
জুলফিকার নিউটন ||
ক্রান্তদর্শী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা স্বচ্ছ, একাগ্র, স্থির। এই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সরে যাননি। এখানেই তাঁর চারিত্রিক সততা। খুব সম্ভব এখন কেউ সৎ হতে চায় না, চায় সফল হতে। গাফ্ফার চৌধুরী এ ক্ষেত্রে ভিন্ন, হয় তো সবার চেয়ে ভিন্ন। গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম থেকেই তাঁর কাজের ভিতর মগ্ন, তাঁর আশার ভিতর অবিচল। তাঁর কাজ এবং তাঁর আশাকে মৃত্যু ও নোংরামি ঘিরে ধরতে পারেনি। মৃত্যুর ভয় ও আরাম আয়েসের লোভ তাঁকে আপোসের দিকে ঠেলে দেয়নি। তাঁর আশা বাংলাদেশ কোনো একদিন সৎ হবে। নিয়তি তাঁর হাত ধরে এই দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করেছে, বাংলাদেশের প্রতি অবিচল থাকার দায়িত্ব। তাঁর নিয়তি, তাঁর কাজ, তাঁর চিন্তা, তাঁর সংস্কৃতির ভিত্তি এখানেই, তিনি যেখানেই থাকুন বাংলাদেশের চিন্তা থেকে দূরে সরে যেতে পারেন না। গাফ্ফার চৌধুরী তার চারপাশ থেকেই একটার পর একটা দেয়াল ভেঙে চলেছেন : তাঁর চেষ্টা ছত্রখান জীবনকে ঐক্যবদ্ধ করা। কখনো মনে হয় গাফ্ফার চৌধুরীর চারপাশে অনেক লোক, কখনো মনে হয় গাফ্ফার চৌধুরী একেবারেই একা। তার কারণ তিনি নিজের মতো জীবনকে দেখেন এবং বোঝার চেষ্টা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দেখা এবং বোঝা অনেকের সঙ্গে মেলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে মেলে না। তিনি দুঃসাহসী ও নিঃসঙ্গ, তিনি সাহসী ও সবার সঙ্গে লগ্ন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভিসিডি : পলাশী থেকে ধানম-ি দেখতে দেখতে আমার মনে এসব কথাই জেগেছে। গাফ্ফার চৌধুরীর ইতিহাসের কল্পনা ব্যবহার করেছেন বাস্তব বাংলাদেশের আখ্যান ও ঘটনা বোঝার জন্য। তাঁর কাছে বাংলার অর্থ হচ্ছে : স্বাধীনতা ও স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের ইতিহাস। স্বাধীনতার পক্ষে অবিরাম লড়াই করেছেন নবাবী বাংলার সিরাজউদ্দৌলা থেকে কলোনি ও কলোনিউত্তর বাংলার বঙ্গবন্ধু। তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন সেনাপতিরা : মীর জাফর থেকে মীর কাশিমরা, ব্যবসায়ীরা : উর্মিচাদরা বিদেশী বাণিজ্যিক স্বার্থের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টরা : ক্লাইভরা; তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিকরা ; খন্দকার মোশতাকরা; সেনাপতিরা : জিয়াউর রহমানরা, ব্যবসায়ী-আমলারা : মাহবুব আলম চাষীরা, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা : মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টাররা। এভাবেই নবাবী বাংলার স্বাধীনতার লড়াই মিলে যায় বর্তমান বাংলার স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্যে। স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্রকারীরা : স্বাধীনতার পক্ষে আছেন সিরাজউদ্দৌলা ও দেশের সাধারণ
মানুষ, স্বাধীনতার পক্ষে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও দেশের সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতার বিপক্ষে আছে সর্বত্র ষড়যন্ত্রকারীরা : রাজনীতিক-সেনাপতিরা : মীর জাফর, মীর কাশিমরা, জিয়াউর রহমানরা, মন্ত্রী, কূটনীতিকরা : মীর জাফররা, মোশতাকরা, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিনিধিরা : ক্লাইভরা, বোস্টাররা। সেজন্য দায়বদ্ধহীন কূটনীতিক, সেনাপতি, ব্যবসায়ী, আমলা এবং বিদেশী শক্তির সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধিদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, এরা দায়বদ্ধহীন ষড়যন্ত্রকারী, এরা ক্ষমতা বাদে কোনো কিছু বোঝে না।
মীর জাফর থেকে মীর কাশিম থেকে জিয়াউর রহমান থেকে খন্দকার মোশতাক পর্যন্ত সবাই ক্ষমতার জন্য সবকিছু করতে পারে। আত্মবিক্রয়কারী, ক্ষমতালোভী মানুষরা সবকিছু করতে পারে : ষড়যন্ত্র থেকে হত্যা পর্যন্ত, যার শুরু ষড়যন্ত্র থেকে তার শেষ রক্তাক্ত হত্যায়। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর সত্যকে উন্মোচিত করেছেন গাফ্ফার চৌধুরী, সিরাজউদ্দৌলা-বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়ে। এভাবেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা তৈরি হয়: সিরাজউদ্দৌলা মিশে যান বঙ্গবন্ধুর মধ্যে; মীর জাফর মিলে যায় খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমানের মধ্যে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আরেকটি সত্য উন্মোচিত করেন : যাদের হাতে তরবারি আছে, যাদের হাতে বন্দুক আছে তাদের বিশ্বাস করতে নেই, সশস্ত্র ব্যক্তি সবকিছু করতে পারে। যেমন আমেরিকানরা করছে ইরাকে, ইজরায়েলিয়া করছে ফিলিস্তিনে, যেমন কৃষকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নিম্নআয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ-র্যাব- গোয়েন্দাদের পার্টি কাতারদের। ষড়যন্ত্রকারীদের কবর কোথায় মুর্শিদাবাদের মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়, ষড়যন্ত্রকারীদের কবর কোথায়-ঢাকার মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। এসব কবর ইতিহাসের এক ধারাবাহিকতা, ধিক্কারের ধারাবাহিকতা, এসব কবরে শুয়ে আছে অপরাধীরা।
গাফ্ফার চৌধুরী এই কাজটাই করেছেন। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে, কোনো অপরাধের মাপ নেই। তারা অভিশপ্ত। গাফ্ফার চৌধুরী অভিশপ্তদের নিয়ে নাটক লিখেছেন স্বাধীনতার এক সুদীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য, যেখানে তাদের মাথায় মাথায় সিরাজের নৌকা বয়ে যায়, যেখানে নৌকার ভিতরে লণ্ঠনের আলো ফেলে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতের দিকে বয়ে যায়, মানুষ জাগে, সর্বত্র জাগে, সবসময় জাগে, তারা সঙ্গীত রচনা করে স্বাধীনতার। গাফ্ফার চৌধুরীর এই কাজটি নাটক ও যাত্রার কোলাহল, সিনেমা ও। টেলিভিশনের মধ্যবর্তী অংশ : শিল্পের একটা দিক তিনি তুলে ধরেছেন। একটা রাস্তা তিনি তুলে ধরেছেন : স্বল্প বাজেটের ভিতরে কি করে নাটকের সঙ্গে যাত্রার, সিনেমার সঙ্গে টেলিভিশনের মেলবন্ধন করা যায়। আবার এখানে তিনি একত্র করেছেন কবিতা, ইতিহাস, কল্পনাকে, এক সঙ্গে, তিনি এই যুক্ততার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেছেন মানুষ নামক সন্তকে এবং মানুষ নামক জানোয়ারকে। এই অবস্থান থেকে আমরা কতদূর যেতে পেরেছি? আমরা এবং আমরা।
নবাবী বাংলার ষড়যন্ত্রকারী, মীর জাফর-জগৎ শেঠরা স্বাধীন বাংলাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ব্রিটিশ বাংলায় পর্যবসিত করে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর বাংলার ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমানরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ইতিহাসের অন্তর্গত মুসলিম বাংলায় পর্যবসিত করে। গাফ্ফার চৌধুরীর নাটকে ইতিহাস উৎসারিত কল্পনার বিস্তার এভাবেই ঘটেছে। এ শুধু ব্যক্তিকে হত্যা নয়, স্বাধীনতাকে হত্যা, মানবিকতাকে লক্রঘন : এ দুই হত্যার মধ্যে টেররিস্টিক দূরস্পর্শিতা রয়েছে, গাফ্ফার চৌধুরী আমাদের বুঝিয়ে দেন। সে জন্য অতীত ও বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়। আমরা ইতিহাসের মধ্যে হাঁটতে থাকি নিজেদের মুক্তির জন্য। মুক্তি আমাদের লক্ষ্য, মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকার, সে অধিকার অর্জন বাদে ইতিহাসের এই দুই হত্যার বীভৎসতা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়।
হে ক্রান্তদর্শী, যে যাই বলুক, রাশি রাশি লেখক
বিস্তৃত হবে ভাবীকালে, অথচ আপনার নাম নিশ্চিত ঘুরবে
গুণীজন আর জনতার মুখে যুগে যুগে।
এই সত্য উজ্জ্বল আপনার কাছে,
বুঝি তাই আপনি প্রায়শই চালান কলম
সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে।
ক্রান্তদর্শী, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মৃতিপটে
রাখবে সাজিয়ে ভালোবেসে,
শ্রদ্ধাভরে আপনার অক্ষয় নাম,
গাইবে আপনার গান যুগযুগান্তর-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?”