
হুমায়রা সুলতানা ||
করোনা
অতিমারি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে শিশুদের ওপর। শিশুরা তাদের শৈশব
হারিয়েছে, হারিয়েছে স্বাভাবিক বিকাশের গতি, লেখাপড়ার সুযোগ। করোনার থাবায়
বিশাল অংশের শিশুকে যুক্ত হতে হয়েছে কাজে, আর ততোধিক কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে
হয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আরও একটি আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার
দিবস ও জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহের দিকে। বাংলাদেশে প্রতি অক্টোবরের প্রথম
সোমবার বিশ্ব শিশু অধিকার দিবস ও সপ্তাহব্যাপী জাতীয় শিশু অধিকার পালিত হয়।
দারিদ্র্যপীড়িত
পরিবারগুলো শুধুই যে অসচ্ছলতার জন্য শিশুদের কাজে নিয়োগ বা বাল্যবিয়েতে
বাধ্য করে তা কিন্তু নয়। ছেলে শিশুর জন্য পরিবার ভাবনায় থাকে শিশুটি অসৎ
সঙ্গে জড়িত হয়ে মাদক সেবন, অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে কিনা। বাবা-মা
ভাবেন মূলত কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে শিশুটি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হবে না এবং
আর্থিক সমর্থনও পাওয়া যাবে। এই চিন্তাই করোনা পরিস্থিতিতে অধিক মাত্রায়
শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করেছে। অন্যদিকে, কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে সামাজিক
নিরাপত্তা, অপরাধচক্রের ফাঁদে পড়া, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক এড়াতে বাবা-মা
বিয়েকেই শ্রেয় মনে করেন, যা করোনাকালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
শিশুশ্রম
বা বিয়ে ছাড়া অন্যান্য যে কারণে শিশুরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে সেগুলো হলো,
অনলাইন বা টেলিভিশনভিত্তিক লেখাপড়ায় একমুখী শিখনে পাঠ বুঝতে অসুবিধা,
বাড়িতে পড়ালেখায় সহায়তার কেউ না থাকা, ডিভাইস না থাকা, শিখন শূন্যতা অধিক
হারে হয়ে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারানো। কারণ যাই হোক, শিশুদের বিদ্যালয়ে
প্রত্যাবর্তন এখন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যারা কাজের সঙ্গে
যুক্ত হয়েছে এবং যাদের বিয়ে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, কাজের সঙ্গে যুক্ত
শিশুদের ফেরানো গেলেও বিবাহিত শিশুদের ফেরানো দুস্কর হবে। অভিভাবকের সঙ্গে
আলোচনার মাধ্যমে শ্রমে যুক্ত শিশুদের ফিরিয়ে আনা গেলেও, বিবাহোত্তর
কন্যাশিশুদের বাবা-মা তাদের সন্তানকে অন্য বাড়ির আমানতই মনে করেন। এ
ক্ষেত্রে শিশুটির বৈবাহিক পরিবারকে কতটুকু অ্যাডভোকেসির আওতায় আনা যায় তা
চিন্তার বিষয়। আমরা হাল ছাড়ব কেন?
এবার আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের
প্রতিপাদ্য বিষয় 'ডিজিটাল জেনারেশন, আওয়ার জেনারেশন'। আমরা যখন ডিজিটাল
বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, এই প্রতিপাদ্য যেন আমাদের জন্য হয়ে
ওঠে সম্ভাবনার। আর সেটা ঝরে পড়া শিশুদের বাদ রেখে নয়, তাদের নিয়েই। প্রশ্ন
ওঠে, তাহলে কী করা যেতে পারে বিয়ের শিকার শিশুদের জন্য। প্রথমেই যা উচিত তা
হলো, এই শিশুদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়া। একজন শিশু জন্ম দেবে আরেক
শিশুর। তাই রিপ্রোডাকটিভ হেলথ নিয়ে কথা বলতে হবে তার নতুন পরিবারের সঙ্গে।
কথা বলার এবং অ্যাডভোকেসি করতে হবে এই পরিবার অর্থাৎ কন্যা বিসর্জন ও অর্জন
করা দুই পরিবারকে নিয়ে যাতে তার লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নির্মাণ বন্ধ না হয়।
সুযোগ পেলে কেন এবং কীভাবে সেই শিশুটি উভয় পরিবারের জন্য আশীর্বাদ হতে
পারে, তা তাদের বোঝাতে হবে।
এলাকাভিত্তিক শিশু ও যুবসমাজ পিয়ার টিউটোরিং
ও রেসপনসিবল সিটিজেন হিসেবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে
কাভারেজের বাইরে থাকা শিশুদের শিক্ষা, রিপ্রোডাকটিভ হেলথ রাইট নিয়ে কাজ
করতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক বেসরকারি সংগঠন এ বিষয়ে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে
কীভাবে একত্রিত হয়ে এক ছাতার নিচে অধিক কাভারেজ নিশ্চিত করা যায় তা ভাবতে
হবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন বন্ধ ছিল, তখন এই উদ্যোগ অনেক
শিশুর শিক্ষা অব্যাহত রেখেছে। যে কোনো সময় আবারও এই ধরনের পরিস্থিতির
সম্মুখীন হতে হলে যাতে কাভারেজের বাইরে কোনো শিশু না যায় তার জন্য
সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে
এই শিশুদের কীভাবে আত্মবিশ্বাসী করা যায় এ ব্যাপারেও ভাবতে হবে।
একজন
ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশনস কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি, টার্গেট গ্রুপকে ধরতে
হলে সব সম্ভাব্য পথ ব্যবহার করতে হবে। জেনারেশন 'জেড'কে ধরার উপায় সোশ্যাল
মিডিয়া। আমাদের দেশে সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে যেগুলো অধিক জনপ্রিয় সেগুলো
হলো- ফেসবুক ও টিকটক। আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা চার কোটি ৬০
লাখ। অন্যদিকে, টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি যা গত বছরের
চেয়েও ৭০ শতাংশ বেশি। এই প্ল্যাটফর্মগুলো যেহেতু নগর ও গ্রামাঞ্চলের শিশু ও
যুবদের মধ্যে জনপ্রিয়, তা দিয়েই টার্গেটিং অনেক সহজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
কমতে থাকা ধৈর্যের সময়সীমায় নিরীক্ষায় উঠে আসে, ডিভাইস ব্যবহারকারীদের
প্রতি কনটেন্টের জন্য সর্বোচ্চ সময় ব্যয় ২০ সেকেন্ড। এই ২০ সেকেন্ডের
মধ্যে তার মাঝে আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলে সে স্ট্ক্রলিংয়ে চলে যায়। সে
ক্ষেত্রে ছোট ছোট ক্রিয়েটিভ ভিডিও ইনফোটেইনমেন্ট অর্থাৎ তথ্য ও বিনোদন যোগে
কনটেন্টের মাধ্যমে তাদের অ্যাপ্রোচ করার পথ খুঁজতে হবে। বিহেভিয়ার চেঞ্জ
করার বড় একটা ফান্ডা হলো মানুষকে প্রথম ধাক্কা এমনভাবে যাতে সে অনুধাবন করে
তার আচরণের অনভিপ্রেত বিষয়গুলো। তারপর প্রাত্যহিক জীবনে একটু একটু
পরিবর্তন। শিশুদের জন্য ভাবতে গিয়ে বিবাহিত শিশুদের কথা ভুললে চলবে না।
তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে পুনর্বাসন করে নতুনভাবে পথ চলায় সহায়তা করতে
হবে। শিশু বাজেটে তার পরিপূর্ণ প্রকাশ থাকতে হবে। কভিডের সঙ্গে পথচলায়
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে
টেলিকম করপোরেটসদেরও এগিয়ে আসতে হবে, ভাবতে হবে ইনোভেশনের কথা, ছন্নছাড়া না
হয়ে একসঙ্গে। তবেই সত্য হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্টম্ন, প্রস্ম্ফুটিত
হবে শিশুদের সম্ভাবনা। কোনো উন্নয়ন, কোনো শিশুকে ছেড়ে নয়।
লেখক: উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ