
আহাম্মেদ কবীর ।।
কবি ও সংগঠক ফখরুল হুদা হেলালের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাঁর মামার বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব থানার একলাছপুর গ্রামে। অবশ্য তাঁর পৈত্রিক নিবাস-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শশই ইসলামপুর গ্রামের ডেপুটি বাড়ি। তবে তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে কুমিল্লা শহরেই বসবাস করে আসছেন। প্রায় অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে তাঁর এই বসবাসের সূত্রেই তিনি সংগঠক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
কুমিল্লার সাড়া জাগানো সংগঠন,- ‘সে আমি তুমি’ সাহিত্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তাঁর সুনাম আজো অক্ষুণ্ন রয়েছে। এছাড়াও তিনি ত্রিধারা শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। রেনেসাঁ নাট্যগোষ্ঠী ও প্রগতি নাট্যসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁরই উদ্যোগে ‘সে আমি তুমি’ ১৯৭৪ সালে কুমিল্লায় প্রথম সাড়া জাগানো-কবি সম্মেলনের আয়োজন করে। যে সম্মেলনে কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদকে একই মঞ্চে উপস্থিত করা হয়- যা কিনা কবিতার ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

কবি ফখরুল হুদা হেলাল সংগঠন ও নাট্য অভিনেতা হিসেবে জীবনের প্রথম দিকে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রতিধ্বনি নাট্য সংগঠনের নাটক- ‘অভিশপ্ত প্রেম’- এ অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ২০০০ সালে কুমিল্লা জনান্তিক কর্তৃক সম্মাননা লাভ করেন।
কবি হিসেবে তাঁর কার্যক্রম সত্তর দশক থেকেই শুরু হয়। তবে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ কিছুটা পরে হয়েছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘অনামিকায় প্রবাল’। তারপর ২০০১ সালে প্রকাশ হয়- ‘ঈশ্বরের পৌরসভা’। ২০০৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম- ‘পপির চিঠির শেষ অংশ’। ‘তোমার হাতে খাবো’- আরেকটি কাব্যগ্রন্থের নাম যা প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। কাব্যগ্রন্থ- ‘জোড়া টিকটিকি’র প্রকাশকাল ২০০৭ সালে পর্যায়ক্রমে প্রকাশ হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ- ‘আমরা ধরেছি বাজি, নির্বাচিত কবিতা ও তোমাদের জন্যে কবিতা। সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রকাশ হলো তাঁর কাব্যসমগ্র।
কবিতা লেখার শুরু থেকেই কবি হেলাল মনেপ্রাণে, গড়নে-গঠনে, শৈলী-আচরণে, সৃষ্টি মহিমায় একজন সত্যিকারের কবি হতে চেয়েছেন। তাঁর কবিসত্তা সর্বসাধারণের জন্যে। তাঁর কাব্যস্বভাব সর্ব সময়ের জন্য। সেজন্যই অনেকেই তাকে ‘ফুল টাইম’ কবি বলে রসিকতাও করে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে চলাফেরা করার সময়ে সবাই বুঝে যায়- তিনি একজন কবি। স্বত:স্ফূর্ত, প্রাণোচ্ছ্বল একটা ভাব আর সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব তাকে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। যৌবনে ঋষি কাপুরের মতো চেহারা নিয়ে তিনি নীরবেই অনেক সুনয়নার দিল-এ আঘাত করতে পারতেন। মেয়েরা তাকে ভালবাসতো ঠিকই তিনি কিন্তু পারভীন ভাবি ছাড়া আর কাউকেই হৃদয়ে ঠাঁই দেননি। অবশ্য তাঁর সহধর্মিণীর প্রয়াণের পর এখন তাঁর হৃদয়েল কী অবস্থা সেটা বুঝা মুশকিল। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে-এখন তিনি কবিতাকেই ভালবাসেন। শুধুই কবিতাকে। তবে এই কবিতা কে বা কারা, নাক ভিন্ন কিছু, কে তার জবাব দেবে ?...
(২)
কবি ফখরুল হুদা হেলাল সৌভাগ্যবান কবিদের একজন, যাকে ঢাকার অনেক বিখ্যাত কবিরাও সমীহ করে চলেন। তাঁর জন্মদিনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়। এছাড়াও কবি নির্মলেন্দু গুণও তাঁকে ভালবাসে। তাঁর সয়সি কিংবা তাঁর চেয়ে প্রবীণ অনেক কবিই তাঁকে পছন্দ করেন। বিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন খুবই মনোযোগ সহকারে তাঁর ছবি তুলেছেন।
কবি তিতাশ চৌধুরী তাঁকে ‘সাহসী যুবক’ উল্লেখ করে কবিতা লিখেছেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী তাঁর বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছেন... ‘লক্ষণীয়, কবির কাব্য সমগ্র আগাগোড়া পয়ার ছন্দের আদলে বিরচিত। এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস তিনি করেন নি। বলা যেতে পারে এটা তাঁর নিজস্ব শৈলী। কবিতার কলাকৃতি বা শিল্পরীতির দিক থেকে তা একঘেয়ে মনে হতে পারে। তবে তার কবিতায় যে বিষয়টি ফল্গুধারার মতো বহমান, তা হচ্ছে তার নিরঙ্কুশ আন্তরিকতা, সারল্য এবং জীবন ও জগতকে নির্মোহ দৃষ্টিতে অবলোকনের প্রয়াস।’
কবি ও গবেষক ড. স্বপ্না রায় লিখেছেন, ‘সত্তরের দশক, বাংলা কবিতার জন্যে এক উন্মাতাল সময়। সে সময়ে কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনে যাঁরা বিচরণ করতেন তাঁদেরই একজন কবি ফখরুল হুদা হেলাল। স্বাধীনতা উত্তর কাল বিশেষত্বকে চেতনায় ধারণ করেছিলেন সেই সাহিত্যিকগণ। ফখরুল হুদার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম কিংবা বিকল্প হয়নি। রোমান্টিক কবি-সত্তা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত তাঁর কবিতার অবয়ব। এক্ষেত্রে সহজ অনুভূতির সরল শিল্পিত প্রকাশই তাঁর অভীষ্ট। স্বকাল প্রভাবিত হয়ে স্বভূমি-আশ্রয়ী। কোন বক্তব্য নেই তাঁর কবিতায় বরং পরিলক্ষিত হয় হৃদয়-শাসিত এক প্রেমতৃষ্ণ কবিমানসের সঞ্চরণ।’
আরেক গবেষক ও শিক্ষাবিদ লেখক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন- ‘আমরা সবাই কবি। সুতরাং ফখরুল হুদা হেলালও কবি। কেউ কবিতা না লিখে কবি, হেলাল কবিতা লিখে কবি।... কবি কবিতা লিখেন, যখন লিখেন তখন তিনি নিজেই জানেন না, তিনি কী লিখছেন, কেন লিখছেন, কাদের জন্য লিখছেন এবং লেখার ভবিষ্যৎ কী। এত প্রশ্নের পরও কবিতার মধ্যে এক সুর ও মূর্ছনা থাকে, যা পাঠককে আকর্ষণ করে। হেলাল এর কবিতায় সূক্ষ্মভাবে তা যাপিত, তাই কবি নয় তার কবিতাই শেষ কথা। কবিতা নিয়ে কবি হেলাল এগিয়ে চলছে- আমরা এ মিছিলে আছি।’
এবার দেখা যাক তাঁর কবিতায় কী আছে ? কেন সবাই তাঁর কবিতা ও কবি-ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এত কথা বলছে ? সহজ উত্তর হলো- তাঁর কবিতায় সরলতা আছে, প্রকাশ ভঙ্গিতে কোন জটিলতা নেই, তীব্র ক্ষোভ বা হিংস্রতাও নেই। তার কবিতাগুলি তাঁরই দেখার চোখে তাঁর ভাষ্য। স্বদেশ প্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, ঋতু বৈচিত্র, যাপিত জীবন, প্রকৃতি বন্দনা, স্মৃতি স্বকীয়তা, ব্যক্তিত্ব-প্রেম, ধর্ম-কর্ম-জীবন... ইত্যাদি তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ও বিশেষত্ব।
তাঁর কবিতা থেকে দুটো উদাহরণ দেয়া হলো-
১। ‘জানি না শেষ হবে কবে বুদ্ধিজীবীর চক্রান্ত
ভাষার সোনালি পারিতোষিত কবে পাবে
নতুবা কোন দিনই হবে না শোধ রক্তের দাবি
হবে না চেবতনায় একুশের স্বরলিপি পাঠ!’
(লুকায়িত আত্মার দাবি: অনামিকায় প্রবাল)
২। ‘ঘরোয়া প্রেমে সচেতন প্রেমিকা
নিত্য দিনের আহলাদ, নিত্য সুরের ঘোষিকা
চেতনায় ভরপুর জীবন, শান্ত স্বভাব
তারপরেও কথা হয়, হয় ভালবাসার অভাব
জোর করে পৃথিবী টানে না সূর্যকে
নিয়মের ঘড়ি বাঁধা সাতপাকে।’
(স্বভাব: ঈশ্বরের পৌরসভা)
(৩)
কবি ফখরুল হুদা হেলালকে নানাভাবে মূল্যায়ন করা যায়। তাঁকে দেখার দৃষ্টি নানা মুনির নানা প্রকারের হতে পারে। অবশ্য সেসব কথা বলেও শেষ করা যাবে না। তাঁর জীবন থেকে নেয়া কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে আমরা তাঁর সম্পর্কে কিছু ধারণার ব্যাখ্যা বা সূচনা করতে পারি। ঘটনাগুলি পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো-
(১) ভারের পাখি !
নব্বই দশকের শেষ দিকের ঘটনা। একদিন ভোর বেলা বাইরে থেকে ব্যায়াম শেষে আমি বাসায় এসে দেখি- আমার ড্রয়িংরুমে বসে হেলাল ভাই চা পান করছে। হাসি আনন্দের আড্ডায় আমার স্ত্রীও তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম না কখন তিনি এলেন, কখন তিনি আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হলেন ? আর কখনই বা চা পানে আপ্যায়িত হলেন ?
ব্যাপারটা পরে বুঝতে পেরেছি। হেলাল ভাইয়ের কথা বলার দক্ষতা, সরলতা, উদারতা যেকোন কঠিন মানুষকেও সাবলিল করে তুলতে পারে। তাইতো আমার বাসায়ই নয়- এই শহরের অনেক বাসারই মা-বোনেরা হেলাল ভাইকে ভালবাসেন ও শ্রদ্ধা করেন। সকাল বেলাকার এই যে শুদ্ধ ও পবিত্র থাকার গুণটি তাঁকে ভোরের পাখির মতই ক্ল্যাসিক করে তুলেছে।
(২) মুক্ত কুমিল্লা দেখার অভিজ্ঞতা
আমরা জানি ৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাঃেল কুমিল্লা শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়। এই দিনটিকে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক চোখে দেখার অভিজ্ঞতাই তার- ‘সোনার বাংলায় কুমিল্লা’ শীর্ষক কবিতায় ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন- ঝাকড়া চুলের বীর মুক্তিযোদ্ধারা, গুলি করতে করতে শহরের কান্দিরপাড়ে এসে জড়ো হয়েছে। ‘জয় বাংলা’- ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। স্বাধীনতা মানুষকে শক্তিশালী করে, সাহস যোগাযোগ নতুনভাবে বাঁচার। সেই শুভক্ষণ থেকে এগিয়ে চলার বাংলাদেশে কবি হেলাল তাই পূজ্যমান।
(৩) অকৃতজ্ঞ কবি !
কবি হেলাল অনেক কবিকেই তাঁর কবিতা বা কাব্যগন্থ উৎসর্গ করেছেন। অন্যদের প্রতি তাঁর ভালবাসা কিংবা শ্রদ্ধা থেকেই এ কাজটি করেছেন। একবার এক কবি উৎসর্গ পত্রে তার নাম দেখে কবি বিজন দা’র দোকানের আড্ডায় বলে উঠলেন-কবি হেলালের উৎসর্গ পত্রে আমার নাম মানে হলো-হেলাল এখন জীতে উঠতে চাচ্ছে!... হোঃ হোঃ হোঃ... কিন্তু বাস্তবতা হলো- সেই কবির চেয়ে অনেক বেশি সাবলিল ও পরিচিত কবি ফখরুল হুদা হেলাল। সুতরাং ঐ কবি আসলেই-অকৃতজ্ঞ।
(৪) জন্মদিনের পাগলা ডাক্তার !
একজন ডাক্তার নিজের পসরা ও প্রচারের নিমিত্তেই কবি হেলালের জন্মদিন পালন করা শুরু করলো। প্রথম দিকে বুঝা গেল কবির প্রতি তার ভালবাসা বা শ্রদ্ধা রয়েছে। পরে আস্তে আস্তে আমরা বুঝে গেলাম- সেই ডাক্তার নিজের স্বার্থেই কবি হেলালকে ব্যবহার করতেন। তার সাথে আরো কয়েকজন ডাক্তারও সামিল হয়ে কবি হেলালকে দিয়ে অনুষ্ঠান করাতেন এবং নিজেদের প্রচারে মত্ত থাকতেন। ওদিকে ডাক্তারদের নিজস্ব অনুষ্ঠানে কিন্তু কবি হেলালকে তারা খুব একটা আমলে নিতেন না। হায়রে পাগলা...
(৫) বর্তমানের সৌম্য-কান্ত কবি হেলাল
কিছুদিন আগে কবি হেলালের সাথে শিল্পকলায় একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম। শুভ্র দাড়ি, গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, স্থির দৃষ্টি আর পুরু চশমার মুখোশে তাঁকে অন্যরকমই লাগছিল। আমার পাশে ঘন্টা খানেক বসে থাকার পরও তেমন কোন কথা বলছিলেন না। কেউ দেখলে হয়তো ভাববেন-গ্রিক ভাস্কর্যের কোন দেবতা আমার পাশে বসে আসেন।
তবুও আমি আগ বাড়িয়ে কুশলাদি ও তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম। তিনি মার্জিত কিছু শব্দের প্রয়োগে সংক্ষিপ্তভাবে আমার কথার জবাব দিচ্ছেলেন।
আমি বুদ্ধি খাটিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জানতে চাইলাম পত্নিবিয়োগের পর তার একাকী জীবন কেমন কাটছে ? তিনিও মুরব্বিদের ডঙে জবা দিলেন, চলছে এক প্রকার। আমি ঠেক দিয়ে বললাম, আপনি একা, ভাবিতো নেই, আবার কি বিয়ে করবেন ?
ওনি কোন জবাব না দেওয়াতে আবার বললাম, এডভোকেট ইসমাইল সাহেব নব্বই বছর বয়সে আবার বিয়ে করতে পারলে-আপনি পারবেন না কেন ? আমার কথায় ওনার গাম্ভীর্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। ওনি যৌবন প্রিয় সরল হাসি দিয়ে বলে উঠলেন, ফাইজলামি করো।’...
(৬) যৌবনে হেলাল ভাই
যৌবনে হেলাল ভাই কেমন ছিলেন ? কতটা রোমান্টিক ভাব তার মাঝে বিরাজমান ছিল সে বিষয়ে তার বন্ধুদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতা রয়েছে। তাঁদের মতে কবি হেলালের সাথে অনেক মেয়েরই প্রেম হয়েছিল। কিন্তু প্রেমকে গভীর করতে হলে সে স্থিরতা, ধৈর্য কিংবা সময় দেওয়া তার কোনটাই হেলালের মধ্যে গঠনমূলকভাবে ছিলনা। তাইতো সাময়িক প্রেম হতো কিন্তু সেটা পরিণতির দিকে এগুতো না। তবুও তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা আছে সেগুলো গোপনই থাকা আবশ্যক।
(৭) সংসার ও প্রেমময় যাপিত জীবন
পারভীন ভাবীর সাথে বিয়ের পর হেলাল ভাইয়ের দীর্ঘ সংসার জীবন ছিল, সুখ ও শান্তিতে ভরা। আমার দেখা অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাঁদের সংসারে একজন সন্তানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আল্লাহ সেটা তাঁদের ভাগ্যে রাখেনি। হেলাল ভাইকে দেখেছি-নি:সন্তান থাকার বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলেন। তবে ভাবীর অকাল প্রয়াণ তাঁকে অসুস্থ করে ফেলে। আর এ অবস্থাতে তাঁর কাছে কবিতা আর কাব্য সংস্কৃতিই যেন বাঁচার প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। তিনি তাই বেঁচে আছেন বা থাকবেন কবিতা প্রেমিক হিসেবেই।
(৮) শরবত সমাচার ও হেলাল ভাইয়ের স্বীকারোক্তি
পানীয়র প্রতি হেলাল ভাইয়ের প্রেম ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। পানের ব্যাপারটা ছিল তার কাছে একেবারেই খোলামেলা বিষয়। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি এ বিষয়গুলো আকার-ইঙ্গিত বা প্রতীকী ভাষায় বুঝাবার চেষ্টা করতেন। ফখরুদ্দিন মইনুদ্দিনদের রাজত্বের সময়ে আমরা বিজনদার ওখানে আড্ডা মারতাম। সেখানে কোন এক সন্ধ্যায় হেলাল ভাই রিকশা নিয়ে হাজির। আমাকে দেখে বললো, ‘চলো শাসনগাছায় যাবো। এইতো যাবো আর আসবো। কয়েটা মেডিক্যাল কালেকশনের কাজ আছে। দুই ভাই গল্প করতে করতে যাবো আর আসবো।’ আমিও সরল বিশ্বাসে রাজি হয়ে গেরা। তারপর রিকশা চড়ে শাসনগাছার দিকে চললাম।
ওনি মেডিক্যাল কালেকশনের কাজ শেষে রিকশাটা থামিয়ে, আমাকে বসতে বলে একটা মার্কেটের ভিতর ঢুকলেন। তারপর নির্ধারিত কাজ সেরে রিকশায় এসে ওঠে বসলেন। আমি লক্ষ্য করলাম, হেলাল ভাই বেশ হাসিখুশি মুডে আছেন।
ফেরার পথে অনেক কথাই হলো। অবশেষে বিজনদার দোকানের সামনে এসে নামার সময় তিনি খুবই আস্তে আস্তে বললেন, ‘তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছো ?’ উত্তরে আমি বললাম, ‘প্রথমে বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝতে পারছি। বিশেষ করে গন্ধটা...’ হেলাল ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘হরি বোল!...
(৯) সাঁকো নাড়ানোর ঘটনা ও কবি হেলাল
একজন নোট বাইয়ের লেখক ঘটনাচক্রে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন। বুদ্ধি খাটিয়ে শহরের সবগুলো বড় বড় সাহিত্য পুরস্কার তার থলিতে ভরে নিলেন। অবশ্য সেই নোট বইয়ের লেখক একটু পাগলাটে স্বভাবের হলেও পাগলদেরকে তেমন একটা ভয় পাননা। তবে তিনি কিন্তু কবিদেরকে ভয় পান। আর সেই ভয়ই তাকে সারক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়।
একদিনের ঘটনা। সেই লেখক তার বড় বড় পুরস্কাগুলো একটা শান্তিপুরি ব্যাগে ভরে গ্রামের একটা সাঁকো পার হচ্ছিলো। সাবধানে এগুতে এগুতে সে, সাঁকোর ঠিক মাঝখানে এসে পৌছালো। সে সময়েই সাঁকোর বিপরীত দিক থেকে কবি হেলাল আসতে শুরু করলো। নোট বইয়ের লেখক তবুও হেলাল ভাইকে সাবধান করে দিলো, যাতে করে সাঁকো নাড়ায় !
হেলাল ভাই বললো, আমি সাঁকো নাড়াবোনা। শুধু আমার লেখা একটা কবিতা শোনাবো।
হেলাল ভাই যেই কবিতা বলা শুরু কলো- তখনি সেই লেখক নিজেই সাঁকো নাড়াতে শুরু করলো। আর তাতেই ঘটে গেলো সব বিপত্তি !...
(১০) কবি হেলাল ভাইকে কিছু প্রশ্ন
(ক) মেঘনা দেবীর নামেই মেঘনা নদী। তাই, সেই দেবীর নামে বিভাগের নাম হলে ব্যাপারটাকি মৌলবাদীরা সহজভাবে নেবে ? আপনার মতামত...
(খ) বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে যখন কোরআন-হাদিছের উল্লেখ করে পণ্যের পসারে/প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে- তখন সেটাকি কোরআন-হাদিছের অবমাননা হচ্ছে না ? আপনার মতামত জানাবেন।
(গ) টিভিতে সাবানের বিজ্ঞাপনে নারীরা যখন নগ্ন হয়ে গোসল করে-তখন কি আপনি সেটাকে নারী-স্বাধীনতা বা নারীর মর্যাদার ক্ষেত্রে অবমাননাকর মনে করেন না?
(ঘ) বীর মুক্তিযোদ্ধার ছোট ভাই হিসেবে আপনি রাজাকার, ঘাতক খুনি, দালাল ও পাকি হার্মাদদের পক্ষে যারা সংবাদপত্র প্রকাশ করে সাফাই গেয়েছে- সেইসব পত্রিকার মালিক, সম্পাদক কিংবা সাংবাদিকদেরকে আপনি ফাঁসির দাবি না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদপত্র বলে স্বীকার করেন ?
(ঙ) বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে যারা বঙ্গবন্ধুকে হেও করে আসছে- সেইসব শয়তান লেখকদেরকে আপনি কি বর্তমানে প্রগতিশীল লেখক হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছে ?
(চ) বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যারা এই কুমিল্লাতে গরু জবাই করে খাইয়েছে- আপনি কি তাদেরকে সমর্থন করেন ? কেন করেন ? ব্যাখ্যা দেবেন কি ?
(ছ) মানুষ প্রেমে পড়লে পাগল হয়ে যায় ! তারপর সেই পাগলে কী করে ? কবিতা লেখে, প্রেম করে, রস সেবন করে, ছন্নছাড়া হয়ে যায় ? নাকি ধ্যান করে ? এক কথায় জবাব দেবেন কি ?
(জ) কবিরা নাকি নরকে যাবেন ! অনেকে বলেন-কবিরা নিজেকে নবী বা ভগবান মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন- কবিরা পাগল হয়ে পাগলামীর গূঢ় রহস্য উদঘাটন করেন, আপনি কী বলেন ?
(ঝ) আপনাকে যদি কোন এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়- তখন আপনি সঙ্গে করে কী নেবেন ? বই বা কিতাব ? দোয়াত-কলম? কাঁথা-বালিশ ? বিষ ? সরবতের বোতল ? মেডিসিন ? এরশাদের কবিতা সমগ্র ? নাকি একাত্তরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকা ?
(ঞ) আপনাকে যদি একদিনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়- তখন আপনি কোন কাজটি করবেন ? (১) সামরিক শাসন বিলুপ্ত করে-বাজেট কমিয়ে দেবেন ? জেলা প্রশাসকদেরকে শাসক বা স্বৈরাচার থেকে প্রশাসক বা জনগণের সেবক বানিয়ে ছাড়বেন ? নাকি বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করবেন ? অথবা বিয়ে করবেন ? কোনটা ?...
(ট) আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন ? দেশকে ? প্রেমকে ? টাকা অথবা নারীকে, স্মৃতিকে, নজরুলকে রবীন্দ্রনাথকে, রুদ্রকে, পাগলা ডাক্তারকে নাকি ফটক সীমা রামকে ?
(ঠ) সাবানের বিজ্ঞাপনের কোন নারী যদি সারা শরীরে সাবানের ফেনা দিয়ে পোশাক বানিয়ে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুধু আপনাকেই বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন আপনি তাকে কী বলবেন ? নাকি তাকে নিয়ে কবিতা লিখে সাবানের ফেনা দূর করে দেবেন ?
(ড) মানুষকে মরে যেতে হয়। ধরুন-আপনি মরে গেলেন। তারপর আবার খোদার ইচ্ছায় জীবিত হয়ে গেলেন। আর জীবিত হয়েই কি আপনি কবিতা লিখবেন ? নাকি কৃষ্ণ-হরিণীর মতো শীৎকার করতে থাকবেন ?
(ঢ) আপনার কাছে কৃষ্ণ, হরি, রাম, বুদ্ধ, ভগবান অথবা খোদা, কে বড় ? লা-শরিক আল্লাহ বলতে আপনি কী বুঝেন ?...
উপসংহার
কবি ও সংগঠক ফখরুল হুদা হেলাল আমাদের সময়ের একজন ভিন্ন মাত্রার আঙ্গিক ও প্রকরণবাদী মানুষ। কবিতার নানা সত্যকে আবিষ্কার (উরংপড়াবৎ!) করার চেষ্টা করতে করতে তিনি নিজেই একটি কবিতা হয়ে গেছেন। তাইতো তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে হবে খু-উ-ব সাবধানে। আমরা জানি, কথাকার সেলিনা হোসেন যেমন মামুন সিদ্দিকীর গল্পকে বলেছেন- ‘হয়ে উঠার গল্প’... ঠিক তেমনি কবি হেলালের কবিতাও তাঁর বিকশিত স্বকীয়তায় নিজস্ব ঘরানায় চলমান। ছান্দোসিক মনন ও প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি বা তাঁর উত্তরসূরিরা প্রাগ্রসর হবেন এটাই শেষ প্রত্যাশা।