
মাহফুজুর রহমান ||
ঈদ
আসছে। ঈদুল আজহা। সহজ ভাষায় আমরা বলি কোরবানির ঈদ। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও
পেশার মানুষ বছরব্যাপী তাকিয়ে থাকে দুটো ঈদ উদযাপনের জন্য। ঈদের বেশ আগেই
গরিব-ধনী সবার ঘরেই একটা হৈ হৈ কা- রৈ রৈ ব্যাপার শুরু হয়ে যায়। কোরবানির
ঈদের আগে শুরু হয় গরু কেনা নিয়ে আলোচনা। কেউ বেশি দামে গরু বিক্রি করে লাভ
গুনবেন- এই স্বপ্নে বিভোর থাকেন। কেউ ভালো একটা গরু কিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জন করার স্বপ্ন দেখেন। কেউ অনেক টাকা খরচ করে দেখার মতো একাধিক গরু বা
অন্য পশু কিনে এলাকার মানুষজনের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আর গরিব
মানুষরা? বছরব্যাপী মাংস না খেতে পেলেও ঈদের সময় পেট ভরে মাংস খাওয়ার
স্বপ্ন দেখেন। কেউ আবার মাংস সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখেন যাতে দীর্ঘদিন খাওয়া
যায়।
এবারের ঈদের অবস্থা কী হতে যাচ্ছে? করোনা ভাইরাসের জন্য গত তিনটি
ঈদ আমরা মনের মতো করে করতে পারিনি। দেশ যখন দারিদ্র্যের শেকলে আষ্টেপৃষ্ঠে
বাধা ছিল তখনকার ঈদের সঙ্গে এখনকার ঈদের একটা মৌলিক পার্থক্য ইতিপূর্বেই
সূচিত হয়েছে। ঘরে ঘরে কোরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। বেশি করে নতুন
পোশাক আর বিলাস সামগ্রী কেনার রেওয়াজ চালু হয়েছে। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য
যে অনেক বেড়েছে তা করোনাপূর্ব ঈদগুলোতে তাদের কেনাকাটা দেখেই বোঝা যেত।
কোরবানির ঈদের আগে গ্রামগঞ্জে শুরু হয়ে যেত ফ্রিজ কেনার ধুম। এটাও তো
আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধিরই লণ।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর
অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের ব্যবসা বন্ধ
হয়নি তারাও বেশ দুর্দশার শিকার হয়েছেন। শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ চলে গিয়েছেন
গ্রামে। কারণ শহরে আগের মতো কাজ নেই। তাদের যা আয় হয় সেই টাকা দিয়ে সংসার
চলে না। গ্রামে গিয়েও তারা কোনো কাজ পাচ্ছেন না। হা-হুতাশ করে সঞ্চিত টাকা
দিয়ে সংসার চলছে। কেউ কেউ নতুন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করছেন।
এত
আশা-নিরাশার ভেতর করোনা ভাইরাসের আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। দেশব্যাপী করোনা
ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামগঞ্জে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা
হচ্ছে, যারা নীরবে ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। যারা পরীা করাচ্ছেন তাদের
অনেকেই পজিটিভ হচ্ছেন। এ রকম একটি দুঃসময়ে ঈদ এসেছে। আগামী ১৫ জুলাই থেকে
স্বাস্থ্যবিধি (!) মেনে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য সাময়িকভাবে লকডাউন তুলে
নেওয়া হচ্ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। যত বাধাই থাকুক, এ
দেশের মানুষ ঈদে গ্রামে যাবে। সরকার পথঘাট খুলে না দিলে অপথে বা বিপথে
হলেও যাবে। রাস্তায় যত বিপদই থাক, যাকেই উৎকোচ বা জরিমানা দিতে হোক না কেন,
মানুষ যাবেই। এ বিবেচনায় রাস্তাঘাট খুলে দেওয়াই ভালো।
লকডাউন, কঠোর
লকডাউন ইত্যাদি যাই দেওয়া হোক না কেন, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর যত কঠোর
আয়োজনই থাকুক না কেন, দেশের মানুষ সচেতনভাবে কিছু মেনে না নিলে তা
বাস্তবায়ন করা একান্তই কঠিন। অন্যদিকে ঘরের ভেতর চুপটি করে বসে থাকার মতো
আর্থিক সঙ্গতি অনেকের নেই- এ কথা আমরা সবাই জানি। অনেকেই হয়তো নেহাতই পেটের
দায়েই ঘর থেকে বের হন।
এবার আসা যাক, গ্রামে গিয়ে আমাদের ঈদ উৎসব আমরা
কীভাবে পালন করব? যারা কোরবানি করতে চাইবেন তাদের গরু বা ছাগল কিনতে হবে।
আর এই গরু বা ছাগল কেনার জন্য তাদের যেতে হবে হাটে। এখানে স্বাস্থ্যবিধি
মানার উপায় কী? উপায় যে নেই, তা নয়। গ্রামে অনেকগুলো গরুর হাট বসানো এবং
দূরত্ব বজায় রাখা একটি উপায় হতে পারে। আবার গরু কোরবানি করা এবং মাংস বিতরণ
করার সময়ও যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। গ্রামে গিয়ে অহেতুক
অপ্রয়োজনে বাজার করতে যাওয়া বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন
নেই। আমরা যদি মনে রাখি যে, সরকারের এই বদান্যতা কেবল বৃদ্ধ বাবা-মায়ের
সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির জন্যই প্রদত্ত হয়েছে তা হলে ভালো হয়।
করোনা
মহামারীর এই কুণেও অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে যা অর্থনীতির
গতিধারায় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমেই আসা যাক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল
সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং প্রসঙ্গ। মহামাররী প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসেই মোবাইল
ব্যবহার করে লেনদেন করতে পারছে। বাংলাদেশে মোট ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং
সার্ভিস প্রদান করছে। গত মার্চ, ২০২১ মাসে এ খাতে রেজিস্টিকৃত গ্রাহক
সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৬৪ লাখ, যাদের মধ্যে পূর্ববর্তী ৩ মাসে লেনদেনে অংশ
নিয়েছেন ৩ কোটি ৬৭ লাখ গ্রাহক। এই মাসে তারা মোট লেনদেন করেছেন ৩০ কোটি ৪৯
লাখ ৭৮ হাজার ৬০৯টি। আর এই লেনদেনের মাধ্যমে কেবল মার্চ মাসে হাত বদল হয়েছে
৬৩ হাজার ৪৭৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে গড়ে লেনদেন হচ্ছে ১
কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার ১৭২ টাকা। দিনে দিনে এই লেনদেন আরও বেড়েই চলেছে। এর
কারণ হলো, করোনা এবং লকডাউনে মানুষ টাকা লেনদেনের জন্য সহজ মাধ্যম খুঁজে
বেড়াতে গিয়ে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে হাতের কাছে পেয়েছে। প্রথম
প্রথম মোবাইলে টাকা পাঠানো বা বিল পরিশোধ করতে গিয়ে মনের ভেতর একটু ধুকপুক
থাকলেও তা ইতোমধ্যে দূর হয়ে গেছে। ফলে এর জনপ্রিয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে
আকাশচুম্বী।
বাংলাদেশে এই সুযোগে আরও একটি বিষয় নাক গলিয়েছে এবং বেশ
ভালোভাবেই গলিয়েছে। তা হলো অনলাইন ব্যবসা। আজকাল মানুষ তাদের প্রয়োজনীয়
অনেক পণ্যই অনলাইনে দেখে কিনে থাকে। এসব পণ্যের মূল্য পরিশোধও অনেক সময়
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে করে থাকে। নির্বিঘেœ ধীরে ধীরে এই
ব্যবসা জনপ্রিয়তা লাভ করছে। মানুষ ঘরে বসে বিভিন্ন দোকানের খাবার সরবরাহের
আদেশ দিচ্ছে। ঘরে বসেই ওসব রসুইঘরের খাবার গরম গরম অবস্থায় পেয়ে যাচ্ছে।
করোনা
ভাইরাসের এই চাপের মুখেও বাংলাদেশে আর একটি খাত এগিয়ে যাচ্ছে। তা হলো
অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স। করোনা শুরু হওয়ার মুহূর্তে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন
যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সহায়ক এই খাতটি এবার বসে যাবে।
কিন্তু আমাদের সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের পরিমাণ
বেড়ে যেতে শুরু করে। এর পেছনে হয়তো বিদেশে টাকা জমিয়ে রাখার অনিশ্চয়তা কাজ
করে থাকতেও পারে, কিন্তু আমাদের অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের এগিয়ে যাওয়া এবং
রিজার্ভের বৃদ্ধি এই দুঃসময়েও আমাদের অর্থনীতির পাটাতনকে শক্তিশালী করেছে।
গত জানুয়ারি-মার্চ, ২০২১ প্রান্তিকে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স এসেছে ৫,৬৫৩.৪৮
মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই রেমিট্যান্স বিগত বছরের একই সময়কালের রেমিট্যান্স
অপো শতকরা ৯.২৮ ভাগ বেশি। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি এসেছে
ইসলামী ব্যাংকে; এই ব্যাংকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১,৬০৪.৬৬ মিলিয়ন
মার্কিন ডলার, যা মোট অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের শতকরা ২৮.৩৮ ভাগ। এ ছাড়া
ডাচ্্-বাংলা ব্যাংক (শতকরা ১৩), অগ্রণী ব্যাংক (শতকরা ১০.১), সোনালী ব্যাংক
(শতকরা ৬.৫) এবং জনতা ব্যাংক (শতকরা ৪.০০)-এর মাধ্যমেও যথেষ্ট পরিমাণে
বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরও অনেক সুখবর
রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে এ বছর কাক্সিত পরিমাণে আদেশ এসেছে বলে শোনা যায়। এ
খাতেও আকাক্সিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ঝুলিতে জমা হবে এবং আমাদের উন্নয়নকে
এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে হলে আমাদের বেঁচে থাকতে
হবে। যারা ঈদে গ্রামের বাড়ি যাবেন, তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে,
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কঠিন থাবা চারদিকে বিস্তার করে রেখেছে। এদিকে
আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই। যেটুকু আছে, সেটুকুও
বিদ্যমান রোগীদের দখলে। তাই গ্রাম থেকে রোগ নিয়ে এলে বা গ্রামে গিয়ে অসুস্থ
হলে চিকিৎসা পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই সব অবস্থাতেই
সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, এক্সপার্টস একাডেমি এবং প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক