
জুলফিকার নিউটন ||
২
জীবনের সঙ্গে আর্টের অতি নিবিড় সম্বন্ধ। কখনো জীবন আর্টকে প্রভাবিত করে, কখনো আর্ট জীবনকে। সেই জন্যে আমার সাহিত্য জিজ্ঞাসা আমার জীবন জিজ্ঞাসার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে এসেছে। একটা অপরটার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তা বলে একটা অপরটার অধীনও নয়। আর্ট আর আর্টিস্ট চিরদিন স্বাধীন। তবে রিয়ালিটি আমার মনের মত না হলে আমি তাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছি। জীবনে না হোক, সাহিত্যে। সেই জন্যে আমি একজন বাস্তববাদী সাহিত্যিক হতে পারিনি, হয়েছি একজন পান্থজনের সখা। তা বলে সাহিত্যের আদর্শকে খাটো হতে দিইনি। সেখানে আমি অতন্ত্র প্রহরী।
মনে প্রাণে আমি টলস্টয় ও রবীন্দ্রনাথ অনুসরণ করি। শুধু রাজনীতি বাদে। আমার জীবনযাত্রা ভুলে ভরে যায় না। আমারতো মনে হয় আমি ঠিক পথেই চলেছি। কিন্তু প্রশ্ন করা হলো, জীবনের আমূল পরিবর্তন হলে আর্টের কি আমুল পরিবর্তন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নতুন করে ভাবতে হয় কেমন করে লিখব, কী লিখব, কার জন্য লিখব, কিসের জন্য লিখব, লিখে স্বার্থকতা কী। জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে আর্টকেও আমি সরল, নিরাভরণ ও অকপট করি, ছলছাতুরী ছাড়ি, উজ্জ্বলতা পরিহার করি। জীবনে ক্ষমতা জিনিসটা মন্দ বলে আর্টেও ক্ষমতা বিসর্জন দেই। এক একটি বাক্য হয় এক একটি সূত্রের মতো সংক্ষিপ্ত। সারটাই আসল। ধারটা কিছু নয়। ভারটা তো বাহুল্য। আর্ট হয়ে দাঁড়ায় আর্টলেস। তাতেও আমার খেদ ছিল না। কিন্তু দেখা গেল সৃষ্টির আগুন নিভে আসছে। যে আগুন শিল্পীসত্তার আদি বহ্নি।
আমি লোক সংস্কৃতির ভিতরেই ভাবী সংস্কৃতির সম্ভাব্যতা নিহিত দেখি। হাজার হাজার বছর ধরে সে সংস্কৃতি অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বহমান থেকেছে বাংলার নিভৃত পল্লীর জনমানসে। পার্লামেন্টের বা বঙ্গভবনের, মেঘনার বা যমুনার ধার ধারেনি। আমি তার স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কালের সঙ্গে তাল রেখে চলা কি তার পক্ষে সম্ভব। আমরা যাঁরা যুগসচেতন বিজ্ঞানসচেতন তারা কি লোকসংস্কৃতির প্রকৃত রূপে গ্রাম্যরূপে তৃপ্ত হতে পারব? আমরা কি তাকে সংস্কৃত করতে চাই সভ্য করতে চাই সেও কি আমাদের হস্তক্ষেপ সইতে পারবে? তাহলে কি আমরা শিক্ষিত বিদ্যা ভুলে যাব? প্রকৃতির কাছে পাঠ নেব? মাটির সন্তান হয়ে হাল ধরব, দাঁড় বাইব, কাপড় বুনব? বঙ্গবন্ধুর মনে কথাটা ছিল তাই। কিন্তু আমার মনের কথাটা তা নয়।
জীবনের আমূল পরিবর্তন এখনো ঘটেনি, যদিও এখন আমি পঞ্চান্নতে পড়েছি। কিন্তু এতোদিনে আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি যে জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটলেও আর্টের আমূল পরিবর্তন ঘটেনা। ঘটা উচিতও নয়। জীবনের সঙ্গে আর্টকে মেলাতে গেলে সে তার নিজের লক্ষ্য ভেদ করতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য আর আর্টের লক্ষ্য এক নয়। মানুষ হিসাবে ভালো হতে চাওয়া নিশ্চয়ই ঠিক, কিন্তু মানুষ হিসাবে ভালো হতে গিয়ে শিল্পী হিসাবে মন্দ হওয়া একেবারেই ভুল। জীবনযাপনের ধারায় মারাত্মক ভুল ছিল বলে তার সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু অশুদ্ধ জীবনেও আমার ভিতরে যে সৃষ্টির আগুন দিনরাত জ্বলছিল সে আগুন যদি শুদ্ধ সাত্ত্বিক ত্যাগময় জীবনে একটু একটু করে নিভে যায় তবে সেটাওতো হবে মারাত্মক ভুল। যেখানে জ্বালা নেই, সেখানে সৃষ্টি নেই। শিখা অনিবার্ণের মতো জ্বলতে হবে আমাকেও, আমিও যদি বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে চাই। স্রষ্টার স্বধর্ম সৃষ্টিশীল হওয়া। স্রষ্টার কর্তব্য সৃষ্টির আগুনকে জ্বালিয়ে রাখা। সেক্ষেত্রে তো মারাত্মক ভুল হয়নি। আমূল পরিবর্তন করতে হয় জীবনে করব, আর্টে কেন?
বহুবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর উপলব্ধি করি যে আমার শিক্ষা জীবনের সেই সব মূল প্রত্যয় মোটের উপর ঠিকই ছিল। আরো ভালো লেখার খাতিরে যখন যেটুকু পরিবর্তন আবশ্যক হবে তখন সেটুকু করলেই চলবে। কিন্তু লেখা যদি আরো ভালো না হয় তবে পরিবর্তন নিরর্থক। ভালো এক্ষেত্রে নীতির বিচারে নয়, রসের বিচারে, রূপের বিচারে। আমার ওপরে পড়েছে রসের দায়। রূপো দায়। অন্য কথায় সত্যের দায়, সৌন্দর্যের দায়। এর উপরে রূপদর্শীয় দায় যদি চাপে সে ভার বইতেও আমি রাজি। কতবার বইতে হয়েছে। কিন্তু তার পর যেন আর্ট চাপা না পড়ে। জগতের ভালো করতে গিয়ে আর্টের মন্দ করতে আমি অনিচ্ছুক। আমার আর্টিস্ট সত্তাকে আমি রক্ষা করব।
সমাজ সম্বন্ধে আমি এত কম জানতাম যে আমার পক্ষে সামাজিক উপন্যাস হাত দেওয়া ধৃষ্টতা। নিজেকে জেনে কবিতা লেখা যায়, কিন্তু উপন্যাস লিখতে হলে সমাজকে জানতে হয়। বিশেষত পরের জীবনকে। দশখানা উপন্যাস পড়ে একখানা উপন্যাস লিখতে সকলেই পারে, কিন্তু নিজস্ব জ্ঞান ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে তেমন উপন্যাস যেন কাগজের ফুল। আমি কাগজ দিয়ে কাগজের ফুল বানাতে চাই না, আমি ফোটাতে চাই জীবনের ফুল। তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
ছেলেবেলা থেকে দুটো জিনিসকে বড় বলে জেনেছি, একটা হচ্ছে নরনারীর প্রেম আর একটা হচ্ছে নিজের প্রেম। নরনারীর যে প্রেম, তা সারাজীবন ধরে সাধনা করলেও শেষ হয় না। নর আর নারী-তারা হচ্ছে মানব-মানবী, তারা দুটি আত্মা। আমি ও আমার প্রিয়া আমরা যেমন দুজন, তেমন আমরা একই সত্তার দুটি দিক, আমাদের মধ্যে একটা একাত্মতা রয়েছে। সেই একাত্মতা দেহে-দেহে, মনে-মনে, আত্মায়-আত্মায়। দেহের মিলনই সব নয়, তাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, আরও একটু গভীরে যেতে হবে, আরও একটু উপরে উঠতে হবে। সেটাই লক্ষ্য। সেটাই প্রেমের আদর্শ। তা কার জীবনে কতটুকু সম্ভব বলা যায় না, তবে চেষ্টা করা যেতে পারে। আমি নিজে সম্পূর্ণ হই বা না হই, আমার প্রিয়া সম্পূর্ণ হন কি না হন, আমি বিশ্বাস করি, ইটার্নাল বলে একটা কিছু আছে। তা কী সেটাই আমার প্রশ্ন, সেটাই আমার ধ্যান। গল্পে উপন্যাসে তাকেই আমি ধরতে চেয়েছি। এই শ্বাশ্বত প্রেমের অন্বেষনে আমি নিয়োজিত আছি, এই-ই আমার অণ্বেষা।
আমার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। গোড়ার দিকে আমার ধারণা ছিল সাহিত্যসৃষ্টির মূল উপকরণ হলো হৃদয়ের অনুভূতি। সাহিত্যের হৃদয় থাকা চাই আর সে হৃদয় অনুভূতি দিয়ে ভরে ওঠা চাই। যার হৃদয় নেই বা থাকলেও অসাড় সে সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না, করতে পারে বাক্যবিস্তার। সে ধরনের সাহিত্যিক হতে আমি চাইনি। আমি হতে চেয়েছি এমন একজন সাহিত্যিক হৃদয়ই যার প্রধান অবলম্বন। কিছুদিন সাহিত্য চর্চার পর বুঝতে পারলাম যে হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইলেও প্রকাশ করা যায় না। তার কতক তো অনির্বচনীয়। হাজার চেষ্টা করলেও প্রকাশ করা যায় না। আভাসে ইঙ্গিতে প্রকাশ করতে হয়। কতক আবার প্রকাশের অযোগ্য। লোকে পছন্দ করে না। লোকে পছন্দ করলেও সাধুসজ্জনরা অনুমোদন করেন না। অনির্বচনীয় আর অপ্রকাশযোগ্য এই দুই চড়ার মাঝখানে দিয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে হয়। যারা কুশলী নাবিক তাঁরাই সফল হন। অন্যেরা বিফল।
কুশলী সাহিত্যিকরা অনুভূতির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে কল্পনা মিশিয়ে দেন। এমন কৌশলে পরিবেশন করেন যে মনে হবে কল্পনাটাই বাস্তব। এ বিদ্যা আয়ত্ত করব না বলেই স্থির করেছিলাম। জীবনে হয়তো একখানামাত্র বই লিখব, সেখানা হবে আকারে আয়তনে ছোট। যদি বাঁচি তো সেই একখানার জোরেই বাঁচব। হয়তো একখানা বইও হবে না, হবে কয়েকটি খুচরো কবিতা, খুচরো গল্প। কিন্তু আমার নিজের উচ্চাবিলাশ ও আমার উপর আমার সম্পাদকদের বিশ্বাস আমাকে টেনে নিয়ে যায় সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকার অঙ্গনে। সেখানে আর দশজনের সঙ্গে আমারও অলিখিত প্রতিযোগিতা। লিখতে হবে এমন কিছু যা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাঁরা আমার যোগ্যতা সম্বন্ধে সচেতন হবেন।
একটু একটু করে আমাকেও মানতে হলো যে, লোকে যদি তা হলে আর লিখে সুখ কী! লোকে যাতে পড়ে তার জন্যে লেখাটাকে পঠনীয় করতে হবে। কিন্তু তা করতে গেলে যদি আমি আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের থেকে ভ্রষ্ট হই তা হলেই বা লিখে সার্থকতা কী! আবার পড়ে যেতে হলে দুই চড়ার মাঝখানে। নৌকা চালিয়ে যেতে হলো কুশলী নাবিকের মতো। সে এক যন্ত্রণা। লেখাকে পঠনীয় করতে গিয়ে আমার বিশ্বাস আমি লক্ষ ভ্রষ্ট হইনি। নৌকাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমার বিশ্বাসই চূড়ান্ত নয়। পাঠক-পাঠিকার বিচারটাই চূড়ান্ত।
পড়ার বিষয়ের তো অন্ত নেই। আমি যে শুধু উপন্যাস পড়ি তা নয়, নাটক পড়ি, আত্মজীবনীমূলক লেখা পড়ি, ইতিহাস গ্রন্থ পড়ি এবং ধর্মীয় গ্রন্থও প্রচুর পড়ি। সকল ধর্মের গ্রন্থই পড়ি। তবু অতৃপ্তি থাকে, মনে হয় অনেক কিছুই পড়া হলো না। কিন্তু সময় তো অফুরন্ত নয়। আমাকে আমার নিজস্ব সময় সীমার মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। তবু ইচ্ছার আনন্দ নিয়ে নতুন কোন বই পেলে হাতে তুলে নেই। জীবন একজন মানুষকে যতটা সময় দেয়, ততটা সময় যদি কেউ গ্রন্থ পাঠে নিযুক্ত রাখতে পারে নিজেকে তাহলে অনেক পেল। তবে আমার সুখ এখানেই যে, আমি যা পড়ি তা পাঠককে জানিয়ে থাকি, যেন পাঠক আমার আনন্দে আনন্দিত থাকে।
আমার লেখার মধ্যে আমার রূপ ও আমার বাণী নিহিত। কেউ যদি আমার লেখা পড়েন তা হলে সেই আমার সম্বর্ধনা। তাতেই আমার সম্মান। অন্য, কোনো সম্বর্ধনায় আমার মান বাড়ে না। যেটা বাড়ে সেটা
vanity. Appearance আর
Reality এক জিনিস নয়। আমরা লেখকরা
appearance-কে নিয়ে এত ব্যস্ত যে
Reality-র খোঁজ নেবার সময় পাইনে।
Appearance-কেই
Reality বলে ভ্রম করি। এই ভ্রমের উপর আমাদের অধিকাংশ লেখা দাঁড়িয়ে। এরও একটা যাদু আছে। কিন্তু কিছুকাল বাদে সে যাদু মিলিয়ে যায়। যারা
Realityর বার্তা দেয়।
সহিত্য একপ্রকার সৃষ্টি। সৃষ্টিধর্মী রচনাকেই সাহিত্য বলা হয়। সাহিত্যও
Realityএর বার্তা দেয়। এমনভাবে দেয় যা ধর্মগ্রন্থও দিতে পারে না। তার জন্যেই চাই
Appearance-কে ভেদ করা। এর জন্যে যেতে হবে প্রকৃতির রাজ্যে, বনে জঙ্গলে, মরুভূমিতে সমুদ্রবক্ষে পবর্তশৃঙ্গে, অন্তরীক্ষে। এর জন্য যেতে হবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পরিবারে, পরিবারের বাইরে নর-নারীর মিলনে বিরহে। এর জন্য যেতে হবে, জীবনের বিচিত্র বিভাগে, যুদ্ধক্ষেত্রে, রাজনীতির ময়দানে, কলকারখানায়, ধানখেতে, কয়লাখনিতে, কুখ্যাত পল্লীতে, শ্রমিক বসতিতে, বড়লোকদের ক্লাবে, জুয়ার আড্ডায়, বৈজ্ঞানিকদের ল্যাবরেটরিতে, দার্শনিকদের গবেষণাগারে, সন্ন্যাসীদের মঠে, যোগীদের আশ্রমে বৈষ্ণবদের আখড়ায়, বাউলদের আস্তানায়।
নিজের অন্তরের মধ্যেও অন্বেষণ করা যায়। যা আছে ব্রহ্মান্ডে তাই আছে ভান্ডে। প্রত্যেকটি ব্যক্তিই এক একটি বিশ্ব। কবিরা যাকে ‘আমি’ বলেন, সে ‘আমি’ কি দৃশ্যমান একটি মানুষ যাকে ফোটোগ্রাফে ধরা ছোঁয়া যায়? সে ‘আমি’ অসীম, অপার্থিব, অবর্ণনীয়। তার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে অজস্র
lyric রচনা করা হয়েছে। ছোট গল্প লেখা হয়েছে।
Personal
essays লেখা হয়েছে। তবে অজস্র নাটক, উপন্যাস, মহাকাব্য লেখা হয়নি। যেখানে লেখা হয়েছে সেখানে লেখকের ‘আমি’ প্রচ্ছন্ন। আমার উচ্চাবিলাশ এখনো অপূর্ণ। এমন কিছু লিখিনি যা
Classic রূপে কালজয়ী হবে। কিন্তু যতদিন শ্বাস ততদিন আশ। স্বধর্মে অধিষ্ঠিত হওয়াটাই আসল। সে বিষয়ে আমি সজাগ।
চলবে...