
জুলফিকার নিউটন ||
ফখরুল হুদা হেলাল শব্দের সাধনা করেছেন সোল্লাসে। শব্দের জন্য তিনি মাতাল হয়েছেন, সেজন্য সমস্ত শব্দকে তিনি ধরে রেখেছেন, ফুসফুসের আবেগে কাঁপিয়েছেন। আবার বিষয়ের জন্য তিনি মাতাল হয়েছেন, সেজন্য বিষয়কে তিনি কবিতা করে তুলেছেন। শব্দের জন্য বিষয় আর বিষয়ের জন্য শব্দ তাঁর কবিতার আয়তন গড়েছে, সেখানে এসেছে ইন্দ্রিয় চেতনা, মানবিকতা, সামাজিকতা, গীতলতা, ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ধরা দিয়েছে শারীরিক দৃশ্যাবলী; মানবিকতার মধ্যে প্রবেশ করেছে মানুষ কেবল মানুষ; সামাজিকতার মধ্যে বেয়ে এসেছে মানুষের সমাজ; আর গীতলতা তাঁকে সৃষ্টি করেছে প্রবলভাবে।
কবিতাকে অস্তিত্বের সমান তিনি করে তুলেছেন, সেজন্য কবিতা তাঁকে নিয়ে গেছে মানুষের কাছে, আর মানুষ তাঁর প্রেমে পড়েছে সুশীল নেশার মতন। তাঁর কবিতায় তিনি সৃষ্টি করেছেন বিষয়, আর বিষয় হচ্ছে মানুষের প্রাত্যহিক ঘরসংসার, সেজন্য তিনি শব্দে গেছেন সোল্লাসে। সোল্লাস : তাই তাঁর কবিতা স্পষ্ট, স্বচ্ছ; তাঁর কবিতা পার্থিব, সেখানে তিনি স্বোচ্চার ও সমুদ্ভাসিত, সেখানে তিনি তন্ময় ও মন্ময়, সেখানে মিলেছে বহিঃপৃথিবীর বস্তুনিচয় এবং অন্তঃপৃথিবীর অন্বেষণ, তাঁর হৃদয়ে পরিবর্তিত হয়েছে অভিজ্ঞতার বিভিন্ন অঞ্জলি, তিনি নিজেকে চরিতার্থ করেছেন সানন্দে, সোল্লাসে, দেহজ, মানবিক, সামাজিক অভিজ্ঞতায় মৌমাছির মতন বারবার ফিরে-ফিরে। তিনি নিজের কাছে ইন্দ্রিয়তা, মানবিকতা, সামাজিকতা, গীতলতার অর্থ খুঁজে ফিরেছেন, এই কারণে কেউ তাঁকে দখল করেনি, তিনি দখল করেছেন সবকিছু, অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ধারণ করতে চেয়েছেন সবকিছু, অভিজ্ঞতায় বিষয়ের খোঁজ করেছে, আর বিষয়ের মধ্যে খোঁজ খবর করেছেন মানুষের, সমাজের, দেহের, আর তাঁর শব্দগুলি উল্লসিত দাগ রেখে গেছে ঐ সব বিষয়ে।
মানবিকতা, সামাজিকতা, ইন্দ্রিয়তা সকলই এক বিশ^াসঘাতক এলাকা; মানুষ মানবিকতার সঙ্গে, সমাজ সামাজিকতার সঙ্গে, ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়তার সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা করে, সেজন্যই তিনি প্রতীক্ষায় টানটান শেষ অবধি, শব্দের মধ্যে বিভোর সরল সত্যের দিকে মুখ করে। মানুষ ও ইন্দ্রিয়ের লক্ষণে তিনি আশ্রয় খুঁজে বেরিয়েছেন, কিন্তু বিশ^াসঘাতক এলাকায় তিনি আরোগ্য লাভ করেননি। তিনি শব্দে হেনেছেন অস্তিত্বের শক্তি, তিনি শব্দে এনেছেন ইন্দ্রিয়ের দৃশ্যাবলী, তিনি শব্দকে ফুটিয়েছেন স্বচ্ছতায়, স্পষ্টতায়, তিনি শব্দকে খুঁজেছেন আলোকে।

স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা, আলোক ফখরুল হুদা হেলালের জীবনবেদ, আর এই জীবনবেদের পিছনে কাজ করেছে রোমাণ্টিক মতাদর্শ। প্রচলিত প্রথা পদ্ধতির বিরোধী রোমাণ্টিক মতাদর্শ, কারণ এই প্রথা এই পদ্ধতি আপস করতে শেখায় সত্য, বিকৃত করে আদর্শ। রোমাণ্টিকতার সত্য কিংবা আদর্শ : ব্যক্তি ও সমষ্টির অন্তঃস্থ প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রত্যক্ষ প্রকাশ। ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টিশীলতার অভিজ্ঞতা কিংবা সমাজের মধ্যে লোকজ, জাতিক অথবা স্থানিক সত্তার ওপর জোর : রোমাণ্টিক ঐতিহ্যের এই দুই ধারা। এই সত্য এই আদর্শের কাছে চরম আবার অব্যবহিত অভিজ্ঞতা। যা কিছু পরিকল্পিত, প্রস্তুত, সংগঠন কিংবা আপস উদ্ভুত, সবই নীতি বিরোধী, নষ্ট। সেজন্যই রোমাণ্টিক ঐতিহ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ফখরুল হুদা হেলালের কাছে সমকালীন সমাজ সহ্যের অতীত। সমাজ ব্যক্তি কিংবা সমষ্টিকে তাদের অন্তঃস্থ সম্ভাবনা সত্য হতে দেয় না, ফখরুল হুদা হেলালের কাছে সমাজ তাই রোমাণ্টিক মতাদর্শের দিক থেকে নির্যাতনের বাধ্যতামূলক এক পদ্ধতি, ঐ পদ্ধতি স্বাধীনতা ও সম্ভাবনার বিরোধী। ফখরুল হুদা হেলাল রোমাণ্টিক বলেই সমাজের সঙ্গে যুদ্ধে প্রস্তুত। এই মতাদর্শে ফের ফখরুল হুদা হেলালের রাজনীতি, সংগঠন, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছে।
ফখরুল হুদা হেলালের এই রোমাণ্টিক মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত বোহিমিয়ান ঐতিহ্য এবং লোকজ গণতান্ত্রিক বোধ। বাঙালি সমাজের ঘরছাড়া কীর্তনিয়ার দল আধুনিক বোহিমিয়ানদের পূর্ব পুরুষ। তারা রাস্তার, তারা রুটিন এবং দায়িত্বে গ্রথিত নয়, তারা বৃত্তির ভারও বহনে রাজী নয়, তাদের দায়িত্ব কেবল নিজেদের সৃষ্টিশীল ঝোঁক এবং আনন্দের কাছে। ফখরুল হুদা হেলালের অনিশ্চিত জীবিকা এবং বুদ্ধিবাদী অনুভূতিপ্রবণতা তাঁকে অনিয়মিত জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। ফখরুল হুদা হেলাল নিজের জীবনে বোহিমিয়ান আচরণ এবং বোহিমিয়ান নীতি সত্য করেছেন, পাঠকই তাঁর পৃষ্ঠপোষক, তাঁর রোজগারের উৎস; সেইসঙ্গে জড়ানো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির রোমাণ্টিক মতাদর্শ : নিঃসঙ্গ প্রতিভা, এই প্রতিভা কোনো আইন মানে না, এভাবেই ফখরুল হুদা হেলাল বুদ্ধিবাদী এক চরিত্র/বোহিমিয়ান শিল্পীর ইমেজ তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য ফখরুল হুদা হেলালের বোহিমিয়ান মানসে সাড়া তুলেছে, বিভিন্ন পর্যায়ে ফখরুল হুদা হেলালের কবিতার মধ্যে দিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্যে যুক্ত হয়েছে। সবকিছু প্রতিষ্ঠিতর বিরোধীতা: নৈতিক, নন্দনতাত্ত্বিক, ফকরুল হুদা হেলাল বাসা খুঁজে পেয়েছে। সেজন্যই প্রশাসনিক পুলিশ ফখরুল হুদা হেলালের ওপর চোখ রেখেছে বিপ্লবীদের মতন, ফখরুল হুদা হেলাল বোহিমিয়ান হিসাবেই সমাজের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছেন, কখনো যুক্তির পথে, ঐতিহ্য মুক্ত স্বাধীন জীবনের খোঁজে, কখনো বি-সম, প্রবল ঝোঁকে বিরোধীতা করেছেন সকল প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে, কাজ কিংবা জীবনের অভ্যস্ত রুটিনে সংলগ্ন থাকার অক্ষমতায়।
ফখরুল হুদা হেলাল রোমাণ্টিকতার সেইসব উপাদানে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন, যে-সব উপাদান জোর দেয় স্বতঃস্ফূর্ততা এবং প্রকাশের যথার্থতার ওপর। এই স্বতস্ফূর্ততা, এই যথার্থতা ব্যক্তিকতার চর্চায় সাহায্য করে। ব্যক্তিকতার ওপর অত্যধিক জোর দিয়ে ফখরুল হুদা হেলালের রোমাণ্টিকতা সমাজব্যবস্থাকে ধিক্কৃত করেছে এবং বুদ্ধিজীবীদের সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে; শৃঙ্খলা, প্রথা, ক্ষমতার রক্ষকদের বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। বুদ্ধিজীবী চরিত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ফখরুল হুদা হেলালের এই ইচ্ছে অবদান।
ফখরুল হুদা হেলালের মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে তাই রোমাণ্টিক, বোহিমিয়ান এবং লোকজ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কেন্দ্র করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সতত ব্যস্ত, ব্যাপৃত থেকেছে বিদ্যমান পৃথিবীর/সমাজের নষ্টতা নিয়ে, আলোক ও অন্ধকারের তফাৎ খুঁজে বেরিয়েছে সকল সময়। সেজন্য তাঁর প্রচণ্ড ঘৃণা বিদ্যমান বৈশি^ক ব্যবস্থার ওপর, বিশেষ করে পৃথিবীর সরকারি অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক সকল প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাদের ওপর। তাঁর চোখে সকল প্রাতিষ্ঠানিক কর্তা নষ্টতার দূত, নষ্টতার সঙ্গে আপসের প্রতিভূ। এই নষ্টতা মানুষকে সতত প্রলুব্ধ করে; জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতা, ব্যবসা, ব্যক্তিক স্বার্থ সকলই নষ্টতার সঙ্গে জড়িত। এই কারণেই ফখরুল হুদা হেলালের মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে স্বর্গরাজ্যের বোধ উচ্চকিত : নষ্টতার রাজত্ব ক্ষণকালীন। কোনো এক সময় আসবেই দেখা দেবেই যখন নির্যাতিতরা, প্রবঞ্চিতরা চিরন্তন শান্তি খুঁজে পাবে, শক্তিমানদের পতন ঘটবে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে। এই ব্যবস্থার ভিত্তি, কেন্দ্র, ভূমি হবে সম্পূর্ণ সমন্বয়তা ও শান্তি, মানুষ বাস করবে ন্যায় ও পারস্পরিক প্রেমের ভিত্তিতে। ফখরুল হুদা হেলালের এই য়ুটোপিয়ান অন্বেষণের সঙ্গে চিরকালের ঝগড়া বিদ্যমান স্বার্থের, আত্মপ্রসারণের; ঘৃণার এবং প্রতিবাদের। সেইসঙ্গে তিনি প্রচার করেছেন মানুষের জন্য প্রেম ও শান্তির বার্তা।
হয়তো এই কারণে তাঁর কাজে আলোক আর স্বচ্ছতা আর স্পষ্টতা, আর তাই তাঁর জীবনবেদ।
২
ফখরুল হুদা হেলালআধুনিক সাধু। এই অভিধার মধ্যে বিরোধের আভাস লুকোনো। তিনি আধুনিক, কারণ তাঁর চেতনা জটিল, ঘন, গভীর, অরণ্যের মতন, তিনি দ্বিধাবিভক্ত, দ্বিত্ব ব্যক্তিত্বে তিনি আক্রান্ত। অথচ তিনি সাধু, সাধুর মতন চোখে তিনি পৃথিবীকে দেখতে ভালবাসেন, সাধুর মতন সব সমস্যার মধ্যে সংগতির সূত্র খুঁজে ফেরেন। আধুনিক জীবনের অন্তঃসারকে সন্তের চোখে অবলোকন করার প্রয়াস সাহসের ইতিহাস, কিন্তু সন্তকে ঘিরে রয়েছে আধুনিক জীবনের শত জটিলতা, সন্তকে জড়িয়ে ধরেছে আধুনিক জীবনের অনিকেত মনোভাব, সেখানে সান্ত্বনার কিংবা শান্তির পরম আশ্রয় চোখে উদ্ভাসিত হলেও গন্তব্যে মেলে না। ফখরুল হুদা হেলাল সেজন্য একই সঙ্গে পরম আধুনিক ও পরম সাধু। তাঁর সান্নিধ্য আধুনিক, তাঁর সান্নিধ্যে একজন সাধুর সঙ্গ পাওয়া যায় এই বিপরীতই ফখরুল হুদা হেলাল।
বাস্তবের যে-রূপ আধুনিক পর্বে উন্মোচিত হয়েছে সেখানে নানা গ্রন্থির জাল। ব্যক্তি বিখণ্ডিত, প্রকৃতি নিঃসঙ্গ সুন্দর, সমাজে শ্রেণীর প্রতাপ মূল্যবোধ অস্বীকৃত। ব্যক্তি কোনো শ্রেয়ে সংলগ্ন নয়, সমাজ শ্রেয়োধর্মী নয়, সত্য সুন্দর কল্যাণ সবই নিঃসংলগ্ন। বস্তু ও চেতনা পরস্পর বিরোধী। বিজ্ঞানে উন্মোচিত প্রকৃতির রহস্য, কিন্তু বিজ্ঞানে কল্যাণ নেই। কল্যাণবিহীন বিজ্ঞান, সত্যবিহীন সমাজ, সুন্দরবিহীন দৃষ্টি সবকিছু নয়, সবশেষ নয়, কোথাও আছে সবকিছুর সংগতি, কেননা সবই প্রয়োজনীয়, কেননা, ধ্যানে যুক্ত সবকিছুই, অসংগতি, অসংলগ্নতা, সংসারের সুখ-দুঃখ, সবকিছুই।
ফখরুল হুদা হেলালের মানসরূপকে এভাবে হয়ত চিহ্নিত করা যায়। তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ব্যক্তি, ব্যক্তি একা সংগ্রামেরত বস্তু ও চিন্তার বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে, জীবন পরিকল্পনায় সব বস্তু ও চিন্তার সমমূল্য, সেজন্য কোন জীবন পরিকল্পনা নির্মাণ সম্ভব নয় কোনো বস্তু বা চিন্তা বাদ দিয়ে, সব প্রকাশরূপকে দৃষ্টিতে ভাবনায় মেলানো তাঁর কাজ। একে ফখরুল হুদা হেলাল উপলব্ধি করেছেন দুভাবে। রিলকের মতন বাস্তবকে অন্তর্জীবনে রূপান্তরিত করে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তাকে আধ্যাত্মিকতায় মণ্ডিত করেছেন। যেন অন্তজীবন সমৃদ্ধ করার জন্যই বাস্তব, সেখানে কোনো বিরোধই পরম নয়, সবকিছুই মিলে যায় ভালবাসায়, জানায়। বাস্তবের নতুন সৃষ্টি হল এভাবে, বাইরের জগতের কোনো ভেদ রেখা দিয়ে যে-বাস্তব চিহ্নিত নয়। অন্তর্জগতে যে-নতুন বাস্তব তৈরি হল তার অভিজ্ঞতায় অন্তরিত এক আশাবাদ, যে-আশাবাদে বিশ্বাসের সুর ধ্বনিত। এ বিশ্বাস জীবনের সবকিছুকে গ্রহণ করবার, চৈতন্যকে একাগ্রে সংহতিতে গুচ্ছবদ্ধ করবার।
১ । তোমার বাগানের গোলাপ
তোমাকে দিয়েছি ফিরায়ে
শুঁকে দেখো তাতে আমার চুম্বনের
মিষ্টি গন্ধ পাবে (গোলাপ এবং তুমিঃ ৪৯)
২ । তোমার হাতে খাব
বিশুদ্ধ কবিতার সাজানো ডালি (তোমার হাতে খাবঃ ১১৯)
৩। প্রজাপতি প্রজাপতি
তুমি ঘুরে ঘুরে জানাচ্ছ আর্তি
সমাজ
ভগ্ন হৃদয়ে তোমাকে দেখছি (আদরঃ ১৪৬)
ফখরুল হুদা হেলালের এই উপলব্ধির সম্পূরক হচ্ছে তাঁর মরমীবোধ। এই বোধে জগৎ প্রয়োজনীয়, জগতের সবকিছুই অর্থবহ। দৃষ্টিতে সবকিছুই লগ্ন হয়ে আসে, সব অস্তিত্বই পরম মূল্যবান, দেখায়, শোনায়, স্পর্শে অন্তরিত সবকিছু। সব অস্তিত্বই মূল্যবান, সব অস্তিত্বই প্রকাশরূপ, অন্তর্জীবনে সব অস্তিত্বের নতুন নির্মাণ অভিজ্ঞতাকে বিচিত্র ও নিরাসক্ত করে তোলে। মন সমৃদ্ধ হয়, চেতনা বিকীর্ণ হয়, দৃষ্টি ধ্যানে পরিণত হয়।
ফখরুল হুদা হেলালের কবিতার কাঠামো খণ্ড-খণ্ড অভিজ্ঞতা দিয়ে গাঁথা। ঐ সব খণ্ড অভিজ্ঞতা কোথাও থেকে উঠে এসে সমগ্রকে গড়ে তুলছে, যে-সমগ্র দৃষ্টির দর্শনে’ অন্তরিত। একপক্ষে খণ্ড অভিজ্ঞতার নিজস্ব মূল্য ও প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে গেঁথে তোলা, যেন সূক্ষ্ম এক কারুকাজ কাঠের ওপর কিংবা দেয়ালে। বক্তব্য ঐ সব খণ্ড চিত্র, যে চিত্রে রং রেখা উদ্ভাসিত, যেন চোখই চিত্র হয়ে উঠেছে, সরল, প্রাথমিক, সদ্য চিত্র। তাই যুক্তির ঋজুপরম্পরা নেই, কারণ যুক্তি বাদ দেয়, সীমা তৈরি করে। কিছু গোপন থাকে, লুকোনো থাকে, যেন এক সার সবুজ পাতা, গাছের অনেকটাই আড়ালে, ফখরুল হুদা হেলাল এভাবেই চোখে বিদ্ধ করে দেন চিত্রের বক্তব্য, যেন তাঁর বক্তব্য ও চিত্রকলা পরস্পর সম্পূরক, পাশাপাশি দুটি দুটিকেই প্রসারিত করে, গভীর করে, অন্য এক অর্থে মণ্ডিত করে।
সুন্দর হোক কবিতার চলা...
সুন্দর হোক কবিতার বলা...
সুন্দর হোক কবিতার লেখা...
সব ধ্যানে কবিতা হোক প্রেম; (চিন্তা: ২৬১)
এই কারণেই শব্দ সংস্থানে তিনি ব্যাকরণ মানেন না, কারণ তাঁর কাছে শব্দ যুক্তির প্রতীক নয়, অনুভূতি ও ধ্যানের প্রতীক, তাই শব্দকে পৌঁছােতে হবে চৈতন্যের শুদ্ধ স্তরে, যেখানের ভাষা ব্যাকরণের নয়, আত্মার উপলদ্ধির, তাই ভাষাকে তিনি করে তুলেছেন নিবিড়ভাবে আন্তরিক ও অন্তরঙ্গ, যেন কথা বলছেন কারো সঙ্গে সেই প্রবল অন্তরঙ্গতার চাপেই তার ভাষায় নতুন স্পন্দন এসে যায়, শব্দে জ্বলে ওঠে বিশেষণের উল্লাস, আরো তীব্র আরো তীক্ষè তাঁর ঐ অন্তরঙ্গতাজাত মৌখিক রীতির ছন্দ, যেখানে ধ্বনিত অন্তর্লীন সংহতি, সে কারণেই তার মিল প্রচ্ছন্ন, উচ্ছ্বাসহীন, সংলাপের ভঙ্গি তার, তাই তিনি মিতব্যয়ী, স্বল্পভাষী, কল্পনার ওপর শ্রদ্ধাশীল।
৩
ফখরুল হুদা হেলালেরপৃথিবীতে সবকিছু ফলে এবং ভেঙে যায়, সবকিছু ধ্বংস হতে থাকে এবং গড়ে ওঠে ; পতন আছে সেই সঙ্গে আছে ধৈর্য, তিনি এই বৃত্তের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে। বেড়ান, কখনো দেয়ালের ফাঁক দিয়ে পৃথিবীকে দেখেন, তখন তাঁর চোখে ফোটে ভয়, ত্রাস, সতর্কতা এবং আনন্দ, এসবই তাঁর কবিতায় বিষয়। আর বিষয়ে বারেবারে ঘুরেঘুরে উল্লিখিত হয় তাঁর অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতা তিনি উপার্জন করেন জীবনে বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে, বিচিত্র জীবিকা গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে, নানা গ্রন্থ পাঠের মধ্যে দিয়ে। জীবন, জীবিকা, গ্রন্থ তাঁর মধ্যে উন্মীলিত করে একটি পুরাণের : মানুষের সরলতা থেকে দূরে সরার অভিজ্ঞতা। মানুষ জীবনে যাত্রা করে নির্ভয়ে, সৎ ও কৌতূহল প্রবণ হয়ে, কিন্তু যাত্রাতেই তার পতন, তখন তার প্রয়াস সরলতার নানা বন্দর খুঁজে চলা : শৈশব, স্মৃতি, গ্রাম্যজীবন, কিংবা রুচি নির্ভর মধ্যবিত্ততা, তার ফেরার পথ নেই, তার খোঁজারও শেষ নেই।
এক হিসেবে ফখরুল হুদা হেলাল কবিতার বিষয় তিনিই, নিজেকে আবিষ্কার, নিজেকে জানবার নিরন্তর প্রয়াস তাঁর কবিতার পরিসর বাড়ায়। ঐ সব তিনি প্রকাশ করেন আবেগে, প্রকাশ করেন নিজস্ব মনোভঙ্গির মাধ্যমে। তাঁর রচনায় নানা রূপকল্পের সমারোহ, বিরোধী ভাবের সমাবেশ। আসলে তার মধ্যে কাজ করে দ্বৈতসত্তা; এক স্তরে তিনি গীতি কবিতার আবেগে গড়ে তোলেন নানা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপকল্পের কাব্যগ্রন্থ: অনামিকায় প্রবাল (২০০০), ঈশ্বরের পৌরসভা (২০০১), পপির চিঠির শেষ অংশ (২০০৩), তোমার হাতে খাবো (২০০৪), জোড়া টিকটিকি (২০০৭), আমরা ধরেছি বাজি (২০১৩), নির্বাচিত কবিতা (২০১৫), তোমাদের জন্য কবিতা (২০১৭)। প্রভৃত্তি
অন্যস্তরে তিনি বিবৃত করেন নিস্পৃহভাবে নানা তথ্য, সংবাদ, বাস্তব পৃথিবী। আবার তাঁর শিল্পকাজে সংমিশ্রণ ঘটে বাস্তব ও রোমান্টিকতার, এতে প্রতিফলিত কাব্যাদর্শ সম্বন্ধে তাঁর দ্বৈত মনোভাব। একপক্ষে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাস্তব তুলে ধরেন, অন্যপক্ষে প্রকৃতি ও শিল্প সম্বন্ধে তার মনোভাবে বৈষ্ণব পদাবলী রোমান্টিকতা ধ্বনিত। সেজন্য তাঁর লেখা কাব্যাদর্শের রোমান্টিকতা বুদ্ধিবাদ বিরোধী, তার লক্ষ্য অনুভূতির প্রকাশ। তাঁর কবিতা অতীতের রোমান্টিকতা কিংবা শৈশবের সরলতা, এবং বর্তমানের বাস্তবতা কিংবা বাস্তবিক জীবনযাপনের মধ্যে বিচলিত, অস্থির ; তিনি দ্বন্দ্বের সমাধান করেন না, দ্বন্দ্ব নিয়েই জীবনে/কবিতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতায় তিনি ক্রমাগত তুলে ধরেন হারানো শৈশব, লুপ্ত সমারোহ ; শৈশবের অলৌকিক ঐশ্বর্য ক্ষয় হয়, মানুষ বাস্তব পৃথিবীর জিন্দানে আবদ্ধ হয়, জীবনের সমারোহ বিশাল সম্মিলন থেকে দূরে সরে যায়, তিনি তাকিয়ে থাকেন এভাবেই।
১। হৃদয়ের প্রজাপতি উড়ে চলে
কবিতা বিনির্মাণে
তাই হেটে চলে একজন কবি
কবিতার ডালি নিয়ে প্রাণে (উড়াঃ১৯৯)
২। বেলা শেষে আবার হবে দেখা
এই ভেবে বসে আছি আমি একা
তুমি শূন্যমাঝারে এসে দেবে বাতি জানি (জাগরুক থাকোঃ ২৩০)
৩। ভুবন ছেড়ে আখি জ্বলে ভালবাসার
আলপনা একে চলে যাব
কোন একদিন দুর থেকে বহু দূরে
অজানা দেশে ঃএই তো মোদের জীবনঃ ২৩৩
অভিজ্ঞতার সংঘাতে সরলতা, সততার ধ্বংস : পৃথিবীর মহত্তম বিষাদ এটি ; ফখরুল হুদা হেলালের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সরলতা, সততার দ্বন্দ্ব অবিরল, তিনি বাংলাদেশের বিশেষ সমাজ ও ইতিহাসের পরিসরে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। গ্রামীণ নিসর্গ ভেঙে যাচ্ছে, শহরে বণিক বিন্যাস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এখান থেকেই শুরু নিজেকে সংস্থিত করার প্রয়াস, পৃথিবী পুনরাবিষ্কারের উদ্যোগ, নিজের সম্পর্ক পরিবর্তিত নিসর্গ/সমাজের পটে গড়ে তোলার চেষ্টা। সেজন্য তার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে; স্বতঃস্ফূর্ততা, সরলতা, সততা যখন বিপরীতের সম্পর্কে আসে তখন তাদের বৈপরীত্যের তীব্রতা কবিতায় ধরা দেয়, এভাবে অভিজ্ঞতার বদল ঘটে, যন্ত্রণার পথে তার সত্তা সমৃদ্ধ হয়, তিনি বলীয়ান হয়ে ওঠেন, তার শক্তির উৎস তাই সততা, শুদ্ধতা ; তাঁর স্মৃতির শক্তি : শৈশবের ছায়া।
ফখরুল হুদা হেলালের অভিজ্ঞতা দুই স্তরে ব্যক্ত। এক স্তরে সৎ, সরল জীবনযাপনের তীব্র বাসনা ; অন্য স্তরে প্রতিশ্রুতি নষ্টের তীব্র তিক্ততা। এক স্তরে সততার, সরলতার আকৃতি, অন্য স্তরে যন্ত্রণার, মোহভঙের নৈরাশ্য। এই অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেকে এবং পৃথিবীকে বুঝবার প্রয়াস। কেন আমি সুখী নই, কেন মানুষেরা সুখী নয়, কেন যন্ত্র-বণিকী স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও সুখ মেলে না, সুখ হারিয়ে যায়, তার এক ধরণের ব্যাখ্যাও তিনি সওগাত দেন তাঁর কবিতায়। মানুষ সুখী হত, সুখী হতে পারত, কিন্তু পৃথিবীর অভিজ্ঞতা তার মনে ক্ষত তৈরি করে, আর ক্ষত তৈরি হয় বণিকী অভিঘাত থেকে, আর শেষ পর্যন্ত তাকে ততা বেঁচে থাকতে হয় এই পৃথিবীতে। বেঁচে থাকার বোধ জীবনে বেড়ে ওঠার সঙ্গে নষ্ট হয়, দেশের/নিসর্গের নয়নাভিরাম দৃশ্যমালা মলিন হয়ে যায়, তাঁর কবিতায় এভাবেই বিধৃত হতে থাকে প্রতিশ্রুতি ভঙের ইতিহাস।
ফখরুল হুদা হেলালের কিংবা তাঁর কবি-মন আহত, প্রতিবেশ, ঘটনাবলীর চাপ তাঁর মনের ওপর প্রবল ও বলীয়ান, তিনি কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারেন না প্রতিবেশের সঙ্গে কিংবা ঘটনাবলীর, তাই আহত অবস্থা তাঁর বোধ, তাঁর দেখার ধরন। কিন্তু তিনি স্বতন্ত্র সন্ধি করেন না তার শত্রুদের সঙ্গে, তিনি নিজের মধ্যে ফিরে আসেন, শুরু হয় তাঁর বিচ্ছিন্নতা, তাঁর বানানো পৃথিবীর মধ্যে তিনি রচনা করেন নিজেকে, এভাবে বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকতে চান সরল, সুন্দর অনুভূতিমালা নিয়ে।
তোমার তুমি নিজেই দিচ্ছ ভালবাসা...
কবিতায় কর্ষন করবো সত্যের ভূমি (এলোমেলো কথামালা: ২০৬)
ফখরুল হুদা হেলালের কবি-মন বারবার হেরে যায়, কিন্তু বাঁচবার জন্য কোনো কৌশল তিনি শেখেন না, তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী তাঁর আহতমন, তার অভিজ্ঞতা। অন্য অর্থে এই তাঁর ব্যাধি, তাঁকে তাড়া করে সর্বক্ষণ, সেই অভিজ্ঞতাই তাঁর কবিতার বিষয়। কিন্তু এই রোগের নিদান কোথায় ? এই অরাজক, উন্মাদক, বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে বাঁচা, বিক্ষুব্ধ, দুঃখতিক্ত জীবনে বাঁচা, মর্যাদা, সহনশীলতা, সাহসের প্রতীক হিসাবে বাঁচা : এই সব বোধ বারেবারে আসে মনের ঐ আহত অবস্থা থেকে, ঐ আহত অবস্থা তার স্বাধীনতার আবহাওয়া, কিংবা বিভিন্ন চাপের মধ্যে তাঁর মুক্তি : ফখরুল হুদা হেলালের ভাষা সরল, অলংকারহীন, ঋজু, সুমিত এবং একইসঙ্গে তাঁর শব্দ পুনরাবৃত্তিত। ছোট- ছোট শব্দে তিনি গড়ে তোলেন মিতভাষণ, সেইসঙ্গে সংক্ষিপ্ত সুর, বাহুল্যহীন , কোনো কৌশল ছাড়া। তিনি বেড়ে উঠেছেন সত্তর দশকের কাব্যাদর্শে, তিনি ধার করেছেন তাঁদের কাছ থেকে যাদের মেেনাভাব, অভিজ্ঞতা, রুচি তাঁর সঙ্গে মেলে। কিন্তু সব ধার তিনি ফলিয়ে তুলেছেন তাঁর কাব্যিক দক্ষতায়। সমকালে তার প্রভাব স্বাভাবিকতায় পরিণত, সেজন্য তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে; অন্যদিকে তিনি এনেছেন নির্লিপ্ততা ও সততার মূল্যবোধ, আঁকালো রচনা ও বহুভাষণের জায়গায় তিনি এনেছেন শুদ্ধতা। তাঁর কবিতা কথ্যরীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, বাক্য ও পদবিন্যাসে সহজতার প্রতি তার আকর্ষণ; তার শব্দ সাধারণ, ছোট ও প্রচলিত ; শব্দ ব্যবহারে তিনি নির্মম, ব্যঞ্জনা ও মিতভাষণের তিনি পক্ষপাতী, সেইসঙ্গে তির্যকতার ও স্বতঃস্ফুর্ততার ; ফলে তাঁর রীতিতে এসেছে স্বচ্ছতা।
অন্যপক্ষে ফখরুল হুদা হেলালের রচনারীতি বুদ্ধিবাদ বিরোধী। তিনি কবিতা বর্ণনা করেন, মনের বিশ্লেষণে তার ঝোঁক কম, মন্তব্যহীন, সেজন্য উদ্ভাসনে আসে নৈব্যক্তিকতা, এভাবে তিনি আগ্রহ ও উৎসাহ সঞ্চার করেন, ইঙ্গিতের দূরস্পর্শ আনেন। জীবন, নিসর্গের ক্ষুদ্রক্ষুদ্র তথ্যের উদ্ভাসন তাঁর প্রায় তুলনাহীন ; তাঁর শব্দের আবহ গাঢ়বন্ধ তাঁর বর্ণনা ঘটনার উপস্থাপনার আবহাওয়া গাঢ়, নিবিড়। ফখরুল হুদা হেলালের নিজের অভিজ্ঞতার পরিমণ্ডল থেকে তাঁর কবিতার ভাবপরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে। এই ভাবপরিমণ্ডলের পরিসর সীমিত, এই পরিমল মধ্যবিত্ততায় আকীর্ণ, সেজন্য, তিনি তাঁর কবিতার বিষয়, তাঁর কবিতার চরিত্র, এই পরিমণ্ডলের নিয়মনীতি মেনে চলে তার বহুমুখিতার তিন স্বরূপের : তিনি, তার কবিতা, তৈরি চরিত্রের আনন্দবোধ সীমিত , অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ; দেখার ধরন তাঁর নমিত, কোমল, অথচ বাস্তব সম্পন্ন। তিনি শেষ বিশ্লেষণে, স্বচ্ছ, শুদ্ধ, নির্লিপ্ত।