
স্মরণ .................................
খ্যাতিমান আবৃত্তি শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান আরিফ
চিঠি। রুবেল কুদ্দুসের ডাইরিতে ভাঁজ করা পৃথক পাতায় স্থান এবং সময়ের কোন উল্লেখ নেই। হাসান আরিফ উল্লেখ করেননি। কাগজের ভাঁজে সময়ের দাগ । দাগ দেখে চিনে নিতে হয় কবেকার টান। কাগজের বাম পাশের উপরের দিক অভিমানে মুখগুঁজে নিরব । নীল কালিতে লেখা, ‘প্রিয় কুদ্দুস’। আবৃত্তি শিল্পী রুবেল কেন যে এই বেদন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি কি জানতেন এই চিঠির শেষ বাক্যের মত জীবনের হিসেব মিলে যাবে। আর নগর জীবনের নিতল সংজ্ঞায় হাসান আরিফ আমাদের যেন সতর্ক করলেন। কিন্তু নগরকে তিনি ত্যাগ করেননি। নগরও তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর বন্ধন মুক্তির ক্ষুদ্র সময়কে আমরা স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধ্যায় গভীর ভালোবাসায়।

প্রিয় কুদ্দুস/
শুভেচ্ছা নিস।
আশাকরি জীবনের নতুন পথের বাঁকে ভীষণ
আলোড়নে দিন কাটছে।
ঢাকা আর কুমিল্লায় বিস্তর ব্যবধান।
এখানে মানুষ কোলাহলে লুকিয়ে
বেড়াতে পারে, আর নিজের মধ্যে
নিজে সবচেয়ে সজাগ।
এখানে কারো জীবনের গভীরে কেউ প্রবেশ
করে না,এখানে নিছক কথার ছলে
পথ চলার ক্লান্তি দূর করে অথবা
মন থেকে নিরাপদ দূর থেকে শরীর
শরীরময় উষ্ণতা বিলায়।
এখানে পাশের দরজা অপরিচিত থাকে।
এখানে পাশের জন বলে কেউ থাকে না।
এখানে মানুষের ঠিকানা পাড়ায় পাড়ায়
তবু এখানে কোন পড়শি বা প্রতিবেশি নেই।
এখানে জীবন নেই, শুধু জীবনের খসড়া।
যদি পারিস স্বপ্নগুলো রেখে আসিস
মায়ের আঁচলে। সপ্তাহান্তে সজীব দেখতে
পাবি, কারণ তিনি তা যত্ন করে আগলে রাখবেন
পুত্র আদলে।
হাসান আরিফ
হাসিমুখের সদা বিনয়ী আরিফ ভাইরুবেল কুদ্দুস ||
বাংলাদেশের খ্যাতিমান আবৃত্তি শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান আরিফ ১৯৬৫ সালের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরের গোবিন্দপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেণ। ওনার দাদার বাড়ি নবীনগর। মা রওশন আরা, বাবা আবুল ফজল মো: মফিজুল হক। শৈশব কৈশোর কেেেটছে প্রিয় শহর কুমিল্লায়।
১৯৮৩ সালে ঢাকায় স্বরিত আবৃত্তিচক্রের মাধ্যমে আবৃত্তি’র সাংগঠনিক চর্চা শুরু করেন। প্রয়াত আবৃত্তি শিল্পী কামরুল হাসান মঞ্জু, আবৃত্তি শিল্পী লায়লা আফরোজ সহ স্বরিত’র প্রতিষ্ঠা সদস্যদের অনেকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাসান আরিফ।
৮৮ এবং৮৯ সাল ছিল রাজনীতির উত্তাল সময়, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়, তখন আমরা যারা অনার্সে পড়ি, সে সময় আমরা ক’জন তরুণ অভিনয় নাট্যগ্রাহী মঞ্চকর্মী কুমিল্লায় অভিনয়ের মহড়া করতে গিয়ে টের পেলাম সংলাপ উচ্চারণে আঞ্চলিক প্রভাব। ছেলে বেলা থেকে কবিতা আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। এখনো বুঝে বা না বুঝে নতুন কবিতা পেলে পড়তে বা আবৃত্তি করতে চেষ্টা করি।
উচ্চারণের কথা বলছিলাম; তখন নাট্যদলের ৬/৭ জন মিলে ‘ স্বকাল ’ নামে শুধুমাত্র আবৃত্তির যৌথ চর্চা শুরু করি। দলীয় পরিবেশনা নিয়ে, পূবালী চত্ত্বর, টাউন হল, ভিক্টোরিয়া কলেজ মিলনায়তন, পার্কের জামতলায় নানান আয়োজনে মনের আনন্দে অংশগ্রহণ করি। তখন একদিন হাসান আরিফ কুমিল্লায় এলেন। তাঁর শৈশব কৈশোরের নানার বাড়ি, গোবিন্দপুর কাজী বাড়ি। তিনি আমাদের খুঁজে বের করলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি আবৃত্তি কর্মের খোঁজ খবর নিলেন। গুরু হিসেবে তিনিই প্রথম জানালেন, কবিতা আবৃত্তি যে কোন আন্দোলনের জন্য একটি শক্তিশালী ভাষা। শিল্পবোধের একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের সান্নিধ্যে সাগ্নিক ও শৈল্পিক দীক্ষার শুরু অনেকের সঙ্গে আমারও তখন থেকেই। শিল্পের এ যাত্রাপথে আন্তরিক সম্পর্কে নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় তিনি হয়ে উঠলেন অভিভাবক। একজন হাসান আরিফ সকল ভক্তের নিকট অতি আপন হয়ে উঠেন।
হাসান আরিফ শহীদ জননী জাহানার ইমামের নেতৃত্বে যোদ্ধাপরাধ বিচার,স্বৈরাচার বিরোধী গণ অভ্যুত্থানের একটি গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের আবৃত্তি দলগুলোর কেন্দ্রীয় ফেডারেশন হিসেবে সমন্বয় পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন- বাংলাদেশ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ছিলেন গ্রুফ থিয়েটার ফেডারেশনের সাথে। সারাদেশে প্রায় চার শতাধিক আবৃত্তি সংগঠনের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন হিসেবে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, আবৃত্তিকে একটি স্বীকৃত শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, এই সকল সংগঠনে হাসান অরিফ নির্মোহ নিরলস পরিশ্রম করেছেন। হাসান আরিফ দেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
একাধারে সংগঠক, নির্দেশক, প্রশিক্ষক ও আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। হাসিমুখের সদা বিনয়ী, সহজ সরল একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেন তাঁর প্রমান হাসান আরিফ, প্রমান তাঁর শিল্পবোধ রুচিবোধ। স্বচ্চ উন্নত উদার চিন্তক হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও হাসান আরিফের বিশেষ অবদান রয়েছে।
প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ হাসান আরিফের কণ্ঠে ছিল নান্দনিক যাদু। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহিত হয়ে শুনতাম তাঁর কথা তাঁর আবৃত্তি। আড্ডায় ছিলেন মধ্যমনি সপ্রতিভ প্রাণবন্ত । তাঁর মননে ছিল গভীর দেশ প্রেম। চেতনায় ছিল ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ। যার নিরলস পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছে দেশের সংস্কৃতিমনস্ক প্রজন্ম।
অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ বাতিলের দাবিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও গ্রুফ থিয়েটার ফেডারেশন আন্দোলন করে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলেও এই আইনের প্রয়োগ হয়। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করে। সামগ্রিক এ কর্মযজ্ঞে হাসান আরিফের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক সংগঠন উষসী পরিষদের আবৃত্তি বিভাগ রাজপথে সরব ছিল। ৯২ সালে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কবি নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। সে উৎসবে আমরা একদল তরুণ-তরুণী কবিতার দলীয় পরিবেশনায় অংশ নিয়ে ছিলাম। সেই গতি ও স্পৃহায় জন্ম নিলো আবৃত্তি সংসদ কুমিল্লা। ৯৩ সালে গঠিত হয় কুমিল্লা আবৃত্তি মঞ্চ। ৯৪ সালে যাত্রা করে মৃত্তিকা আবৃত্তি সংগঠন ও তীর্থ আবৃত্তি সংসদ। কুমিল্লায় সাংগঠনিকভাবে দলীয় আবৃত্তি চর্চায় উল্লেখ্য চারটি সংগঠনের ভূমিকা আজও স্মরণীয় উজ্জ্বল।
আমাদের আবৃত্তির গুরু একজন হাসান আরিফের কাছ থেকে যা শিখেছি যা পেয়েছি তা লিখে শেষ করা যাবে না। এসব কর্মকাণ্ডে কুমিল্লার যারা সেই সময় থেকে আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে ছিলেন, তাদের কথা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করা গেল না। আমার প্রিয় বন্ধু আবৃত্তি শিল্পী কাজী মাহতাব সুমন সে সময় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আঞ্চলিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেলে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনি নোয়াখালিসহ বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের অনেকগুলো আবৃত্তি সংগঠনের বিস্তার ঘটে। এই অতি কথনের মূল কারণ হাসান আরিফ। যার নেপথ্যে অন্যান্য অনেক গুনী শিল্পী ও প্রশিক্ষকের অন্যতম ছিলেন আমাদের আরিফ ভাই, কুমিল্লার গর্বিত কৃতি সন্তান।
দেশের আবৃত্তি শিল্পে অনন্য ভূমিকা রাখার জন্য ২০২০ সালে তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি হসপিটালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে প্রায় ৪ মাস আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। ১লা এপ্রিল ২০২২ শুক্রবার দুপুর ২টায় রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেসালাইজড হাসপতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাল্টি অরগান ফেইলিওরে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
হাসান আরিফ মরদেহ দান করে গেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য।
আমার পেশাগত জীবনেও আরিফ ভাইকে নানাভাবে পেয়েছি। প্রযোজক হিসেবে প্রাইভেট এফ রেডিও টুডে, দেশ টেলিভিশনে যখন কাজ করি, তখন বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হয়ে এসেছেন, আবৃত্তি করেছেন। এছাড়াও কবি তারিক সুজাতের আই ইনফো মিডিয়ার রেকর্ডিং ষ্টুডিওতে কবিতা-গল্প- গ্রন্থ থেকে আরিফ ভাইয়ের পছন্দের অনেক কিছু রেকর্ড করেছেন।
অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল।
একজন অনুজ হিসেবে এসবের সাক্ষি হয়ে রইলাম।
আরিফ ভাই কাঁধে হাত রেখে কথা বলতেনমনজুরুল আজিম পলাশ ||
ও চির প্রণম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও
প্রথমে পোড়াও ওই পা দুটি
যা চলচ্ছক্তিহীন ।
তারপর যে হাতে আজ প্রেম পরিচ্ছন্নতা কিছু নেই
এখন বাহুর ফাঁদে ফুলের বর
এখন কাঁধের পরে দায়িত্বহীনতা
ওদের পুড়িয়ে
এসো , এসো হৃদয়ের কাছে
দাঁড়াও লহমা।
তারপর ,ধ্বংস করো
সত্য মিথ্যা রঙ্গে
শীতে স্তব্ধ জ্ঞান পীঠ ।
রক্ষা করো, রক্ষা করো দুটি চোখ
হয়ত তাদের এখনো দেখার কিছু কিছু বাকী আছে ।
অশ্রুপাত শেষ হলে , নষ্ট করো আঁখি ।
কুঁড়িয়ো না ফুলো মালা
স্তবক সুগন্ধে আলু থালু প্রিয়কর স্পর্শ
ওর গায়ে লেগে আছে
গঙ্গা জ্বলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত , স্বেচ্ছাচারী
ও চির প্রণম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও ।
( শক্তি চট্যোপাধ্যায় )
১৯৮৩। আমি কেবল কুমিল্লা ভিক্টরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শাখায় প্রবেশ করেছি। আমি মানে আমরা। এক ঝাঁক বন্ধু। ক্লাশ করা ছাড়া আর বাকি সবকিছুই আমরা করি। দিনে মিছিল, দেয়ালিকা, মাসুদ রানা, পাঠচক্র আর রাতে নির্জন ধর্মসাগরে সীমাহীন আড্ডা। আমাদের সেই তুমুল বৈপ্লবিক জীবনে অনিবার্যভাবেই কুমিল্লার সমমনা অগ্রজ হাসান আরিফের প্রবেশ। বয়সে কিছুটা বড় বলে আমরা ‘আরিফ ভাই’ বলতাম। আরিফ ভাই অনায়াস আন্তরিকতায় ‘তুই’ আর আমাদের কাঁধে হাত রেখে কথা বলেই যেতেন। তাঁর ঠোঁট-মুখ থেকে কখনোই মৃদু হাসিটি উধাও হতোনা, চোখ দুটো সর্বদা স্বপ্নে জ্বলজ্বল। ঝাঁকড়া চুলের এইরকম উজ্জ্বল একজন মানুষ আমি এই জীবনে দ্বিতীয় কাউকে আর খুঁজে পাবোনা। কাঁধে হাত রেখেও যে বিশ্বাস সংক্রমিত করা যায় সেটাও আরিফ ভাই আমাদের শিখিয়েছিলেন।
উচ্চমাধ্যমিক সময়টায় (১৯৮৩-১৯৮৫) আমরা কুমিল্লা আর আরিফ ভাই কুমিল্লা-ঢাকা করেছেন। কুমিল্লায় কত কিছু যে করেছি আমরা একত্রে। মনে আছে, টাউন হলের মাঠ উপচে উঠেছিল একটি আবৃত্তি আয়োজনে। কিন্তু সেইসব আনুষ্ঠানিক করা ছাপিয়ে যেতো যখন একান্ত পরিসরে আরিফ ভাই আমাদের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। তাঁর আবৃত্তির প্রথম ক্যাসেট ‘ও চির প্রণম্য অগ্নি’ থেকে অনুরোধের যাবতীয় কবিতা আমরা শুনতাম স্বয়ং আরিফ ভাইয়েরই কণ্ঠে, সামনা সামনি। আহা, আবৃত্তিটা সত্যি ভালো করতেন আরিফ ভাই। আমরা একাধারে সমৃদ্ধ আর সম্মানিত আর সন্মোহিত হয়েছি তাঁর সরাসরি আবৃত্তি শুনে শুনে।
তারপরতো আমরাও ঢাকা চলে গেলাম। ১৯৮৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আরিফ ভাইকেও যথারীতি পেলাম ঢাকায়। তিনি আগে থেকেই ছিলেন সেখানে। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো। দিনের বেলা মধুর ক্যান্টিনে, বিকেলে টিএসসিতে। বই মেলার সময় বাংলা একাডেমিতে। জাতীয় কবিতা উৎসবে। আবৃত্তির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলেও। আমাদের সময় কাটানো ছিল রাজনীতি ঘেঁষা বেশি, আরিফ ভাইয়ের প্রধান বিচরণ বলয় ছিলো সংস্কৃতি। কিন্তু সময়টা সামরিক শাসক এরশাদের আমল বলে রাজনীতি আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন ছিলো খুবই জোড়ালো আর ঐতিহাসিক। মূলত এই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই ফসল ছিল নব্বই এর গণ-অভ্যুত্থান। হাসান আরিফ এবং তাঁর কর্মকান্ড-অবদান বুঝতে হলে নব্বই এর গণ-অভ্যুত্থান প্রক্রিয়া জানতে হবে ভালো করে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০-এই পাঁচ বছরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিটি নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়া এবং সাংগঠনিক পদক্ষেপে হাসান আরিফ এবং তাঁর আবৃত্তি সংগঠনের ধনাত্বক ভূমিকা আছে। একজন আবৃত্তিকার থেকে সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং পরে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম সারির নীতি নির্ধারক বা নেতা হয়ে উঠেন হাসান আরিফ। ঠিক একই সময়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবার কারণে খুব কাছ থেকে আরিফ ভাই এবং তাঁর বিবর্তন দেখেছি আমরা। শুধু ক্যাম্পাস, টিএসসি বা রাজপথের সারথি নয়, আরিফ ভাইয়ের ধানমন্ডি বাসায় গিয়ে অনেকবার তাঁর সকাল গড়ানো প্রলম্বিত ঘুম ভাঙিয়েছি আমি। ঘুম থেকে উঠে ‘কিরে‘ বলে প্রথমেই হাত দিয়ে বিছানায় সিগারেটের প্যাকেট যে খুঁজতেন সেটাও তখন লক্ষ্য করেছি। আরিফ ভাইয়ের সাথে সামাজিক ঋদ্ধ অনেক সময় কাটিয়েছি আমি। আদর্শ-আন্দোলনগত দীর্ঘ বোঝাপড়ার ঐক্য একপর্যায়ে ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক্যে উন্নীত হয়েছিল আমাদের।
আমি জানি, আরিফ ভাইয়ের কর্মকান্ড এবং আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন-অর্জনে তাঁর ভূমিকা-অবদান নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, লিখবেন, কথা বলবেন। তাঁকে নিয়ে নিশ্চিতভাবে জাতীয় পর্যায়ে স্মারক গ্রন্থও বের হবে। বড় ব্যানার দিয়ে অনেক অনুষ্ঠান হবে। আমি একইভাবে সেইসব কর্মকান্ডের অনুসরণ বা বর্ণনা দিয়ে আমার এই লেখা ভারী-দীর্ঘ-বর্ণনাধর্মী করবোনা। বরং দুটি বিষয় নিয়ে একটু বলবো যা হয়তোবা অনেকেই বলবেন না। আমাদের আশ্চর্য কিছু অগোচর থেকে যায় সবসময়। নিজেরাও একইরকম বলে লজ্জা-জড়তায়, অবচেতনেই হয়তোবা , অনেককিছু আমরা বলি না। অনেকেই মনে করেন একজনের প্রস্থানের পর কেবল সুন্দর সুন্দর কথা বলাটাই শ্রেয়। না, আমি তা মনে করি না। আমাকে আন্দোলিত করে এবং ভাবায় এমন কথা আমি বলবোই। বলাই বাহুল্য, আরিফ ভাইকে ভালোবেসেই আমার এই কথাগুলো বলা। আশা করি আমার লেখার উপরের অংশ দিয়ে বোঝা গেছে যে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক্য এবং ঘনিষ্ঠতার মাত্রা কতটুকু-কেমন ছিল। আরিফ ভাইকে নুন্যতমভাবে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
আমার দুটি পর্যবেক্ষণ।
এক.
এরশাদের পতনের পর অন্য অনেক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতা-সংগঠকদের মতন আরিফ ভাইয়ের মধ্যেও একটা শিথিলতা এসেছিল বলে আমার মনে হয়েছে। রাজপথের দীর্ঘ লড়াই শেষ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শুরু, কি করলাম কি পেলাম হিসাব নিকাশ শুরু হচ্ছে, আন্দোলনকারী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় যাচ্ছে, একটু যেনো আয়েশ করবার, অসংযমী হবার, সুযোগ সুবিধার কাছাকাছি যাবার বৈধতা তৈরী হচ্ছিলো সবার মধ্যে। ঠিক এই সময়টায় , অনেকটাই রিপুর নিয়ন্ত্রণহীন জীবন যাপনের জন্যেই হয়তো , আরিফ ভাইয়ের ওজন অনেক বেড়ে যাচ্ছিলো। সেই অবস্থায় আমাদের দেখা সাক্ষাৎ খুব কম হতো। সেই সময়টায় একবার দেখা হলে আমি তাঁকে বলেছিলামও এই বিষয়ে। শরীরের যত্ন নিতে বলেছিলাম। জবাবে বলেছিলেন , ওজন কমাবেন। ২০০০ এর দিকে আমি প্রবাসী জীবন যাপন শুরু করলে দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আরিফ ভাইয়ের সাথেও আর শারীরিক দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। প্রায় এক যুগ (২০০০-২০১২) আমাদের দেখা হয়নি। প্রবাসের পাঠ চুকিয়ে দেশে আসার পর সাত বছর আগে যখন ঢাকাতে আরিফ ভাইয়ের সাথে আমার আবার দেখা হয় তখন তাঁকে চিনতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো ঐ ধারাবাহিক অতিরিক্ত ওজন আরিফ ভাইয়ের জীবনকে নানা দিক দিয়ে জটিল-অচল করে ফেলেছে এবং প্রায় সবকিছুতেই ভয়াবহ ঋনাত্বক প্রভাব ফেলেছে। খুব খারাপ লেগেছিল আরিফ ভাইকে এইরকম দেখে। অনেকটাই ক্লান্ত এবং ভারবহ।
দুই.
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রধান শিকার হয়েছে কিন্তু স্থূলকায় ব্যক্তিবর্গ। আমি এখানে কোন রাখঢাক করে শব্দ ব্যবহার করছি না। স্থুলতাকে স্থূলতা বলছি। আমি নিজেও একসময় স্থূল ছিলাম এবং নিজের ২৭ কেজি ওজন কমিয়ে স্থূলতা মুক্ত হয়েছি। নিজেকে দিয়েই আমি স্থূলতা নিয়ে কথা বলবার বৈধতা অর্জন করেছি এবং স্থূলতার বিরুদ্ধে এক ধরণের সামাজিক কাউন্সিলিং শুরু করেছি। স্থূলতা আসলে সকল রোগের সূতিকাগার। স্থূলতা দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গ পতঙ্গকে অকেজো-দুর্বল করে ফেলে এবং ফলত দেহের রোগ প্রতিরোধ করবার শক্তিকে প্রায় শেষ করে দেয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রিয় আরিফ ভাইও করোনা সময়ে বিশ্বময় অন্যান্যদের সাথে এই স্থূলতা রোগের শিকার-গোত্রভুক্ত হয়েছেন। অতিরিক্ত স্থূলতার কারণে এবং দেহের সব অঙ্গ পতঙ্গ দুর্বল থাকার কারণে করোনায় আক্রান্ত হবার পর শয্যাশায়ী হয়ে আরিফ ভাই আর বিছানা থেকে উঠতে পারেননি। আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন একটু একটু করে প্রস্থানের দিকে এগিয়ে গেছেন প্রিয় আরিফ ভাই। হাজার মানুষের শুভকামনা তাঁর প্রস্থানকে ঠেকাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা আরিফ ভাইয়ের অসহায় মুখ দেখে বেদনায় বিদীর্ন হয়ে গেছি আমরা। অগ্নিকে প্রণাম করা কণ্ঠের আরিফ ভাইয়ের কণ্ঠনালির নল এসে বিদ্ধ হয়েছে যেনো আমাদেরই বুকে। এই করুণ-নিস্তেজ মুখ হাসান আরিফকে আমরা দেখতে চাইনি কোনদিন। তাঁর কোন বয়সই হয়নি মরবার। আরিফ ভাইয়ের যুবা বয়সের এই অসুস্থতা-মৃত্যু অন্য অনেকের মতন আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। ভাবিয়েছে অনেক। নাড়া দিয়েছে ভাবিয়েছে বলেই আমিও (প্রচন্ড সমালোচনার ঝুঁকি নিয়ে) তাঁকে নিয়ে আমার কিছু অনুভূতি সামান্য এই স্মরণ কথায় তুলে ধরলাম। স্থূলতা নিয়ে কথা বললাম। আরিফ ভাইয়ের প্রস্থান থেকে আমাদেরকে শিক্ষাও কিছু নিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েও আমি একই কথা বলেছি। করোনায় আক্রান্ত-মৃত সারা পৃথিবীর স্থূলকায় ব্যক্তিবর্গ এবং আমাদের প্রিয় আরিফ ভাই আমাদের শিখিয়ে গেছেন যে শরীরের ওজন এভাবে বাড়তে দেয়া যাবেনা। আমাদের জানতে হবে যে স্থূলতা একটি মরণঘাতী রোগ। বুঝতে হবে যে স্থূলতা মানেই নিজের আয়ু অনেকটাই কমিয়ে ফেলা। করোনা এবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে পৃথিবীব্যাপী লক্ষ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে আমাদের এই সত্য শেখালো।
আরিফ ভাই তাঁর দেহ দান করে গেছেন। দেহ পরম্পরায় এবং তাঁর কাজের অবদানে তিনি নিশ্চয় আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন-অর্জনে তাঁর অবস্থান-অবদান-ভূমিকা ঐতিহাসিক হয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে। থাকা উচিত। হাসান আরিফের অকাল শারীরিক প্রস্থান ঘটলেও আমাদের চেতনায়-ইতিহাসে তিনি স্থায়ী অবস্থানে টিকে থাকবেন সবসময়।
হাসান আরিফের অক্লান্ত মৃদু হাসি, কাঁধে অভয়ের হাত, ঝাঁকড়া চুল, উজ্জ্বল মুখ আর মানব হৈতষী সত্তা এক অবিস্মরণীয় কীর্তি হয়ে আমাদের বাঁচবার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে টিকে থাকবে। থাকবেই।
হাসান আরিফ মৃত্যুঞ্জয়ী...