চুপ চুপ
অন্ধকার আর তামাদের দেশে বর্গি এলে, নজরুল
খুব একা একটি বাঁশরী দ্রোহ-সুর।
রণাঙ্গনের প্রেমিকএকটি চাঁদকে দেখলাম ঝড়ের রাতে অন্ধকার ঠেলে
মেঘের আস্তরণ ভেদ করে, ছিড়ে বিদ্যুৎ ঝলক
কালো গহ্বরের তিমিরবিনাশী এক ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে
আপন অলংকারে জেগে উঠে জৈষ্ঠের প্রহরে।
তখন, একটি বুলবুলি, একটি পাপিয়া
আদল খুলে পাতার মর্মর আর নক্ষত্রের সীমারেখা ছেড়ে
শেষ প্রেমে এঁকে দেয় একটি গোলাপ;
মৃত্যু-যুদ্ধের গণকবরে, সে ফুল আজ সুরভিত নজরুল।