
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মহার্ঘ্য স্বাধীনতা ও
বিজয়ের ৫০ বছর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী
একসঙ্গে পালনের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী পুরো দেশবাসী, আরও গৌরবের দেশের
নতুন প্রজন্মের। কেননা তারা এখন স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে, হাজার
বছরের শৃঙ্খলিত একটি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন মানচিত্র উপহার
দিতে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পারছে। ঘৃণা-ধিক্কার জানাচ্ছে
একাত্তরের ঘৃণ্য স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসর কুলাঙ্গারদের।
বিজয়
তো ছিল আনন্দ, উল্লাস ও গৌরবের। সঙ্গে আপনজনকে হারানোর বেদনা, কান্নার।
তবে বিজয়ের ৫০ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা
এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। অতীত নরহত্যাসহ ঘৃণ্য কৃতকর্মের কারণে বাঘা বাঘা
কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে। আরও ক’জনের সামনে ঝুলছে
ফাঁসির দড়ি। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জেগে উঠেছে এক অন্যরকম দেশপ্রেমে,
গণতান্ত্রিক চেতনায়।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সে এক উন্মাদনার সময়। হত্যা ও
ধ্বংসের বিভীষিকায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে মুক্তিপাগল বাঙালী। চারিদিকে
বিজয়ের রণধ্বনি। রক্তক্ষরা ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার আকাশ পুরোপুরি
মিত্রবাহিনীর দখলে। পাকবাহিনীর সকল জঙ্গী বিমান নিঃশেষ হয়ে যায়। দেশের
বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে আসতে থাকেন।
সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান।
এ সময়
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে রাজনীতির এক নতুন প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে যুদ্ধরত
বাংলাদেশ। কামান-গোলাসহ মারণাস্ত্রের সামনে যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে
বাংলার মুক্তিসেনাদের সম্মুখযুদ্ধ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় গোটা পৃথিবী। বিশ্ব
রাজনীতির খেলায় ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে বর্বর রাষ্ট্র পাকিস্তান।
জাতিসংঘে উত্থাপিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবও নাকচ হয়ে
যায়।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বাঙালীর সম্মুখযুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ে
পায়ের তলা থেকে মাটিও সরে যেতে থাকে পাক হানাদারদের। তার ওপর ভারতীয়
মিত্রবাহিনীর শাণিত আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা। ইয়াহিয়া
বুঝতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পাকিস্তান পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন কূটকৌশলে কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু
করে।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায়
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। পাকিস্তানকে রক্ষায় নগ্ন উদ্যোগ
নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একাত্তরের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি
কার্যকর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পেশ
করে। এ প্রস্তাবের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য
প্রত্যাহারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করে।
নিরাপত্তা
পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও
পোল্যান্ড এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, তবে ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে মত
দেয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। এমনই পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি
যাতে পাস হতে না পারে সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো
প্রদান করায় প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানের শেষ প্রত্যাশাটুকুও নিঃশেষ
হয়ে যায়। সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান।
অন্যদিকে
পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্ত
হস্তে সবাইকে দান করার আহ্বান জানান। পাকিস্তানী সেনাপ্রধান অন্য এক
ঘোষণায় অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সব সৈনিককে নিকটস্থ
রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য আবার নির্দেশ দেন। বাঙালীর জন্মভূমি
আদায়ের লড়াইকে আড়াল করতে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে বেতারে ঘোষণা দেন
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই বাঙালীকে দাবিয়ে রাখা
যায়নি। মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে তারা মরণপণ লড়াই চালিয়েই যান। একদিকে
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ যুদ্ধ, অন্যদিকে
মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ। প্রাণ বাঁচাতে পাক হানাদাররা বীর বাঙালীর
কাছে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধের আজ তৃতীয় দিন।
মিত্রবাহিনী পুরোপুরি দখলে নেয় ঢাকার আকাশ। ভারতীয় বিমানবাহিনীর লাগাতার
আক্রমণে দিশেহারা পাকবাহিনী। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় পঞ্চাশ টনেরও বেশি বোমা
ফেলে। রানওয়েতে ২০ ফুট চওড়া গর্তের সৃষ্টি হয়।
জামালপুর ব্রিগেড
হেডকোয়ার্টার, ঝিনাইদহ, সান্তাহার, ময়মনসিংহ ইয়ার্ড মিত্রবাহিনীর আক্রমণে
ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা, কুমিলা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন
অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। বাংলার উন্মুক্ত
আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান অবাধে বিচরণ করে। জামালপুরে বিমান হামলায় কয়েকশ’
পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের চারিদিক থেকে বিজয় দেখে
এগিয়ে যায়। মিত্রবাহিনীর বিজয় দেখে জেনারেল নিয়াজী পাকিবাহিনীকে পেছনের
দিকে সরে আসার নির্দেশ দেন। ভারতের অকৃত্রিম সাহায্য সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক
সফলতা বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
একমাত্র
স্বাধীনতার শত্রুরা ছাড়া প্রতিদিনই নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন
রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে স্মরণ করছে প্রিয়
মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, ঘৃণা-ধিক্কার
জানাচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু এ দেশীয় রাজাকার, আলবদর ও মানবতার শত্রু
যুদ্ধাপরাধীদের।